বসন্ত সাহা মুকুরের শান্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। এ ধরনের ঘটনায় তিনি অভ্যস্ত। পুলিসের জেরার মুখে যেমন অনেকে ভেঙে পড়ে, তেমন হল না। মুকুর নিজেই নিজেকে সামলায়। মিনিট খানেক পরে নিজেই মুখ তোলে। চোখ মুছে শক্ত গলায় বলে, ‘বলুন, আপনার কী প্রশ্ন রয়েছে।’
বসন্ত সাহা সরাসরি এবার কোনওরকম ভনিতা না করে সরাসরি শুরু করেন।
‘আমার খুব খারাপ লাগছে, এরকম একটা সময়ে তোমাকে ডিসটার্ব করছি। কিন্তু কিছু করার নেই। আমার মতো নিশ্চয় তুমিও চাও সুনন্দ হত্যাকারী ধরা পড়ুক। অনেক বড় দুঃখ তুমি পেয়েছো, এইটুকুও তোমাকে সহ্য করতে হবে। তোমার কোঅপারেশন জরুরি।’
মুকুর বলল, ‘বলুন।’
তার গলা শুনেই বোঝা যায়, যে বসন্ত সাহাকে সে পছন্দ করে, এই মুর্হূতে তার সামনে বসা মানুষটি সে নয়। বসন্ত সাহা এই মনোভাবকে ইগনোর করলেন। বললেন, ‘তুমি কি কাউকে সন্দেহ করো?’
মুকুর চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘আপনারা কি নিশ্চিত এটা মার্ডার?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘হ্যাঁ। অন্তত একজনের বেলাতে তো বটেই।’
‘সেটা সুনন্দ না হয়ে মেহুলও তো হতে পারে? হয়তো ওর খাবারে বিষ মেশাতে গিয়ে সুনন্দকে ভুল করে...।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘হতে পারে। তবে সেটাও মার্ডারই হবে। তুমি কি মনে করো মেহুলকে মারবার মতো কেউ রয়েছে?’
মুকুর বলল, ‘মনে করি না। তন্ময়ের সঙ্গে তার সেপারেশন চললেও, সেটা খুনোখুনির পর্যায়ে যাবে না।’
‘সুনন্দর কোনও শত্রুর খবর তুমি জানো? এমল কোনও শত্রু যে এই পার্টিতে ছিল?’
মুকুর মাথা নামিয়ে একটু ভাবল। তারপরর বলল, ‘আমি কেমন করে জানব? তবে কেটারার প্রতীকের সঙ্গে কদিন আগে একটা মন কষাকষি হয়েছিল। সে এই অকেশনে কাজ করবে না বলেছিল।’
আরও পড়ুন, মৃত্তিকা মাইতির ছোট গল্প: হারমোনিয়াম
বসন্ত সাহা ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কী নিয়ে মন কষাকষি?’
মুকুর বলল, ‘প্রতীক ওর ছোটোবেলার বন্ধু। টাকা ধার চেয়েছিল। সুনন্দ দিতে রাজি হয়নি। তবে তার জন্য বিষ খাইয়ে মারবে এমনটা ভাবা অসম্ভব।’
বসন্ত সাহা একট চুপ করে রইলেন, তারপর দুম করে বললেন, ‘আচ্ছা মুকুর, তুমি ছাড়া গেস্ট লিস্টটা আর কে জানত?’
মুকুর বলল, ‘মানে!’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘পার্টিতে কে আসবে তার নাম কার জানা ছিল?’
মুকুর অবাক গলায় বলল, ‘আর কে জানবে?’
বসন্ত সাহা নরম গলায় বললেন, ‘সেটাই তো জানতে চাইছি। কাকে তুমি আমাদের কথা বলেছিলে?’
মুকুর ভুরু কঁুচকে ভাবল। বলল, ‘কাউকে বলেছি বলে তো মনে পড়ছে না।’ তারপর নিজের মনেই বলল, ‘সুনন্দকেও তো বলিনি। পুরোটা জানে না। সারপ্রাইজের জন্য গোপন রেখেছিলাম।’
‘সারপ্রাইজ!’
মুকুর বলল, ‘হ্যাঁ, সারপ্রাইজ। আমার কলেজের এক সহপাঠী পুনেতে থাকে। সে এই ফ্ল্যাটের নাম দিয়েছে, আমি সুনন্দকে বলিনি সে আসছে। বলেছিলাম ‘দ্য ড্রিম’ নামটা যে দিয়েছে সে আসবে।’
‘সে কি এসেছিল?’
মুকুর শান্ত ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, এসেছিল। হৈমন্তীর সঙ্গে আপনাদের আলাপও করিয়ে দিই। ও, মেহুল আর দিশা, কঙ্কনা মিলে কেক ডিসট্রিবিউট করল। ও, শেষের দিকে দিশাও জয়েন করল। কত হই চই! কত আনন্দ! ওফ্ আমি ভাবতে পারছি না। মনে হচ্ছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন। এই দুঃস্বপ্ন কেটে যাবে।’
কথা বলতে বলতে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ ঢাকল মুকর।
বসন্ত সাহা চুপ করে থাকলেন। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি কখনও পড়েননি। মনে মনে অভিযুক্ত করে যে মেয়েটিকে তিনি আসলে জেরাই করছেন তাকে তিনি অল্পদিনের পরিচয়তে পছন্দ করে ফেলেছেন। মুকুরও সে কথা জানে। সাগ্নিক এই কাজটা করতে পারত। কিন্তু কেন জানি বসন্ত সাহার মনে হয়েছে, এই রহস্য সমাধানের প্রথম চাবিটি রয়েছে মুকুরের হাতে। সেই জন্য তিনি নিজে এসেছেন। এই ধরনের জেরার সময় সঙ্গে একজন লেডি অফিসার নিয়ে আসা নিয়ম। সেই নিয়ম তিনি আজ মানেননি। চাননি মুকুরকে এখনই নিয়মের মধ্যে ফেলতে।
আরও পড়ুন, বিনোদ ঘোষাল: একটি জন্ম ও একটি মৃত্যুর গল্প
মোবাইল বেজে উঠল। বসন্ত সাহা ফোন তুললেন। সাগ্নিক।
বসন্ত সাহা চাপা গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে সাগ্নিক?’
সাগ্নিক ওপাশ থেকে নিচু অথচ উত্তেজিত গলায় বলল, ‘স্যার, একটা অদ্ভুত ব্যাপার।’
সাগ্নিক ঠান্ডা মাথার অফিসার। সহজে উত্তেজিত হয় না। তারওপর সে জানে ‘স্যার’ মুকুরের কাছে এসেছে। বসন্ত সাহা ভুরু কুঁচকে বললেন,. ‘কী হয়েছে?’
সাগ্নিক বলল, ‘আপনি মিসেস মুকুরের যে সিক্রেট ডায়েরিটা আমাকে দেখতে দিয়েছিলেন, তার একটা পাতা ছেঁড়া।’
বসন্ত ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তার মানে! কই আমার তো চোখে পড়েনি।’
সানে মুকুর বসে, তাঁকে খুব সাবধানে হয়ে কথা বলতে হচ্ছে। এমন কোনও শব্দ এখনই ব্যবহারক করা যাবে না যাতে মুকুর বুঝতে পারে।
সাগ্নিক বলল, ‘স্যার, খুব কেয়ারফুলি ছেঁড়া হয়েছে। ডায়েরির বাইন্ডিং থেকে খুলে নেওয়া হয়েছে মনে হচ্ছে।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘তুমি বুঝলে কী করে?’
‘পরের পাতায় ইম্প্রেসন পড়েছে। এই মাত্র কার্বন পেপার দিয়ে ঘষে সেই ইম্প্রেসন আমি উদ্ধার করেছি। ওপরে লেখা ‘গেস্ট লিস্ট’। দ্য ফার্স্ট নেম ইজ ইওরস্।’
‘এরকম কটা নাম তুমি পড়তে পারলে?’
সাগ্নিক বলল, ‘প্রায় সবই স্যার। স্যার, আমি সিওর কেউ একজন এই লিস্ট ওই খাতা থেকে চুরি করেছে।’
বসন্ত সাহা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সাগ্নিক খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ইনফর্মেশন দিল। তার মানে মুকুর নয়। অন্য কেউ? সে কে?
মুকুর আবার নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখ তুলেছে। ফোন রেখে বসন্ত সাহা নরম গলায় বললেন, ‘মুকুর, তুমি কি তোমার ডায়েরির পাতা ছেঁড়?’
মুকুর অবাক হয়ে বলল, ‘ডায়েরির পাতা কি কেউ ছেঁড়ে বসন্তদা?’
‘যাক নিশ্চিন্ত করলে। এই অকেশন ফাইনাল করবার পর তোমার এই ফ্ল্যাটে কে কে এসেছে। অবশ্যই তুমি আর সুনন্দ ছাড়া।’
মুকুর বলল, ‘ফাইনাল তো শেষদিন পর্যন্ত হয়েছে। অনেকেই এসেছে। মেহুল, কঙ্কনা এসেছে। একদি সন্ধেবেলা দিশা আর কিশোরও এসেছিল মনে পড়ছ। পুনে থেকে হৈমন্তীও এসেছে। আর আর...। প্রতীক বেশ কয়েকবার এসেছে মেনু ফাইনাল করতে। ও একদিন কঙ্কনাও এসেছিল।’
বসন্ত সাহা খানিকটা নিজের মনেই বললেন,‘ও। তাহলে যেকেউ করতে পারে।’
মুকুর অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কী করতে পারে?’
বসন্ত সাহা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তোমার সিক্রেট ডায়েরি থেকে পাতা চুরি। তোমার ওই ডায়েরিটা পেয়ে আমাদের খুব সুবিধে হয়েছে। সেদিনের গেস্টদের সবার সম্পর্কেই আমাদের একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে। তোমাকে প্রশ্ন করে ব্যস্ত করতে হল না। আর দুটো কথা। এক নম্বর সুনন্দর ইনসিওরেন্সের কাগজগুলো একটু রেডি করে রাখবে। দরকার হলে আমার দেখব। দুই, তুমি যে এক্সপেক্ট করছ সেটা সুনন্দ জানত?’
মুকুর একটু যেন চমকে উঠল। বলল, ‘আপনি জানলেন কী করে ? আমি তো বৌদিকেও বলিনি।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘আমি সেদিন তোমার রিপোর্ট দেখেছি মুকুর।’
মুকুর মাথা নামিয়ে বলল, ‘ও। হ্যাঁ, সুনন্দ জানত সে বাবা হতে চলেছে। দীর্ঘ চিকিৎসার ফল। ওই পার্টিতে তার ঘোষণা করবার কথা ছিল। এই উপলক্ষে সে পুনে থেকে আমার জন্য একটা আংটিও নিয়ে এসেছিল।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘ও পার্টি তাহলে শুধু ফ্ল্যাটের কারণে ছিল না। আমিএ এরকম একটা কিছু ভেবেছিলাম। যাক, আমি আজ চললাম। তোমার বসন্তদাকে ভুল বুঝো না। তুমি আমাকে আর তোমার বৌদিকে নিশ্চিন্ত করলে। শুধু একটাই অনুরোধ, কদিন কলকাতা ছেড়ে কোথাও না গেলে ভাল হয়, পুলিশের কাজ করতে সুবিধে হয়।’
‘আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? আমি সুনন্দকে বিষ খাইয়েছি?’
বসন্ত সাহা সামান হেসে বললেন, ‘এতক্ষণ করছিলাম। আর করছি না।’
মুকুরের বাড়ি থেকে বেরিযে অফিসে গেলেন বসন্ত সাহা। সাগ্নিক ঘরে এল।
‘স্যার, কিছু পাওয়া গেল?’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘পাওয়া গেল। আর যেই হোক, মুকুর খুন করেনি। শর্ট লিস্ট করেছো।’
সাগ্নিক বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। কঙ্কণ–পলাশ, উজ্জ্বল– নয়নিকা, প্রতীক, দিশা–কিশোর, তন্ময় আর মেহুল। আর হ্যাঁ, হৈমন্তী।’
বসন্ত সাহা বললেন, ‘তার মানে ন’জন? এর মধ্যে খুনি যে কেউ হতে পারে।’
সাগ্নিক বলল, ‘মোটিভটা ধরতে পারলে অনেকটা ক্লিয়ার হবে।’
বসন্ত সাহা ধীর স্থির ভাবে বললেন, ‘না সাগ্নিক, ওট ক্লাসিকাল পদ্ধতি। এই কেসে আমাদের এগোতে হবে উলটো পথে। আগে জানতে হবে, খুনি কাকে খুন করতে চেয়েছিল? তারপর কীভাবে খুন করেছে। তারপর মোটিভ। সাগ্নিক, এটা একটা জটিল এবং ইউনিক কেস।’
বসন্ত সাহা কথা শেষ করতেই টেবিলে রাখা মোবাইল বেজে উঠল। বসন্ত সাহা ফোন ধরে বললেন, ‘বল মুকুর।’
ওপাশ থেকে মুকুর ভাঙা গলায় বলল, ‘বসন্তদা, একটা কথা মনে পড়েছে।’
————
এই উপন্যাসের সব পর্ব একত্রে পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে