Advertisment

কোন খাবারে বিষ ছিল?‌: অনাবৃত ৩১

ক্লিনিকের রিপোর্ট। রিপোর্টের ওপরে তারিখের দিকে তাকালেন বসন্ত সাহা। তিন দিন আগের তারিখ। প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃতর ৩১ নং পর্ব প্রকাশিত।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

গাড়িতে উঠে অনুকূল রায় বললেন, ‘‌এবার কোথায়?‌’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘প্লেস অব অকারে্ন্স। যাকে বলে অকুস্থল।’
‘‌দ্য ড্রিম’ ফ্ল্যাটের‌‌ নেমেপ্লেটে ওপর রজনীগন্ধার মালা। মুকুর নিউমার্কেটের ফুলের দোকানে যখন অর্ডার দিতে গিয়েছিল, তারা গাঁদা ফুল দিতে চেয়েছিল।
‘‌ম্যাডাম, এই ধরনের প্লেকে গাঁদা ফুলের পর্দাই দেওয়া হয়। ভিআইপিরা এসে ফলক উন্মোচন করেন।’‌
মুকুর বলল, ‘‌এটা তো কোনও ফলক নয়, নেমপ্লেট। তাও বাড়ির নয়, ফ্ল্যাটের। আর আমার এই নেমপ্লেট কোনও ভিআইপি ওপেন করবে না। আমার বন্ধু করবে। অতএব এখানে নো গাঁদাফুল।’
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুনন্দ বলেছিল, ‘‌তাহলে গোলাপের।’‌
দোকানদার বলন, ‘‌তাই ভাল‌। সুতো দিয়ে করে দেব। একেবারে পর্দার মতো। নেমপ্লেট দেখা যাবে না। পর্দা সরালে তবে সবাই দেখতে পাবে।’‌
মুকুর একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘‌না, গোলাপ নয়। আমার বন্ধুর গোলাপ ফুল পছন্দ নয়।’‌

Advertisment

সুনন্দ অবাক হওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘‌তোমার এই বন্ধুটি কে বলও তো!‌ গোলাপও পছন্দ করে না!‌ বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না মুকুর?‌’‌
মুকুর হেসে বলল, ‘‌বলেছি তো, এখন নাম বলব না। সারপ্রাইজ। তবে ওই মেয়ে গোলাপের থেকে রজনীগন্ধা বেশি পছন্দ করে। কলেজে কোনও অকেশন হলেই রজনীগন্ধার মালা মাথায় দিয়ে আসত। এমনকি কোথাও গেলেও রজনীগন্ধার স্টিক হাতে।’
সুনন্দ বলল, ‘‌ও ইনি তাহলে তোমার কলেজের‌ বান্ধবী?‌’‌
মুকুর কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘‌এই রে ধরা খানিকটা পড়ে গেলাম। যাক, ভাই, আপনি রজনীগগ্ধা দিয়ে জিনিসটা বানিয়ে দিন। সামনে পর্দার মতো ঝুলবে। হোয়াইট কার্টেন।’‌

আরও পড়ুন, ধুলামাটির বাউল: কচিদিদার প্রজ্ঞা

সেই রজনীগন্ধার পর্দা সরিয়ে সেই ফ্ল্যাটের নাম উদ্বোধন করেছিল হৈমন্তী। সবাই হাততালি দিয়েছে। তারপর ‘‌দ্য ড্রিম’‌ এর সামনে দাঁড়িয়ে ফটো সেশনও হয়েছে। সবাই মোবাইলের বাগিয়ে ধরে। জন্মদিন অনেক হয়, ফ্ল্যাটের জন্মদিন আবার কবে পাওয়া যাবে ঠিক আছে?‌ ফটো তুলে সবাইকে দেখানো যাবে।

নেমপ্লেটের মালা শুকিয়ে গিয়েছে কিন্তু ফেলা হয়নি। সেই শুকনো মালা যেন নিয়তির মতো হাসছে। বাড়ির নিচে পুলিশের ভ্যান। বসন্ত সাহার গাড়ি থামতে লোকাল থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর এগিয়ে এসে স্যালুট করলেন।

বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌কেউ ঢোকেনি তো?‌’‌
অল্প বয়সী ইন্সপেক্টর বলল, ‘‌না স্যার, সেই যে বাড়ির সবাই বেরিয়ে গিয়েছে আর ফেরেনি। শুধু কয়েকজন মহিলা এসেছিলেন। বললেন,ওই ফ্ল্যাটের ম্যাডামের সঙ্গে স্কুলে পড়ান। কলিগ। হাসপাতালের নাম জানতে চাইছিলেন। বলতে পারিনি।  স্যার, ওসি সাহেব একটু পরেই আসেছেন। আজ কোর্টে একটা মামলা ওঠবার আছে, কাগজপত্র রেডি করছেন।’‌ গলায় কৈফিয়তের সুর। কৈফিয়ত তো দিতেই হবে। বসন্ত সাহা অনেক উঁচু পদে রয়েছেন। পুলিসের ভাষায় ‘‌বড়সাহেব’‌। ‘‌বড়সাহেব’ নিজের এলাকায় কোনও কাজে এলে থাকাটা জরুরি।

বসন্ত সাহা ফ্ল্যাটে উঠে এলেন। ঠেলতেই দরজা খুলে গেল। ইন্সপেক্টরকে বললেন, ‘‌আপনি বাইরে থাকুন। আমারা যতক্ষণ ভিতরে থাকব, কাউকে ঢুকতে দেবেন না। আসুন অনুকূলবাবু।’‌
ঘরে ঢুকে বললেন, ‘‌প্রথমেই কিচেনে যাব। সেটা যেন কোন দিকে?‌’
অনুকূল রায় বললেন, ‘‌কিচেনের খবর তো রাখি না। কাল এই ড্রইংরুমে বলেছিলাম এটুকু মনে আছে। আচ্ছা তাও চলুন দেখা যাক। তবে কাল শুনেছিলাম যেন ছাদে রান্নার ব্যবস্থা হয়েছে। কেটারারের লোকের তো ওখান থেকেই ওঠা নামা করছিল।’

বসন্ত সাহা  বললেন, ‘ছাদে হোক, ‌আমি রান্না দেখতে চাই না। গতকাল রাতের রেসিডিউ আর ওয়েস্ট কোথায় গেল সেটা দেখতে চাই। আসুন কিচেন উঁকি মারি। আপনি স্যার নাক রেডি রাখবেন। কোনও গন্ধ পেলেই বলবেন।’
অনুকূল রায় বললেন, ‘‌বাসি, পচা স্মেল ছাড়া কীই বা পাবে?‌ তাও চলুল।’‌
রান্নাঘর পরিচ্ছন্ন। বাসি খাবার তো দূরের কথা, কাপ প্লেটও সব পরিস্কার। এমনকী এক কোনায় রাখা গারবেজ  বিনটা পর্যন্ত পরিস্কার। বসন্ত সাহা দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বললেন, ‌‘‌এটাই ভয় পাচ্ছিলাম। সব ওয়াশ হয়ে গেলে প্রমাণ বলে কিছু থাকবে না। কোন খাবারের সঙ্গে পয়জন বোঝবার উপায় নেই।‌’

অনুকূলবাবু বললেন, ‘এটাই তো স্বাভাবিক। কাল পুরো খাবারটাই তো ওয়েস্ট হয়েছে। সুনন্দ অসু্স্থ হয়ে পড়বার পর পার্টি বন্ধ হয়ে গেল। কেউই খাবার মুখে দেয়নি। কেটেরারের লোকেরা নিশ্চয় অনেকটা নিয়ে গিয়েছে। বাকিটা বাইরে ফেলে দিয়েছে।’‌

আরও পড়ুন, দেবেশে রায়ের সিরিজ মনে পড়ে কী পড়ে না

বসন্ত সাহা মাথা নেড়ে খানিকটা নিজের মনেই বললেন, ‘‌সেটাই ঠিক। দ্যাট ইজ ট্রু.‌.‌.‌ দ্যাট ইজ ট্রু। তারা তো জানত না এরকম একটা ভংয়কর ঘটনা ঘটবে। আসুন আমরা বরং ঘরগুলো যতটা সম্ভব দেখে নিই। আমি এদিকটা দেখি, আপনি ওদিকের ঘরে ঢুকুন।’
অনুকূলবাবু একটু হেসে বললেন, ‘‌মিস্টার সাহা আমাকে আপনি বারবার অ্যাসিটেন্ট হিসেবে সঙ্গে নিচ্ছেন বটে কিন্ত তাতে লাভ কিছু হচ্ছে না।’‌
বসন্ত সাহা বললেন, ‘‌ছিছি, অ্যাসিস্টেন্ট বলছেন কেন?‌ আপনি একজন বিচক্ষণ মানুষ বলেই খাটাচ্ছি। আপনি তো প্রথম, যিনি আমাকে ইঙ্গিত ঘটনাটা অ্যাক্সি‌ডেন্ট নাও হতে পারে। আপনিই তো গন্ধের কথা বলেছেন। একবার নয়, দু’‌‌বার। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে। সাধারণ খাবার থেকে সালফিউরিকের গন্ধ কোথা থেকে আসবে ?‌ নিশ্চয় সামথিং রঙ। নইলে হয়তো স্ট্রং ফুড পয়েজনিং বলে আমি কেসটা ইগনোর করতাম।’‌
অনুকূল রায় বললেন, ‘‌থ্যাঙ্কিউ। আমি সেভাবে কিছু বলিনি। বুড়ো বয়েসে আমি কতটা আপনাকে হেল্প করতে পারব সেটাই ভাবছিলাম। তাছাড়া ইফ দেয়ার ইজ এনি ফাউল প্লে, আমি চাই সত্যটা প্রকাশ পাক। ঘটনাটা খুবই মর্মান্তিক। মুকুর মেয়েটিকে আমি এবং আমার ওয়াইফ খুবই পছন্দ করি। তার জীবনে এরকম একটা ডিজাস্টার ঘটে যাবে আমরা ভাবতেও পারছি না।’
‌বসন্ত সাহা বললে, ‘‌আমরা আপাতত একটা অ্যালবাম খোঁজবার চেষ্টা করব। বা ফটোর খাম।’‌

অনুকূল রায় মাথা নেড়ে পাশের ঘরে ঢুকে পড়লেন।
বসন্ত সাহা বেডরুম দিয়ে শুরু করলেন। যতটা সম্ভব না ঘাঁটাঘাটি করে তল্লাশি চালানো যায়। মুকুর ফিরে এসে যেন বুঝতে না পারে। যদিও বোঝাবুঝির মেন্টাল স্টেজে সে নেই। তারপরেও ঘর তল্লাশি হয়েছে সেটা এখনই না জানা ভাল। বিছানার চাদর, গদি অল্প নেড়ে চেড়ে দেখলেন। তারপর দেরাজ, ড্রেসিং টেবিল, হোয়াটনটে যেকটা ড্রয়ার দেখতে পেলেন খুলে দেখতে দেখতে ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে রাখা একটা ফাইল চোখে পড়ল। ওপরে বড় বড় করে মুকুরের নাম লেখা। তারওপরে লেখা ‘প্রাইভেট’‌। ‘প্রাইভেট’‌ লেখা দেখে  ফাইলটা তুলে পিছন দিক থেকে ফর্‌ফর্‌ করে ওলটাতে শুরু করলেন বসন্ত সাহা। মুকুরের ডাক্তারি ফাইল। অজস্র রিপোর্ট আর প্রেসক্রিপশন। বসন্ত সাহা ওপর ওপর চোখ বোলাতে লাগলেন। তারিখ দু’‌বছর আগে থেকে। বেশি বোঝা যাচ্ছে না, শুধু বোঝা যাচ্ছে, মেয়েলি বিষয়। মেয়েদের বাচ্চাকাচ্চা হওয়া নিয়ে ট্রিটমেন্ট, ডক্টারের পরামর্শ রয়েছে। বসন্ত সাহা ভুরু কোঁচকালেন। আচ্ছা, ছন্দা এরকম একটা কী যেন বলছিল না?‌

মুকুর মেয়েটি মা হতে পারছে না— ধরনের কিছু কি বলেছিল?‌ তাই হবে। পিছন থেকে পাতা উলটে একবারে প্রথম পাতায় পৌঁছে ফাইলটা রাখতে গিয়ে থমকে গেলেন বসন্ত সাহা। একী শেষ পাতায় এটা কী রিপোর্ট!‌ ক্লিনিকের রিপোর্ট। রিপোর্টের ওপরে তারিখের দিকে তাকালেন বসন্ত সাহা। তিন দিন আগের তারিখ।

অনুকূল রায় ঘরে ঢুকে বললেন, ‌‘‌এই ডায়েরিটা দেখুন তো কাজে লাগবে কিনা। মনে হচ্ছে, মুকুর কিছু ব্যক্তিগত কথা লিখে রেখেছে। নোটসও আছে। ড্রইংরুমে পেলাম। আর একটা কথা ফ্রিজেও দেখলাম খাবার টাবার কিছু নেই। শুধু ট্রেতে খানিকটা কেক পড়ে রয়েছে। কাল কেকটা কাটা হয়েছিল।’‌

বসন্ত সাহা হাত বাড়িয়ে মুকুরের সিক্রেট ডায়েরিটা নিয়ে বললেন, ‘ওই কেক তো আমার সবাই খেয়েছিলাম।’‌
অনুকূল রায় বললেন, ‘হ্যাঁ, ‌আর যাতেই হোক ওতে কোনও বিষ নেই।’‌
————

‌‌এই ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাসের সব পর্ব এক সঙ্গে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে

Anabrito
Advertisment