৭
‘কেমিক্যালগুলো আলামরিতে রাখা হয়েছে?’
‘ইয়েস ম্যাডাম। আমি নিজে দেখে নিয়েছি।’
‘ডি. স্ট্র্যামোনিয়াম?’
‘ঠিক মতো আছে ম্যাডাম। লক করে রেখেছি।’
‘ওপিয়াম?’
‘ঠিক আছে।’
‘সাবধানে রাখবে। আগেরবারের মতো ঘটনা যেন না ঘটে। তুমি তো জানো ওগুলো কী ভংয়কর। সেই ঘটনার যেন রিপিট না হয়।’
‘হবে না ম্যাডাম।’
হৈমন্তী ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মোবাইলে কথা বলছে। কথা বলছে পূরবী রাউতের সঙ্গে। পূরবী তার ল্যাবরেটরির প্রধান দুই অ্যাসিসট্যান্টের একজন। হৈমন্তী এই মেয়েটিকে যেমন পছন্দ করে, তেমন বিশ্বাস করে। কাজও জানে। ইউনিভার্সিটি থেকে ভাল রেজাল্ট করে এসেছে। যে কোনো সময় টিচিং প্রফেশনে চলে যাবে। ভাল সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে।
হৈমন্তীরও এক সময়ে ইচ্ছে ছিল বাইরে গিয়ে গবেষণা করবে, শিক্ষক হবে। সেই ভাবে তৈরিও হচ্ছিল। জিআরই, টয়েফেল দিয়ে আমেরিকার কোনো ইউনিভার্সিটিতে অ্যাপ্লাই করবে। প্রস্তুতি চলবার মাঝখানে বাবা–মা পর পর মারা গেলেন। একটা বিপর্যয় নেমে এলো। মানসিক বিপর্যয়। দ্রুত কিছু একটার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিতে চাইল হৈমন্তী। কাজ খুঁজে নিল। সেই যে একবার প্রফেশনাল জীবনে ঢুকে পড়ল তারপর আর বেরোনো হয়নি। এসবের মাঝখানে জোর ধাক্কা দিয়ে গেল ঐন্দ্রিল। সেই ক্ষত সামলাতে সামলাতে আবার প্রেমে পড়ল। মাঝেমধ্যে হৈমন্তীর মনে হয় সে আসলেই প্রেমের কাঙাল। তার রূপ এবং গুণে মুগ্ধ হওয়ার মতো পুরুষের কোনো অভাব ছিল না। কিশোরীবয়স থেকেই তাকে নিয়ে ছেলেদের মধ্যে উন্মাদনা ছিল। ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে করেনি। কিন্ত পরে যতবার কারও দিকে তাকাতে চেয়েছে আঘাত পেয়েছে। একেই কি নিয়তি বলে? আর পাঁচজন স্বাভাবিক মেয়ের মতো ঘর সংসার করবার ইচ্ছেকে গোপনে মনের ভিতর লালন করেছে। তাকে সত্যি করতে পারেনি। নিজের কেরিয়ারে যতটা উন্নতি করেছে, ব্যক্তি জীবনে ততটাই ব্যর্থ, নিঃস্ব। নিসঙ্গতা ঘিরে ধরে। ক্লান্ত, বিষণ্ণ লাগে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যেমন মন কাঁদে, কোনো কোনো সময় প্রবল রাগে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে বিছানা। দু’হাতে কপালের রগ টিপে ধরে ইচ্ছে করে, যারা ঠকিয়েছে তাদের খুঁজে বের নিজের হাতে গলা টিপে খুন করে। তবেই শান্তি। উন্মাদের মতো লাগে। ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করে। ‘ক্রোধে উন্মত্ত হৈমন্তী’কে সে বোঝায়।
‘এই পাগলামি তোমাকে মানায় না। তোমার বয়স হয়েছে হৈমন্তী। নিজের ব্যক্তিজীবনকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নাও। তোমার কীসের অভাব? টাকা –পয়সা, কেরিয়ার, শখ আহ্লাদ সবই তো তুমি পেয়েছো। কর্মক্ষেত্রে তুমি যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছো। পুরুষ শরীর পেতে ইচ্ছে করলে তাও পেতে পারো। এর জন্য সংসার করার কী প্রয়োজন? কতো মেয়েই তো জীবন একা কাটায়। তারা তো সুখেই থাকে। অতীত আঁকড়ে এই দুঃখ বিলাসিতা তোমাকে মানায়।’
মানু্ষের সমস্যা হল, মন যেমন যুক্তির কাছে বশ্যতা মানে, তেমনই আবার মানেও না। হৈমন্তী ব্যতিক্রম নয়। সারাদিন কাজের পর কোনো কোনোদিন তার কান্না পায়, কোনো কোনোদিন রাগে ফুঁসতে থাকে। জোয়ার ভাঁটার মতো। জল চলে যায়, আবার ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তীরে।
হৈমন্তী পূরবীর সঙ্গে কথা বলেছে মোবাইলে প্লাগ লাগিয়ে।
‘পূরবী, মনে রাখবে, আমরা এমন সব কেমিক্য লস্ নিয়ে কাজ করি যেগুলো ভংয়কর। আমি যে কদিন ল্যাবরেটিরতে যাচ্ছি না, তুমি দায়িত্ব নিয়ে এগুলো লক করবে। লিস্ট মিলিয়ে রাখবে।’
‘জানি ম্যাডাম। সেবারের ঘটনাটা অ্যাক্সিডেন্টাল।’
হৈমন্তী তার একটা জামায় হালকা আয়রন বোলাচ্ছে। বলল, ‘আমি জানি, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাক্সিডেন্ট, তবে তারপর থেকে আমাদের অ্যালার্ট থাকতে হবে।’
বাইরে থেকে শুনলে মনে হবে, সামান্য একটা কেমিক্যাল নিয়ে হৈমন্তীর মতো অভিজ্ঞ কেমিস্ট কি একটু বেশি উদ্বিগ্ন হচ্ছে না? এতবার অ্যাসিসটেন্টের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলবার দরকার কী? পূরবী একজন সিনসিয়ার কর্মী। একবার বললেই হয়। হৈমন্তী সম্ভবত, বেশি চিন্তা করছে। আবার এমনটাও হতে পারে, গতমাসের ঘটনাটার কারণেই এই উদ্বেগ। ঘটনাটা উদ্বেগের ছিল। কিছু হয়নি, কিন্তু হলে মুশকিল হতো।
ঘটনাটা ছিল এরকম—
বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গাছের এক্সট্র্যাক্ট নিয়ে হৈমন্তীদের লেবরেটরিতে কাজ হয়। এদের মধ্যে বেশিরভাগই অতিরিক্ত মাত্রায় কনসেন্ট্রেটেড্। এত ঘন যে কয়েক ফোঁটা নিলেই কাজ চলে যায়। এদের মধ্যে কিছু রস ভয়ংকর বিষাক্ত। মানুষকে মেরে ফেলতে বেশি সময় নেয় না। আবার এসবের মধ্যেই রয়েছে নানা রোগের প্রতিষেধক। বিষ বাদ দিয়ে গাছের রোগ প্রতিষেধক গুণ বের করে কাজ করতে হয় হৈমন্তীদের। কোন গুণ সাবানে যেতে পারে, কোনটা যেতে পারে তেলে, কোনটা ইচ্ছে করলে ক্রিমে মেশানো যায় তাই নিয়ে রিপোর্ট তৈরি হয়। এই সব এক্সট্র্যাক্ট আসে বাইরে থেকে। অর্ডার দিলেই হয় না। স্পেশাল রিকুইজিশন লাগে। সঙ্গে ল্যাবরেটরির লাইসেন্সের কপি দিতে হয়। কী ধরনের গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হবে জানাতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই নানা ধরনের কনসেন্ট্রেটেড্ এক্সট্র্যাক্টের শিশিতে ল্যাবরেটরি ভর্তি। একের পর এক তালা দেওয়া আলমারি। এসবের জন্য অতিরিক্ত সতর্কতা রাখা হয়। দাম অনেক। চুরি করে কেউ বাইরে বেচে দিলে তিনগুণ বেশি দাম পাবে। তারপর ভয়ংকর সব বিষ। এসবের মূল দায়িত্ব ল্যাবরেটরির হেডের। সে না থাকলে দায়িত্ব অন্য কারওকে বুঝিয়ে দিতে হয়। এবার যেমন হৈমন্তী পূরবীকে বুঝিয়ে দিয়েছে। সে যতক্ষণ না কলকাতা থেকে ফিরে জয়েন করছে ততক্ষণ পূরবী বুঝবে। এর আগেও বুঝেছে। এবারে হৈমন্তীর এই বাড়াবাড়ি চিন্তার কারণ গতমাসে পরপর দুদিনে দু–দুটো শিশি নিখোঁজ হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ করবার পর লগ বুক মেলাতে গিয়ে ধরা পড়ে। প্রথমে পাওয়া যায় না ডি. স্ট্র্যামোনিয়া। পরের দিন হারায় ওপিয়ামের শিশি।
খুব টেনশনে কেটেছিল হৈমন্তীর। কাউকে বলতে পারেনি। জানত শুধু পূরবী। হৈমন্তী ঠিক করেছিল, সে আর পূরবী মিলে দুটো দিন চুপচাপ খোঁজার পর সবাইকে জানানো হবে। নইলে বিচ্ছিরি একটা আতঙ্ক তৈরি হবে। কোম্পানির ওপরমহল জানলে থানা পুলিশ পর্যন্ত করতে হতে পারে। তিনদিনের মাথায় খোঁজ পাওয়া যায়। আলমারি বদল হয়ে গেছে। তারপর থেকেই হৈমন্তী বেশি সতর্ক হয়েছে। প্রতিদিন কাজ শেষ হলে আলমারি ধরে ধরে খাতা মেলানো হয়।
হৈমন্তী আয়রন করা জামা ব্যাগে ঢোকাল।
‘পূরবী দুটো রিপোর্টে পাঠানোর আছে। দুটোই রেডি,ফাইনাল দেখে নেবে।’
‘দেখব ম্যাডাম।’
‘স্যাম্পেলের ব্যাচ নম্বর গুলো যেন ঠিক থাকে। ’
‘অবশ্যই।’
‘আমি কলকাতায় যাচ্ছি। পারসোনাল কাজে। খুব প্রয়োজন ছাড়া ফোন করবে না। ফোন বন্ধও থাকবে। প্রয়োজনে আমিই যোগাযোগ করব।’
পূরবী নিচু গলায় বলল, ‘হ্যাপি জার্নি ম্যাডাম।’
হৈমন্তী ফোন কেটে খুব সাবধানে ব্যাগ আটকাল। ছোটো হলেও ভিতরে কাচের শিশি রয়েছে। লাগেজে রাখলেও একটু জার্কিং তো হবে।
তুষার তার জন্য এরকম যত্ন করেই বিদেশ থেকে সেন্ট এনেছিল।
‘কত যত্ন করে এনেছি জানো?’
হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে বলেছিল, ‘কত যত্ন করে?’
তুষার গাঢ় স্বরে বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে আমার প্রেমে যেমন যত্ন। নাও কাছে এসো- নতুন সেন্টটা একটু গায়ে স্প্রে করে দিই।’
ঐন্দ্রিল চলে যাওয়ার পর এসেছিল তুষার। দ্বিতীয় প্রেম। মাঝে চার বছরের ব্যবধান। তুষারের মধ্যে কোনো শিল্প টিল্পর বালাই ছিল না। একেবারে শুকনো বিজনেসম্যান। বাড়ির বিজনেস। আলাপ হয়েছিল মুম্বাই এয়ারপোর্টে। দুজনেই দিল্লি যাচ্ছে। গোস্ট কলে ফ্লাইট লেট। কে যেন ফোনে হুমকি দিয়েছে বোম্ মেরে ফ্লাইট উড়িয়ে দেবে। হৈমন্তী বই খুলে লাউঞ্জে বসে গিয়েছিল। পাশে লম্বা চওড়া ছেলেটিকে খেয়াল করেনি। একসময়ে উঠেও যায়। খানিক পরে হন্তদন্ত হয়ে এসে বলে,‘এক্সকিউজ মি, আমার মোবাইল ফোনটা কি আপনি দেখেছেন?’
হৈমন্তী বিরক্ত হয়ে বলে বই থেকে মুখ সরিয়েছিল।
‘না।’
ছেলেটি অধীর হয়ে বলে, ‘কিন্তু আমি তো আপনার পাশের চেয়ারেই রেখেছিলাম।’
হৈমন্তী এবার বিরক্ত গলায় বলল, ‘রাখতে পারেন, আমি দেখিনি।’
‘সেকী! আপনি দেখেননি!’
হৈমন্তী এবার সোজা হয়ে বসে কড়া গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? আপনার ফেলে যাওয়া ফোন পাহারা দেওয়া কি আমার কাজ ছিল?’
সুন্দরী মেয়ের ধমকে গা না করে ছেলেটি বলল, ‘আপনার পাশে কি কেউ এসে বসেছিল?’
হৈমন্তী আরও কড়া বলল, ‘দেখিনি।’
ছেলেটি এবার অতি বিরক্ত গলায় বলল, ‘আপনি তো কিছুই দেখননি দেখছি! আমার তো সন্দেহ হচ্ছে। দেখেও না দেখার ভান...ওই ফোনে আমার এভরিথিং রয়েছে। ইস্ কী হবে?’
এতো বড় একটা ছেলেকে এই ভাবে বিচলিত হতে দেখে হৈমন্তী এবার রাগ ভুলে মজাই পেল। বলল, ‘সিকিওরিটি কাছে গিয়ে কমপ্লেন করুন। কেউ নিলে সিসিটিভিতে ধরা পড়বে। আমিও যদি নিই দেখা যাবে।’
ছেলেটি এবার উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘এটা ঠিক বলেছেন।’
সে সিকিওরিটি অফিসের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তার কাঁধের ব্যাগে ফোন বেজে ওঠে। এক গাল হেসে ছেলেটি লাফিয়ে ওঠে।
‘ওই তো আমার ফোন! ওয়াশরুমে যাওয়ার সময়ে ব্যাগে ঢুকিয়েছিলাম, সেটাই ভুলে গিয়েছি।’ ফোন বের করতে করতে ছেলেটি বলল, ‘আমি খুবই লজ্জিত। আপনাকে এমন ভাবে বললাম।’
হৈমন্তী বলল, ‘আমি খুবই নিশ্চিন্ত যে আপনার মোবাইল চুরি করে ধরা পড়তে হল না।’
‘আমাকে ক্ষমা করবেন। মাথার ঠিক ছিল না।’
‘আচ্ছা ক্ষমা করলাম।’ বলে মুচকি হেসে হাতের বইয়ে মন দি্ল হৈমন্তী। আড়াই ঘন্টা পর প্লেনে উঠলে হৈমন্তী দেখতে পেল সেই ছেলের সিট তার পাশে পড়েছে। হৈমন্তী মুচকি হেসে বলল, ‘নিজের জিনিস সাবধানে রাখবেন।’
ছেলেটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
এই ছেলেটিই তুষার। আলাপ এবং প্রেমের আটমাসের মধ্যে সে জানায়, বাড়িতে থেকে বিয়ের চাপ দিচ্ছে।
হৈমন্তী বলল, ‘আমার কথা বলেছো?’
তুষার আমতা আমতা করে বলে, ‘চাকরি করা বউ আমাদের বাড়িতে অ্যালাও কর হয় না। আমার দুই দাদাও...তুমি চাকরিটা ছেড়ে দাও হৈমন্তী...বাড়ির অমতে আমি যাইনি কখনও।’
হৈমন্তী শরীর কেঁপে ওঠে। সে একটু চুপ করে থেকে বলে, ‘তোমাকে জানাব।’
তুষারের সঙ্গে সেটাই ছিল হৈমন্তীর শেষ কথা। আর কোনোদিন তার ফোন ধরেনি। প্রতিজ্ঞা করেছিল, অনেক হয়েছে, আর পুরুষমানুষ নয়। তখনও কি সে জানত আবার পুরুষমানুষের কাছে নিজেকে সমর্পণ করবে? আবার অনাবৃত হবে? তবে এবার নিজেকে অন্যভাবে তৈরি করেছে। আর প্রতারিত হবে না। এবার অন্য খেলা।
সেই খেলা ভয়ংকর। সেই খেলা মৃত্যুর।
—————
পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্বগুলি
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস: অনাবৃত (পর্ব ৬)
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস: অনাবৃত (পর্ব ৫)
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ৪)
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস অনাবৃত (পর্ব ৩)
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস: অনাবৃত (দ্বিতীয় পর্ব)
প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক উপন্যাস: অনাবৃত (পর্ব ১)