Advertisment

অনাবৃত ৩৫: দুটি ফোন কারা করল?‌ কাদের করল?‌

ফেনার মধ্যে বুক পর্যন্ত ডুবিয়ে বসেছিল সে। হাতের পেপারব্যাক সরিয়ে একটু উঠল সে। ফটফটে সাদা ফেনায় আলতো ভাবে ভেসে উঠল তার বাদামী দুটি স্তন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito

অলংকরণ- অরিত্র দে

প্রথম ফোন

Advertisment

মোবাইল যখন বাজল, তখনও তার ঘুম কাটেনি। এমনিতেই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়। বেলা হয়ে যায়। কদিন হল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে। কাল একটায় হয়নি। আড়াইটে পর্যন্ত ছটফট করে, দ্বিতীয়টা খেতে হয়েছে। সে হাত বাড়িয়ে বালিশের তলা থেকে ফোন বের করল।

‘বসন্ত সাহা লোকটা গোলমাল শুরু করেছে।’
ঘুমের ঘোরে বসন্ত সাহা নামটা মাথায় স্ট্রাইক করল না।
‘‌হু ইজ বসন্ত সাহা!‌’‌
‘‌চিনতে পারছো না?‌ সেদিনের পুলিশ অফিসার। পার্টিতে ছিল। ওই লোকটাই তো ঘটনাকে অ্যাক্সিডেন্ট না বলে মার্ডার বলতে চাইছে। ইনভেস্টিগেশন শুরুও করেছে।’‌
‘‌ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে। ও মার্ডার বললেই তো হবে না। প্রমাণ করতে হবে।’
‘‌লোকটা বু্দ্ধিমান।’‌‌
‘‌আমার থেকেও?‌’‌
‘‌তোমার কতটা বুদ্ধি পরে বোঝা যাবে। যাক, ওর এক অফিসার ফোন করে বলেছে, কোথাও যাওয়া যাবে না। কলকাতাতেই থাকতে হবে।’
‘আমাকে তো বলেছে। সেদিন পার্টিতে যারা ছিল, সবাইকে বলেছে।’
‘শুধু তাই নয়, আমাকে ওর অফিসে দেখা করতে বলেছে।’
‘তাই নাকি!‌’
সে উঠে বসল। ঘরের এয়ারকন্ডিশনার বিজ্‌বিজ্‌ করে চলছে। যদিও ঠান্ডা কম করা আছে, তারপরেও শীত করে। বিছানার পাশে সাউড টেবিল থেকে রিমোর্টটা তুলে এসি মেশিন বন্ধ করল।
‘‌এখন কী কর্তব্য?‌’‌
‘‌কী আবার, ডেকেছে যখন যাবে। সাবধানে উত্তর দেবে।’‌
‘‌পুলিশ খুব ঝানু হয়। আমাকে অসাবধান করতে মোটে সময় নেবে না।’‌
‘তাহলে কী করবে ভাবছো?‌’‌
‘‌এতে ভাবাভাবির কী আছে? যা হবে ফেস করতে হবে।’‌‌
‘‌তোমার সঙ্গে আর একবার দেখা করা যাবে?‌’‌
‘খেপেছো। তোমার ওই বসন্ত‌ সাহা সবার পিছনে লোক লাগিয়ে রেখেছে।’‌
‘‌লোক লাগালে কী এসে যায়?‌ খুন তো আমরা করিনি। আমাদের অপরাধ কোথায়?‌’‌
‘‌আমাদের সমস্যা, অন্য জায়গায়।’‌
‘কোন জায়গায়!’
‘‌তুমি জানো না?‌ বুঝতে পারছো না?‌ আমাদের রিলেশন জানাজানি হয়ে যাবে।’
‘‌একদিন তো হবেই।’‌
‘‌সময় নিতে হবে। তাছাড়া এরকম একটা গোলমালের সময়ে যদি সবাই জেনে যায় কী হবে ভাবতে পারছো?‌’‌
‘‌না পারছি না, তবে তোমার ভয়টা আন্দাজ করছি। তোমার সাহস আসলে বিছানায়, দরজা লক করে।’‌
‘‌এমন ভাবে বলছো যেন বিছানা শুধু আমার লাগে।’‌
‘‌তুমি কি আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে ফোন করছো?‌’‌
‘‌আমি পুলিশের কাছে যাব না। ওরা জেরা করে সব বের করে নেব।’‌
‘‌তাহলে পালিয়ে যাও। কোনও অপরাধ না করে পালাতে চাইলে পালাও।’‌
‘‌খুন না করলেও অন্য অপরাধ তো করছি।’
‘কী অপরাধ?‌ পরকীয়া?‌’
‘‌নিশ্চয়।’‌
‘‌বোকার মতো কথা বলও না। পরকীয়া এখন আর কোনও অপরাধ নয়। সুপ্রিম কোর্টের ভার্ডিক্ট হয়ে গিয়েছে। তুমি জানো।’‌
‘কথাটা তুমি বোকার মতো বললে। আমি আইনের চোখে অপরাধের কথা বলছি না‌।’‌
‘‌তাহলে?‌’‌
‘‌তুমি বুঝতে চাইছো না।’‌
‘‌অনেকদিন ধরেই তোমাকে বলছি। ’‌
‘‌কী বলছো ‌সোনা?‌ তুমি দাম্পত্যও চালাবে আবার আমার সঙ্গে শোবেও এই কথা?‌’‌
‘‌তোমার সঙ্গে কথা বলার কোনও মানে হয় না।’‌
‘‌আহা রেগে যাচ্ছো কেন!‌ শোয়ার কথা বললাম বলে?‌ তুমি সকালে ঘুম ভাঙিয়ে পুলিশের কথা বলবে,‌ আর আমি একটু শোওয়াশুয়ির কথা বললেই রেগে যাবে?‌’‌
‘‌কী বলতে চাইছ?‌’‌
‘‌বলতে চাইছি, পুলিশের প্রবলেম তোমার সোনা, আমার নয়।’‌
‘‌এসব কী বলছো!‌’‌
‘‌ঠিকই বলছি। ‌এবার ফোন রাখো। আমি ঘুমোব।’‌
‘‌ঘুমোতে পারো কিন্ত আমি তোমাকে ছাড়ব না। এই মার্ডার তুমি করো নি তার কী প্রমাণ?‌ একসময়ে তুমি মুকুরকে মেরে ফেলবার প্ল্যান করতে। বলো করতে কিনা?‌ সুনন্দর সম্পত্তির ওপর তোমার লোভ ছিল।’‌
‘‌বাজে কথা।’‌
‘‌আমাকে লুকোতে যেও না। আমি পুলিশকে সব বলে দেব।’‌
‘সুনন্দর কী এমন সম্পত্তি র‌য়েছে যে তার বউকে মেরে তাকে বিয়ে করতে হবে?‌’
‘‌সে তুমি জানো ডার্লিং। বাবার এক ছেলে যে জমিদারবংশের একমার উত্তরাধিকারী সে খবর অনেকে না রাখলেও তুমি রাখ। টাকির কাছে প্রাসাদের মতো বাড়িটির যে তার, সেটিকে বিক্রি করলে রিসর্ট বানালে যে কয়েক কোটি টাকার মুনাফা যে হিসেবে তোমার করা হয়ে গিয়েছিল।’‌
‘‌শাট আপ্‌।’
‘‌আহা সোনা চিৎকার করে না। তুমি এও জানতে মুকুর সুনন্দকে বিশ্বাস করত না। তার আগে বিয়ে ছিল। সে মেয়েটিকেও তুমি চেনো। আমিও চিনি। সেদিন পার্টিতে এসেছিল। মুকুর তাই ডিভোর্সের বিষয় প্যাঁচ মেরে রেখেছিল। ঝামেলা পাকাতে হলে সুনন্দকে খেসারত দিতে হত। তার থেকে সরিয়ে দেওয়াই ভাল।’‌
‘‌মুখ সামলে কথা বল।’‌
‘‌আহা, চটছো কেন?‌ মুখ সামলে কথা তুমি বলবে। আমাকে নয়, পুলিশকে। পুলিশকে বলবে মেহুলকে কীভাবে বিষ খাইয়েছিলে। জলে মিশিয়ে?‌’
‘‌শাট আপ ইউ বিচ। এটা তোমার ক্রাইম থ্রিলার নয়। যাও পুলিশকে যা খুশি বল গিয়ে। আই ডোন্ট কেয়ার।’‌‌

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের স্মৃতি-সত্তা থেকে তুলে আনা কলাম মনে পড়ে কী পড়ে না

দ্বিতীয় ফোন

বাথটাবের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা মিহি সুরে বাজচ্ছে। খুব বিখ্যাত গানের লাইন। গানটে চেনা লাগলেও চেনা যাচ্ছে না।
সে বাথটাবে আধশোয়া। একদিকে ব্যাক রেস্ট র‌য়েছে। সেখানে মাথা। একরাশ চুল ছড়িয়ে রয়েছে বাথটাবের গা বেয়ে। তার হাতে একটা বই। বইটি একটি অটোবায়োগ্রাফি। গাব্রিয়েল রেঁয়াদ্‌ নামে এক মহিলার লেখা। পুরোনো দিনের হলেও ইংরেজিটা সুখপাঠ্য। ভাষার থেকে বড় কথা, বইটা খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয়। রেঁয়াদ্‌ ছিলেন একজন মডেল। ন্যুড মডেল। শিল্পীর সামনে নগ্ন হতেন। তাও আমার যে সে শিল্পী নয়, দুনিয়া কাঁপানো শিল্পী। তিনি কৈশোর থেকে শুরু করে দীর্ঘ কুড়ি বছর এই কাজ করেছেন। তিনি ফরাসি শিল্পী পিয়ের অগুস্ত র‌্যনোয়ারের মডেল। বিশ্বের সেরা শিল্পদের একজন র‌্যনোয়ার। একসময়ে বাইসাইকেল থেকে রিউম্যাটিজমে আক্রান্ত হয়েছিলেন র‌্যনোয়ার। তারপরে তিনি বহু বিখ্যাত সব ছবি এঁকে গিয়েছেন। আজও সেসব ছবি বিস্ময়কর। শিল্পরসিকরা বারবার সেই সব ছবি দেখেন নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন। অন্তর্গত অর্থ তো বটেই, এমনকী রঙ, ব্রাশ, স্ট্রোক নিয়ে চর্চার শেষ নেই।

নিজে শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়েও র‌্যনোয়ার একটার পর একটা ন্যুড এঁকেছেন।  স্পর্শকাতর, কামোদ্দীপক নগ্ন নারী। কখনও কোচে শোওয়া, কখনও বসে রয়েছে চেয়ারে। তাদের ভঙ্গিমায় কখনও অপেক্ষা, কখনও রতি–‌ক্লান্তি, কখন উত্তেজনা, কখনও একাকী বিষণ্ণ। র‌্যনোয়ার বিশ্বখ্যাত ন্যুড পেইনটিংসের মধ্যে রয়েছে ‘‌‌ন্যুড ইন আ চেয়ার,’‌ ‘লার্জ ন্যুড’‌, ‘‌রিক্লাইনিং ফর্ম দি ব্যাক’‌‌। আর্ট ক্রিটিকরা লিখেছেন ,‘‌এই সব ছবিতে নারীর গড়ন সুঠাম, সুডৌল। ভারি নিতম্ব ও গভীর স্তন। কোনও কোনও ছবিতে নরম উজ্জ্বল ত্বকে নারী ক্লান্তি ও বিষাদ মুক্ত। চরম ব্যক্তিগত অংশটি উদ্ভাসিত, প্রস্ফুটিত। সব মিলিয়ে সতেজ ও লাবন্যময়ী। ক্রিটিকরা মনে করেছেন, নারীর এই কামোদ্দীপক রূপ শুদ্ধ প্রকৃতিরই অংশ। প্রকৃতিকে ছড়িয়ে গাছ, লতা–‌পাতার মতোই উন্মুখ। ‘‌বেদার ড্রায়িং হার লেগ’‌ ছবিটি গভীর যৌন সম্পর্কযুক্ত, গোপন অভিব্যক্তি সংকোচনহীন ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে।
গাব্রি্য়েল রেঁয়াদ্‌  নিখছেন, ‘‌পনেরো বছর বয়স থেকে এই মহামানবের সঙ্গে কাজ করছি। নগ্ন হয়েছি বারবার। আগে জানতাম শুধুমাত্র মানবের জন্ম আছে, তাঁর কাছে জানলাম জন্ম আছে শরীরেরও। আমার শরীর জন্ম ধন্য হল। আমার শরীর দেখে কখনও খুশি হয়েছেন, কখনও বিরক্ত। দূর থেকে দেখেছেন। তবু মনে হয়েছে আমার খুব কাছে। যখনই  পেনসিলে, তুলি আঁচড় দিয়েছেন ক্যানভাসে, মনে হয়েছে আমাকে স্পর্শ করছে। সে স্পর্শ কোনও পুরুষের নয়, সে স্পর্শ আমাকে নিয়ে যেত এক অনির্বচনীয় সুখ যাত্রায়। একদিন মঁসিয়ে স্টুডিওতে এসে আমাকে বললেন.‌.‌.‌’‌
এই সময়ে মোবাইল বেজে উঠল। ফেনার মধ্যে বুক পর্যন্ত ডুবিয়ে বসেছিল সে। হাতের পেপারব্যাক সরিয়ে একটু উঠল সে। ফটফটে সাদা ফেনায় আলতো ভাবে ভেসে উঠল তার বাদামী দুটি স্তন। সে মুগ্ধ হল। আহা,‌ অগুস্ত র‌্যনোয়ারের মডেল যদি সে হত?‌
মোবাইল কানে নিয়ে বলল, ‘‌আমাকে ফোন করতে তোমায় বারণ করেছি তো। বসন্ত সাহা আমার ফোন ট্যাপ করেছে।’
———
এই উপন্যাসের সব পর্ব একসঙ্গে পাওয়া যাবে এই লিংকে

Anabrito
Advertisment