Advertisment

অনাবৃত ৩: আর্ট কলেজের ছাত্রী রায়না এসেছে‌

শুরু হয়েছে প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস। প্রতি সপ্তাহের শনি ও রবিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকবে এই ধারাবাহিক। প্রতি পর্বের সঙ্গেই দেওয়া থাকবে আগের পর্বের লিংক। পড়তে থাকুন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে

‌৩

Advertisment

হৈমন্তী একটা রোব পরেছে। একটা জাপানি কিমানো। লম্বা ঢোলা হাতা, গোড়ালি পর্যন্ত ঝুল। কোমরে চওড়া বেল্ট।
নীল সাদা রঙের এই রোব সে কিনেছিল জাপানের কোবে শহর থেকে। দোকানি মেয়েটি পুতুলের মতো। দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। ছোটো ছোটো চোখ আর একটুখানি নাক নিয়ে মানুষ যে এতো সুন্দর হতে পারে সে ধারণা জাপান না গেলে হৈমন্তীর হত না। শো কেসে রোবটা ঝুলতে দেখে খুব পছন্দ হয় হৈমন্তীর। ঠিক যেন এক ঢাল মেঘ। সে দোকানে ঢুকে পড়ে। পুতুল দোকানি তাকে রোব হাতে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘‌ডোন্ট টেক স্ত্যাগি’।
জাপানি উচ্চারণে ইংরেজি‌ শুনে মজা পেয়েছিল হৈমন্তী। কিন্তু‌ ‘‌স্ত্যাগি’ কী? এই মেয়ে ‘‌স্ত্যাগি’‌‌‌‌ নিতে বারণ করছে কেন?‌ পুতুল মেয়ে ‘‌ত’ আর ‘‌দ’ দিয়ে জড়ানো‌‌ ইংরেজিতে বুঝিয়ে বলেছিল।
‘‌আমাদের ভাষায় ‘‌স্ত্যাগি’‌ হল অন্তর্বাস। আন্ডারগার্মেন্টস্‌।’‌
হৈমন্তী চোখ কপালে তুলে বলেছিল, ‘এই রোবের সঙ্গে ইনার পরা বারণ!‌’‌
পুতুল মেয়ে বলে,‘‌অবশ্যই বারণ। তাহলে এর বিউটি কমে যায়। সুন্দরী তুমি কি বিবাহিত?‌’‌
হৈমন্তী মজা পায়। একটু ভেবে বলে,‘‌আপাতত নয়।’
‘‌তাহলে তো ভালই হল, বয়ফ্রেণ্ড তোমার বাড়িতে এলে তুমি অবশ্যই কোনোরকম অন্তর্বাস ছাড়া এই রোব পরে তাকে আপ্য়ায়ন করবে। তোমাকে আরও সুন্দর লাগবে। সে তোমাকে অন্য দিনের থেকে বেশি আদর করবে। তোমরা দুজনেই খুব আনন্দ পাবে।’‌‌
মেয়েটির বলার ঢঙে সেদিন খুব হেসেছিল হৈমন্তী। কত সহজ ভাবে শরীরের আনন্দ নিয়ে কথা বলতে পারে। পরে অবশ্য হৈমন্তী নিজেও বুঝেছিল, সত্যি এই রোব পরবার সময় ভিতরে কিছু না রাখাই ভাল। এতে শরীরের ভাঁজগুলো স্বচ্ছন্দ হয়ে ফুটে উঠতে পারে। মনে হয় গায়ে সত্যি খানিকটা মেঘ জড়িয়ে রয়েছে।

হৈমন্তী গতবছর জাপান গিয়েছিল। একুশ দিনের ট্যুর। অফিসের কাজ। সেখানকার তিনটে শহরে ঘুরেছে। তার মধ্যে একটা ছিল কোবে। কোবেতে তাদের কোম্পানির অফিস রয়েছে। জাপান যদিও ইউরোপের কোনো কোম্পানিকে সাধারণভাবে নিজের দেশে ব্যবসা করতে দিতে রাজি নয়, তারপরেও এই ফরাসি প্রসাধন কোম্পানিকে দিয়েছে। হৈমন্তীর কোম্পানির নাম ‘‌বন্‌ উইদা’। ফরাসি শব্দ '‌bonne odeure'‌‌‌ ‌–‌কে নাকি এই ভাবে উচ্চারণ করতে হয়। শব্দের শেষের ‘‌আর’ থাকে নীরব। যাকে বলে ‘‌সাইলেন্ট’‌। ‘‌বন্‌ উইদা’ শব্দের মানে ‘‌ভাল গন্ধ’‌। হৈমন্তী বাংলা করে বলে, ‘‌‌আমি ‌সুগন্ধী কোম্পানিতে কাজ করি’‌।
বুড়ি পিসিমা বলেছিল, ‘‌ধূপকাঠি বেচিস নাকি?‌ কোথায় বেচিস?‌ ট্রেনে?‌’‌
হৈমন্তী বলেছিল, ‘‌ট্রেনেও বেচি আবার বাড়িতে বাড়িতেও বেচি।’‌
‘‌বন উইদা’ কোম্পানির সব প্রোডাক্ট অবশ্য সুগন্ধের নয়। বরং সেন্ট সে কমই বানায়। তার থেকে অনেক বেশি শ্যাম্পু, ডিওডোরেন্ট, নানা ধরনের লোশন তৈরিতে তারা ব্যস্ত। ফরাসিরা ত্বকের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণ একটি জাতি। ‘‌বন্‌ উইদা’র এই ব্যাপারেও খ্যাতি রয়েছে। তারা নানা ধরনের ‘‌স্কিন কেয়ার’ প্রডাক্ট তৈরি করে। হৈমন্তী যখন এই বিখ্যাত কোম্পানিতে যোগ দিতে যায়, তখন অনেকে ভেবেছিল, সে বাইরে চলে যাচ্ছে। ঘটনা তা হয়নি। তাকে পুনের লেবরেটরির ‘‌চিফ্‌ কেমিস্ট’‌ হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে মূলত গবেষণার কাজ হয়। ভারতীয় গাছপালা, ফুল ফলকে ব্যবহার করে প্রসাধন সামগ্রী তৈরি করতে চায় ‘‌বন্‌ উইদা’। হারবাল কসমেটিকস্‌। তাই নিয়ে গবেষণা। কোম্পানি মনে করে, ভারতের ঔষধি গাছপালা ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারলে, গোটা পৃথিবীতে বড় ব্যবসা পাওয়া যাবে। যেমন চোখকে ভেজা ও মায়াময় করবার জন্য ফুলের জল থেকে তৈরি করতে হবে ‘‌প্যাচ’,‌ মধু দিয়ে বানাতে হবে ক্রিম। এখনও অনেকে মনে করে, কসমেটিকস্‌ মানে রাসায়নিক। আসলে বিষ। এদেশের ঔষধি গাছপালাকে সামনে আনতে পারলে, মানুষের এই ভয় কাটানো যাবে। এখানে কারখানা তৈরির ইচ্ছেও রয়েছে কোম্পানির। কেরলের কাছে জমি খোঁজা শুরু হয়েছে। পুনের লেবরেটরির সঙ্গে অবশ্য কোম্পানির একটি বড়সড় অফিস রয়েছে। তারা এদেশের মার্কেটিং, সেলস দেখে।
পরশুদিন রিজিওনাল হেড সুরেশ ভাট হৈমন্তীকে ডেকে পাঠান।

‘‌কেমন আছো হৈমন্তী?‌’‌
‘‌ভাল। স্যার আপনি?’‌
সুরেশ ভাট বললেন, ‘চলেছে। তোমার ল্যাবরেটরির সমস্যা মিটেছে?‌’‌
হৈমন্তী বলল, ‘‌পুরো মেটে নি। নতুন দুটো মেশিনের একটা এখনও ইনস্টল হয়নি। সফটওয়্যারে সমস্যা হচ্ছে। আশা করি কয়েকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।’
সুরেশ বললেন, ‘‌দুটোই তো জার্মান মেশিন?’‌
হৈমন্তী বলল, ‘‌না স্যার একটা ইউ কে মেড। ওরা কেমিক্যাল স্পটিং এর ওপর খুব ভাল কাজ করছে। কোথাও কোনো রকম পয়জন এলিমেন্ট থাকলে দ্রুত ধরে ফেলছে। ওদের চিপ অ্যানালাইজিং সিস্টেম খুবই ভাল।’‌
সুরেশ ভাট একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘‌হৈমন্তী, ‌কোম্পানি তোমাকে আর একটু দায়িত্ব দিতে চাইছে।’‌
হৈমন্তী নড়েচেড়ে বসে বলল, ‘‌ওকে স্যার।’‌
‘‌ওরা বলছে, তুমি এবার একটু মার্কেটিং পার্টেও  ইনভলভড্‌ হও।’‌
হৈমন্তীর পিসিমার কথা মনে পড়ে যায়। ট্রেনে ধূপকাঠি বেচবার কথা। সে আঁতকে উঠে বলল, ‘‌এই রে!‌‌ আমাকে কি এবার থেকে জিনিস বেচতেও হবে? স্যার সেটা কি পারব?‌ সামান্য একজন কেমিস্ট আমি।‌’‌
হৈমন্তীর বলার ভঙ্গী দেখে সুরেশ হেসে ফেললেন। বললেন, ‘‌না না, সেলস তোমাকে দেখতে হবে না। ইস্টার্ন জোনে কোনও কোনও প্রডাক্টে আমরা মার খাচ্ছি। বিশেষ করে মেল কসমেটিক্স। পুরুষদের বডি লোশন, ডিওডরেন্ট। সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে তুমি শুধু তোমার মতো করে দেখবে। প্রোডাক্টের কোনো সমস্যা?‌ নাকি আমাদের পাবলিসিটি ঠিক মতো হচ্ছে না?‌ আবার এমনও তো হতে পারে ইস্টার্ন জোনে আমাদের অর্গানাইজেশনে কোনো ফাঁক রয়েছে?‌’‌
হৈমন্তী বলল, ‘‌তাহলে ঠিক আছে স্যার, এটা মনে হয় পারব।’
‌সুরেশ ভাট বললেন, ‘ধন্যবাদ। কোম্পানি তোমাকে একটু বেশি রিলাই করছে হৈমন্তী। এই প্রস্তাব ওরাই পাঠিয়েছে।’‌
হৈমন্তী কৃতজ্ঞ গলায় বলল,‌ ‘‌ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। আপনি আমাকে সুযোগ দিয়েছেন।’‌
‌সুরেশ ভাট ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘চিন্তা একটাই। তোমার মতো এফিসিয়েন্ট একজন কর্মীকে ওরা নিয়ে না যায়।’
হৈমন্তী অবাক হয়ে বলে, ‘‌কোথায় নিয়ে না যায়!‌‌’‌
‘‌কেন?‌ প্যারিস বা লন্ডন। যে দুটো জায়গা থেকে ওরা বিজনেস অপারেট করে।’‌‌
হৈমন্তী হেসে বলল, ‘‌কী যে বলেন, এতো বড় ব্র‌্যাণ্ড। সারা পৃথিবী জুড়ে যোগ্য কর্মী। আমাকে কেন নেবে?‌ আমাকে নেবে না।’‌
সুরেশ ভাট  উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘‌আমিও সেরকম চাইব। তোমাকে যেন না নেয়। আমার এখানে অফিসটা ঠিক থাকুক। তোমার রিসার্চ ঠিক থাকুক।  সেলফিস চাওয়া, তবু আমাকে তো আমার দিকটাই দেখতে হবে। হবে কিনা?‌’
কথা শেষ করে সুরেশ হাসলেন।‌
হৈমন্তী খানিকটা লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘‌কী যে বলেন স্যার।’‌
সুরেশ বলল,‘‌তুমি তাহলে প্রোগ্রাম ঠিক করে ফেল। ও ভাল কথা, কোম্পানি জানিয়েছে, এই প্রজেক্টের জন্য ওরা তোমাকে আলাদা প্যাকেজ দেবে।’
হৈমন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘ওকে স্যার। কিন্তু আমাকে যে ‌একটু সময় দিতে হবে। আমি এদিকটা একটি গুছিয়ে নিই। তাছাড়া আমি কয়েকদিন জন্য কলকাতা যাচ্ছি। ছুটির অ্যাপ্লিকেশন মেল করে দিয়েছি।’‌
সুরেশ ভাট ভুরু কুঁচকে বললেন,‘‌কলকাতায় যাচ্ছো মানে?‌ বাড়িতে?‌’‌
হৈমন্তী সামান্য হেসে বলল, ‘বাড়ির পাট অনেকদিন চুকে গেছে স্যার। বাবা–‌মা মারা যাবার পরেই বাড়ি বিক্রি হয়ে করে দিয়েছি। এক মেয়ে আমি, বাড়ি রেখে কী করব? বাইরে বাইরে ঘুরে চাকরি করি।‌ কলকাতায় গেলে আমি হোটেলে উঠি। নয়তো চেনাজানা কারও বাড়ি।’‌
সুরেশ বললেন, ‘আচ্ছা হৈমন্তী, এবার কলকাতায় গিয়ে প্রাইমারি কিছু কাজ শুরু করে দিয়ে আসতে পারো না?‌’‌‌
হৈমন্তী মাথা নামিয়ে নিচু গলায় বলল, ‘সরি স্যর, এবার সময় পাব না। আমার অন্য কাজ রয়েছে।‌’‌‌
দরজা খুলে হৈমন্তী বলল, ‘‌এসো রায়না।’‌
এক তরুণী ঘরে ঢুকল। শালোয়ার কামিজ পরা এই তরুণীর বয়স খুব বেশি হলে সাতাশ আঠাশ হবে। সাজগোজের বাহুল্য নেই। চুল টেনে বেঁধে, একটা টিপ পরেছে। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। ব্যাগ থেকে গোল করে পাকানো একটা কাগজ বেরিয়ে রয়েছে। তরুণীর গায়ের রঙ চাপা, তবে  দুটো চোখই ঝক ঝক করছে।
হৈমন্তী সরে এসে বলল, ‘‌তুমি স্টাডিতে গিয়ে রেডি হও। পাখা আলো জ্বালিয়ে নাও।’‌
হৈমন্তী কাজের লোক আসে সকালে। কাজ সেরে চলেও যায় খুব তাড়াতাড়ি। রান্না হৈমন্তী নিজেই করে। ছুটির দিন ছাড়া রান্না নেই। হেভি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যায়। অফিসে লাঞ্চ। ডিনার হয় বাইরে, নয় সামান্য কিছু কিনে নিয়ে ফেরে। কোনো কোনোদিন দুধ কর্নফ্লেক্স ধরনের কিছু খেয়ে নেয়। অতিথি এলে সুইগি, জোমাটোরা তো আছেই। দু’‌বার সংসার শুরু করেও থমকে যেতে হয়েছে হৈমন্তী। থমকে নাকি প্রতারিত হয়ে?‌ প্রথমবারের ধাক্কাটা খুব বড় ছিল। অ্য়াবরশন পর্যন্ত যেতে হয়। দ্বিতীয়বার নিজেই সরে এসেছে। তাই কি আর সংসারে মন নেই?‌‌ নাকি আছে? মনের ভিতরে কোথাও চাপা পড়ে আছে? তাই ‌ক্লান্ত লাগে!
রায়না স্টাডিরুমে এসে আলো জ্বালালো। সে পুনের এক বিখ্যাত আর্ট কলেজের ছাত্রী ছিল। খুব ভাল নম্বর পেয়ে পাশ করেছে। এখনও স্থায়ী কোনো কাজ পায়নি। ফ্রিলান্স করে বেড়ায়। রায়না ফাইনাল পরীক্ষায় বহু বিষয়েই খুব ভাল নম্বর পেয়েছে। খোঁজ খবর নিয়েই তার সঙ্গে হৈমন্তী যোগাযোগ করে। গত তিনমাসে মোট সতেরো দিন সে এখানে এসেছে। আজ আঠেরোতম দিন।
খুব অদ্ভুত একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে সে এখানে আসে।
(ক্রমশ)

ধারাবাহিক এই উপন্যাসটির দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন এখানে

ধারাবাহিক এই উপন্যাসটির প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে

 

Anabrito
Advertisment