Advertisment

মৃত্যুর আগে মেহুলি কার ফটো ছিঁড়েছে?‌: অনাবৃত ৩০

ওষুধের বাক্স বন্ধ করবার মুখে, ছোটো একটা রঙচঙে প্যাকেটে চোখ পড়ল অনুকূল রায়ের। প্যাকেটটা তুলে নিলেন। ওরাল কন্‌ট্রাসেপটিভ। - প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের ৩০ নং পর্ব।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

কখন কোনটা কাজে যে লেগে যায় কে বলতে পারে?‌ একসময়ে ‘‌জিগ্‌ স্‌ পাজল্‌’‌ করবার অভ্যেস যে এভাবে কাজে লেগে যাবে বসন্ত সাহা ভাবতে পেরেছিলেন?‌ পিচবোর্ডের ছোট ছোট টুকরো সাজিয়ে আস্ত পশুপাখি তৈরি করায় যেমন মজা ছিল, তেমন ছিল উত্তেজনা। ধাপে ধাপে চেহারা পায়। কখনও সাজাতে ভুল হয়ে যায়। আবার নতুন করে সাজাতে হত। শিশু বয়েসে পশুপাখি দিয়ে শুরু হলেও আর একটু বড় হতে খেলা কঠিন হয়েছিল। মা নিউমার্কেট থেকে জটিল পাজল্‌ খুঁজে এনে দিতেন। সেখানে টুকরো জুড়লে রোবট, স্পেশশিপ্‌, গাড়ি।
বসন্ত সাহা মেঝের ওপর বসেই ফটোর টুকরোগুলো দ্রুত হাতে মেলাতে লাগলেন। থুতনি, নাক, কপাল, হাত, পা‌। একজনের চেহারা ক্রমাগত স্পষ্ট হতে লাগল। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। একটু পরেই বসন্ত সাহা বুঝতে পারলেন, না, একজন নয়। আরও একজনের ফটোতে আছে। সে কে?‌

Advertisment

‘‌অনুকূলূবাবু, আমি এটা একটু দেখি, দেখি জোড়াতালি কিছু লাগাতে পারি কিনা। আপনি ততক্ষণ ঘরটায় চট করে চোখ বুলিয়ে নিন।’‌
‌অনুকূলূবাবু রায় ঠোঁটের কোণে একটু হেসে বললেন, ‘‌আমি চোখে বুলিয়ে কী করব?‌ আমি তো আর আপনার মতো ডিটেকটিভ নই। আমার কারবার হাতের ছাপ, পায়ের ধুলো নিয়ে। ঘটনার পর যত মানুষ ঘরে ঢুকেছে তাতে সেসবের দিকে নজর করবার মানেই হয় না। সবই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া বিষয়টা এখনও হাতের ছাপ নেওয়ার পর্যায়ে পৌছোয়নি।’
বসন্ত চাপা গলায় বললেন, ‘‌আপনি ডিটেকটিভের থেকেও‌ বেশি। আমরা ছোটখাটো কিছু মিস্‌ করলেও আপনারা ছাড়বেন না। আসলে আমি একটু সময় চাইছি, এখুনি ওরা বডি নিতে আসবে। তার আগে ফটোটা জুড়তে পারি কিনা দেখছি। জুড়তে না পারি একটা চেহারা যদি পাই তাহলেও হবে। একটার মেয়ের মৃত্যুর আগে একটা ফটোগ্রাফ এভাবে কুটিকুটি ছিঁড়েছে এটা তো কোনও স্বাভাবিক ঘটনা নয়।’
অনুকূল রায় বললেন, ‘এই কাজেরও ফরেনসিক হয়। ছেঁড়া পার্ট জুড়ে ফটো চেনা যায়।’‌
ব‌সন্ত সাহা গলা আরও নামিয়ে বললেন, ‘‌জানি। এই মুহূর্তে হাতে সময় নেই। ওসব পরে করা যাবে। অবশ্য যদি প্রয়োজন হয়। স্যার, এখনও তো নিশ্চিত নই যে এটা কোনও ফাউল প্লে।’

বুক রিভিউ পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

অলুকূলবাবু বসন্ত রায়ের ‘‌বস’‌‌ নয়। চাকরিতে উঁচু পদে কাজ করেন এমন নয়। অনুকূলবাবু তো সারাসরি পুলিশের লোকই নন। তিনি ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, অপরাধ মনঃস্তত্ত্বের একজন পণ্ডিত। ছাত্রদের পড়ান। সেই সম্মানে বসন্ত রায় তাকে মাঝেমধ্যে ‘‌স্যার’‌ ডাকেন। এই ভদ্রলোককে তিনি আগে থেকেই জানেন। ইনি যে মুকুর–‌সুনন্দর পরিচিত এটা জানা ছিল না। কাল মুকুরের বাড়িতে দেখতে পেয়ে যেমন অবাক হয়েছিলেন, তেমন খুশিও হয়েছিলেন।

অনুকূলূবাবু বললেন, ‘‌বুঝতে পেরেছি। আপনি কাজ চালিয়ে যান মিস্টার সাহা।’‌

কথা শেষ করে অনুকূলূবাবু ঘরের একদিকে সরে গেলেন। তবে চট করে কিছুতে হাত দিলেন না। তাঁর কাজ নেড়েঘেঁটে দেখা নয়। কোনও কিছুতে হাত দিলে প্রমাণ নষ্ট হয় এই জ্ঞান তাঁর আছে। সঙ্গে গ্লাভস থাকলে সুবিধে হত। ফিঙ্গার প্রিন্ট নষ্ট হত না। তবে এসব ভেবে বাড়ি থেকে বের হননি। সুনন্দর ভংয়কর খবরটা শুনে হাসপাতালে ছুটে এসেছিলেন। তিনি সতর্ক নজরে বোঝবার চেষ্টা করলেন ঘরে কোনও রকম ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছে কিনা। মিসেস সাহা বলছিলেন, মেয়েটি একা থাকে। কাল রাতে কেউ কি ঘরে এসেছিল? আসতেই পারে।‌ সে নারী পুরুষ যে কেউ হতে পারে। আত্মীয়স্বজনও আসতে পারে। অনুকূলূবাবু সর্তক চোখে চারপাশ দেখতে লাগলেন। পাশের ঘরে গেলেন। সেটাও বেডরুম। আয়তনে ছোটো। একটা খাটের ওপর বিছানা পাতা। বিছানাটি পরিপাটি। কাল অন্তত কেউ ব্যবহার করেনি। এই ঘরটা কার?‌ কে এখানে থাকে?‌ কেউ নাও থাকতে পারে।

টু রুমের ফ্ল্যাটে মেহুল একাই থাকে। আবার গেস্টরুমও হতে পারে। সুতরাং কেউ পাকাপাকি এখানে থাকতো ভাববার এখনই কোনও কারণ নেই। আবার এও হতে পারে, সেপারেশনের আগে হাজবেন্ডের সঙ্গে এই ফ্ল্যাটেই মেয়েটা থাকত।

ঘরের একপাশে একটা টেবিল। অনুকূলবাবু টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। কাগজপত্র রয়েছে। একটু নাড়াচাড়া করলেন। অফিসের কাগজ। পাশে একটা বাক্স। আয়তনে ছোটো। বাক্সের ঢাকা খুললেন। ওষুধের বাক্স। যেমন আর পাঁচটা বাড়িতে থাকে। অনুকূলবাবু ওষুধের স্ট্রিপ, প্যাকেট উলটে পালটে দেখতে লাগলেন। মেয়েটা কি সেডাটিভ নিত?‌ সুসাইড, মার্ডার এমনকি হঠাৎ হার্ট ফেলিওর ধরণের ঘটনাতেও ওষুধের বাক্স পরীক্ষা করা খুব জরুরি। মৃত মানুষটি ঘুমের ট্যাবলেটের অভ্যেস ছিল কিনা দেখতে হয়। অনুকূলবাবু এমন কেসও দেখেছেন, যেখানে সিডেটিভের অভ্যেস না থাকলে হয়তো খুনটাই হত না। ওষুধ খাওয়া গভীর ঘুমের মধ্যেই মরতে হয়েছে। ভোঁতা কোনও অস্ত্র দিয়ে মাথার পিছনে মেরেছে। যদি ঘুমের ওষুধ না খেত, সরে গিয়ে বা পাল্টা আক্রমণ করে হয়তো বাঁচতে পারত। এক্ষেত্রেও শরীর খারাপ বুঝতে পেরে মেহুল হয়তো ডাক্তারকে খবর দিতে পারত। পরিচিত কাউকে ফোন করতে পারত। তবে সিডেটিভ ধরণের কোনও ওষুধ দেখা গেল না। ওষুধের বাক্স বন্ধ করবার মুখে, ছোটো একটা রঙচঙে প্যাকেটে চোখ পড়ল অনুকূল রায়ের। প্যাকেটটা তুলে নিলেন। ওরাল কন্‌ট্রাসেপটিভ। ভুরু কোঁচকালেন অনুকূল রায়। প্যাকেট উলটে তারিখ দেখলেন। দশদিন আগের। প্যাকেটটা পকেটে রাখলেন অনুকূল বাবু। বসন্ত সাহাকে দিতে হবে।

এদিকে অন্য ঘরে খুব বেশিক্ষণ লাগল না, বসন্ত সাহা ছেঁড়া ফটোর একটা অংশ জুড়ে ফেলেছেন। মেয়েটির মুখ। চমকে উঠলেন। এ কী!‌ এতো মুকুর!‌ চোখ আর ভুরু দেখেই চেনা যাচ্ছে। সবটা জুড়লে হয়তো একটা পোস্ট কার্ডের মাপ হবে। মুকুরের এই রঙিন ফটোটা এখানে এলো কী করে?‌ আরও টুকরোগুলো জুড়তে লাগলেন উত্তেজিত বসন্ত সাহা। ধীরে ধীরে পুরুষ মানুষটি ‘‌চেহারা’‌ পেতে লাগল। পায়জামা পাঞ্জাবি পরা পুরুষ। কে এটা? মুখের অংশ তৈ‌রিতে আরও চমকে গেলেন বসন্ত সাহা। সুনন্দ না?‌ হ্যাঁ সুনন্দই তো। মুকুর আর সুনন্দ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। কোনও একটা সী বিচ। মুকুর পড়ে রয়েছে নীল রঙের শালোয়ার কামিজ। সাদা ওড়না উড়ছে। সুনন্দর পাঞ্জাবিও উড়ছে। সে ডান হাত দিয়ে বউকে জড়িয়ে রয়েছে। ফটোর রঙ এবং ফ্রেমিং দেখে বোঝা যাচ্ছে, ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়ানো কোনও পেশাদার ফটোগ্রাফারের তোলা ছবি। সী বিচ, পাহাড়ে গলায় ঝোলানো ক্যামেরা নিয়ে এরা ঘুরে বেড়ান। ফটো তুলে তিন ঘন্টা বাদে হোটেলে ডেলিভারি দিয়ে আসেন। এই ধরনের ফটোর মাপ সাধারণত পোস্টোকার্ড মাপেরই হয়। এটা কোথায়?‌ পুরী?‌ দিঘা?‌ নাকি সাউথ ইন্ডিয়ার কোনও সী বিচ?‌ যেখানেই হোক, এই ফটো এখানে এল কী করে?‌ মেহুলি নামের মেয়েটা সেই ফটো এভাবে ছিঁড়লই বা কেন?‌ তবে কী.‌.‌.‌?‌

বসন্ত সাহা ধড়্‌ফড়্‌ করে উঠে বলল, ‘‌এখনই চলুন অনুকূলবাবু। এক মিনিটও  দেরি নয়।’‌
মেহুলির ফ্ল্যাট থেকে বেরতেই তন্ময় এগিয়ে এল। তার চোখে মুখে উদ্বেগ। সে বলল, ‘‌স্যার, কী হয়েছে?‌’‌

দেবেশ রায়ের স্মৃতিকথন পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

বসন্ত সাহা এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললেন, ‘আমি বলে দিয়েছি ডেডবডি পোস্টেমর্টেমের জন্য নিয়ে যাবে।’‌ তারপর লোকাল থানার অফিসারকে কাছে ডাকলেন। নিচু গলায় বললেন, ‘‌আপাতত কাউকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেবেন না। ডেডবডি নিয়ে যাওয়ার সময়েও নয়। তারপর ভাল করে সার্চ করুন। দুটো জিনিসের ওপর খেয়াল রাখবেন। শিশি আর কোনও রকম ফটো। সেন্টের শিশি হলেও গুরুত্ব দেবেন।’

অনুকূলবাবু বললেন, ‘‌কোনও কিছুতে হাতে দেবার আগে গ্লাভস ইউজ করবেন। যতটা সম্ভব চেষ্টা করবেন যাতে কোনওরকম ছাপ নষ্ট না হয়। পরে দরকার হতে পারে।’

অফিসার বললেন, ‘‌স্যার, এটা কি কোন ক্রাইম বলে মনে করছেন?‌ মার্ডার?‌ ‌ডক্টর যে বললেন, ফুড পয়জনিং।’‌‌‌
বসন্ত সাহা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, ‘‌পয়জন তো বটেই, কিন্ত সেটা খাবারে এলো কী করে?‌ এখনই ক্রাইম বলা যাবে না, তবে পসিবিলিটিস উড়িয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। একটা একটা করে সন্দেহ নেগেট করতে করতে এগোতে হবে। যাক, গতকাল এই মেয়েটির কাছে কেউ এসেছিল কিনা জানবার চেষ্টা করুন।’‌

অফিসার বললেন, ‘‌সেটা সমস্যা হবে না। সিকিউরিটির কাছে ভিজিটরস্‌ রেজিস্টার আছে মনে হয়।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌গুড। দেখুন ভাল করে।’‌‌‌

‌—————

এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment