Advertisment

অনাবৃত (২): দুজন নগ্ন হৈমন্তী মুখোমুখি

শুরু হয়েছে প্রচেত গুপ্তের ধারাবাহিক গোয়েন্দা উপন্যাস। প্রতি সপ্তাহের শনি ও রবিবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হতে থাকবে এই ধারাবাহিক। প্রতি পর্বের সঙ্গেই দেওয়া থাকবে আগের পর্বের লিংক। পড়তে থাকুন।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Pracheta Gupta, Anabrito part 2

অলংকরণ- অরিত্র দে


স্নান করতে করতে হৈমন্তী গুনগুন করে গান করছে-
‘‌ফর দ্য আদার হাফ অফ দ্য স্কাই
উওম্যান আই ক্যান হার্ডলি এক্সপ্রেস.‌.‌.‌।’‌

Advertisment

জন লেননের বিখ্যাত গান‌। গানের নাম ‘‌উওম্যান’‌। এ গান হৈমন্তীর প্রিয়। প্রিয় হবার কারণ গানের চমৎকার কথা বা মেলোডি নয়। এমনকী লেননের দুর্দান্ত কণ্ঠস্বরও নয়। প্রিয় হবার কারণ, ছোটো একটা স্মৃতি। হৈমন্তীর কলেজ জীবনের ঘটনা। তখন থার্ড ইয়ার চলছে। কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। বিশেষ করে ল্যাবরেটরি ওয়ার্ক। র‌্যাডিকাল ডিটেকশন, গ্রুপ অ্যানালিসিস করতে খাটুনির চোটে হাড়ে কার্বন জমে যাচ্ছে। কোন এক কবি বলেছিলেন, সুন্দর মেয়েদের বার্নারে হাত পুড়িয়ে কেমিস্ট্রি পড়বার কোনো মানে হয় না। তারা পড়বে সাহিত্য। জীবনানন্দ বা শেলির কবিতা নিয়ে থাকবে। ভাসা ভাসা চোখে তাকাবে। কলেজে ফাংশন থাকলে চওড়া পাড়ের শাড়ি পরে, খোঁপায় ফুল লাগিয়ে আসবে। সেই ফুল পড়ে গেলে, আঁচল সামলে ফুল কুড়িয়ে নেবে। মজার বিষয়, সেবার হৈমন্তীদের কেমিস্ট্রি ব্যাচে এগারো জন মেয়ে ছিল। এগারোজনই ছিল কমবেশি সুন্দরী। কবির কথাকে ‘‌ফুঃ’‌ মেরে উড়িয়ে অতি উৎসাহে তারা কেমিস্ট্রি পড়ত। ল্যাবরেটরির দিন হাত পোড়ানো বা ছ্যাঁকা খাওয়ার ঘটনা তাদের কাছে কোনো ব্যাপারই ছিল না। কলেজে এদের বলা হত ‘‌কেমিকাল বিউটি গ্রুপ’‌। সব ডিপার্টমেন্টের ছেলেরাই কম বেশি ছুঁক ছুঁক করত। যদি প্রেম করা যায়। এই নিয়ে ‌কেমিকাল বিউটি‌ গ্রুপে হাসাহাসি হত।

বহ্নিশিখা হয়তো বলল, "প্রেম নিবেদন করলেই ‌হাতে টেস্ট টিউব ধরিয়ে দেব। বলব, যতক্ষণ না হাইড্রোজেনের সঙ্গে সোডিয়াম ক্লোরাইড মিশছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাক সোনা। আজ তোমার প্রেমের পরীক্ষা। তুমি হবে আমার হাইড্রোক্লোরিক ভালোবাসা।"

অত্রিনা তাই শুনে যোগ করল, "আমি তো স্মেলিং সল্ট দিয়ে নিয়ে যাব। গোলাপ দিলে, আমি দেব স্মেলিং সল্ট।"

আফরিন বলত, "আমার প্রেমপত্রে শুধু নাইট্রোজেন বন্ডিং-এর টেবিল থাকবে। প্রেম করতে আসবার আগে টেবল্‌ মুখস্থ করে আসতে হবে।"

তারপর সবাই মিলে হাসত।

একদিন ল্যাবরেটরি সন্ধে গড়িয়ে শেষ হল। ফাইনাল পরীক্ষা এসে যাচ্ছে, চাপ তো থাকবে। তাড়াহুড়ো করে বেরোল হৈমন্তী। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গেট থেকে বেরোতেই একটা ছেলে কলেজের অন্ধকারে থেকে বেরিয়ে এল ভুস্‌ করে। ভেসে উঠল যেন। নিশ্চয় আড়ালে আবডালে কোথাও অপেক্ষা করছিল। হাতে ভাঁজ করা একটা কাগজ। সেই কাগজ ধরিয়ে একরকম ছুটই দিল ছেলেটা। মুখটাও দেখা গেল না। প্রথমে ভেবেছিল, ছেঁদো প্রেমপত্র। আর পাঁচটা যেমন হয় - ‘‌তোমার রূপে আমি পাগল হয়েছি।’ তখন তো এভাবে মোবাইল ছিল না, হাতে লেখা চিঠিই ভরসা। গাড়িতে উঠে ভেবেছিলে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেবে। তারপরেও একবার আলো জ্বেলে খুলে পড়তে যায়। পড়তে নয়, দেখতে যায় বলাই ভাল। প্রেমের প্রস্তাব হেলাফেলা করলে, কোনো মেয়ের পক্ষে প্রেমপত্রকে অবজ্ঞা করা অসম্ভব। সে যতই সুন্দরী, বড়লোক বা ডাঁটিয়াল হোক না কেন।

ধারাবাহিক এই উপন্যাসটির প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে

হৈমন্তী অচেনা চিঠির এক লাইন, দু’‌লাইন, তিন লাইন করে যত এগোতে থাকে তত অবাক হতে থাকে। মুগ্ধ হয়। চিঠিটা বেশ বড়। নোটসের মতো। হাতের লেখা খারাপ। বানানেও গোলমাল রয়েছে।

‘‌আমি তোমাদের কলেজেই পড়ি। ফার্স্ট ইয়ারে। কোন সাবজেক্ট বলব না। তবে সায়েন্স সাবজেক্টে আমি খুব কাঁচা। কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, ম্যাথের কথা শুনলে আমার পেটের মধ্যে হাত পা ঢুকে যায়। যারা এসব নিয়ে লেখাপড়া করে তাদের মুখের দিকে তাকতেও ভয় করে। মেয়ে হলে তো কথাই নেই। মেয়েদের যখন খুব বুদ্ধি হয় তখন তারা এই সব কঠিন সাবজেক্ট পড়ে। তাদের দিকে আমি ফিরেও তাকাই না। হঠাৎই একদিন ক্যান্টিনে তোমাকে দেখে মাথা ঘুরে গেল। কী দেখতে রে বাবা!‌ আমি বসেছিলাম তোমার ঠিক উলটো দিকে। একবার মুখ তুলে তাকালে। একটু হাসলে যেন। নাকি হাসো নি? তাই হবে। আমি কে?‌ একটা এলেবেলে। আমার দিকে তোমার মতো রূপবতী, বুদ্ধিমতী একজন তাকিয়ে হাসবে। কে জানে, সুন্দরীদের মুখ বোধহয় সবসময়েই হাসি হাসি হয়।‌ যাই হোক, তোমার চোখ দেখে আমার বুক ধড়াস্‌ করে উঠল। এত সুন্দর কিছু আমি দেখিনি কখনও। যারা বলে, তোমাদের ব্যাচে হৈমন্তীদি সবথেকে সুন্দর, তারা ভুল বলে। ওরকম সুন্দর অনেক রয়েছে। সে হল আর পাঁচজনের মতো সুন্দরী। তুমি কারও মতো নও, সব থেকে সুন্দর। গানের মতো সুন্দর। খুব কম মানুষই গানের মতো সুন্দর হতে পারে। সেদিন তোমাকে দেখে জন লেননের গানটা খুব মনে পড়ে গেল। উওম্যান গানটা। ‌ফর দ্য আদার হাফ অফ দ্য স্কাই, উওম্যান আই ক্যান হার্ডলি এক্সপ্রেস.‌.‌.‌। জীবনে তুমি আমার ইনস্পিরেশন হয়ে রইলে। যখনই কোনও দুঃখ হবে, আনন্দ হবে, চোখ বুজে.‌.‌.‌না, তোমার কথা ভাবব না। গানটার কথা ভাবব। একটাই রিকোয়েস্ট, হৈমন্তীদিকে এসব কথা বলবে না। দুঃখ পাবে। ভাল থেকো। চিঠি দিয়ে তোমাকে আর কখনও বিরক্ত করব না।’‌

এই ছেলেকে হৈমন্তী খুঁজে পায়নি। পাওয়ার কথাও নয়। ‘‌দিদি’ সম্বোধন করছে যখন, নিচের ক্লাসের কেউ হবে। এত বড় কলেজে ফার্স্ট বা সেকেন্ড ইয়ারে তো কম ছেলে পড়ে না। সেই আশা ত্যাগ করে হৈমন্তী। ছেলেটিকে তাও যেমন জানা যায়নি, চিঠিটা কাকে লিখেছিল জানা যায়নি সেকথাও। কিন্তু গানটা রয়ে গেছে। এটাই অদ্ভুত। হৈমন্তী মাঝেমধ্যে বাজিয়ে শোনে। নিজেও গুনগুন করে। মনে পড়ে যায় অনেক কিছু। আজও পড়ছে।

ইন্দ্রকে যখন গল্পটা বলেছিল সে খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনেছিল।

হৈমন্তী বলেছিল, "তুমি গানটা শুনেছ?‌"

ইন্দ্র কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, "যা ব্বাবা, শুনব না?‌ আমি একজন ফিল্মমেকার, আমি লেনন শুনব না?‌‌ তুমি কী যে বল হিমি। আমি একসময়ে এলভিস, মারিয়া কারের গান না শুনে রাতে ঘুমোতে যেতাম না।‌"

‌ইন্দ্র হৈমন্তীকে ‘‌হিমি’ ডাকত। হৈমন্তীর প্রথম প্রেম। তখন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে মাস্টারস্‌ করছে হৈমন্তী। ইন্দ্রর সঙ্গে আলাপ কফি হাউসে। সাতাশ আঠাশ বছর বয়েস। টিপিক্যাল কফিহাউস মার্কা জিনস্‌ আর পাঞ্জাবি। এক মুখ দাড়ি গোঁফ। কিন্তু চোখদুটো একেবারে বালকের মতো সরল। এই সরল চোখের প্রেমে পড়ে গেল হৈমন্তী। আসলে হৈমন্তী প্রেম বিষয়টাকে অপছন্দ করত খুব। কিশোরীবেলা থেকে প্রেমের প্রস্তাব শুনে শুনে পাগল হয়ে গিয়েছিল। লেখাপড়ায় অতিরিক্ত ভাল হওয়ায় নাক উঁচু ছিল। সে মনে করত, সুন্দর হওয়া একটা গুণ অবশ্যই, তবে বুদ্ধি বা মেধা কম কিছু নয়। পুরুষমানুষ সুন্দর নারীতে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে যে বুদ্ধি বা মেধার কথা ভুলে যায়। ইন্দ্রর সঙ্গে প্রথম আলাপে ঠিক উলটো অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ঘটনা মজার ছিল।
সেদিন প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়েছিল হৈমন্তী। প্রফেসর ভৌমিকের সঙ্গে দেখা করবে। অর্গানিক কেমিস্ট্রিতে ভদ্রলোকের খুব নামডাক ছিল। ওঁর কাছে যদি একটু পড়া যায়। বেশি নয়, সপ্তাহে একদিন রাজি হলেই চলবে। সঙ্গে রাখীও ছিল। রাখী ব্যাচমেট। যদিও সে কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ছিল না, তার সাবজেক্ট ফিজিক্স। প্রফেসর ভৌমিককে কলেজে পাওয়া গেল না। তিনি অসুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন।

রাখী বলল, "চল, কফিহাউসে চিকেন কাটলেট খেয়ে যাই।"

সেই সময় কফিহাউসের চিকেন কাটলেটের খুব সুনাম ছিল। এখনও রয়েছে। হৈমন্তী তারপরেও বলেছিল, "না রে, ভাজাভুজি খাব না।"

রাখী বলল, "চল তো। এ বয়সে এতো হেলথ কনশাস্‌ হোস না। সময় তো রয়েছে। তাছাড়া তুই এমনিতেই খুব সুন্দরী। স্কিন টোন দেখলে হিংসে হয়।"

হৈমন্তী বান্ধবীর কাঁধে চড় মেরে বলল, "আচ্ছা অনেক রূপের প্রশংসা হয়েছে। এবার থাম। চল কটা চিকেন কাটলেট খেতে হবে?‌"

কফি হাউসের তিনতলাটা একটু নিরিবিলি। যারা মূলত খেতে আসে, তারা তিনতলাতেই বসে। অনেকদিন ধরেই এই নিয়ম। হৈমন্তীরাও বসেছিল। খাবার বলার পর হঠাৎই এক যুবককে দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে রাখী হইহই করে উঠেছিল।

"ইন্দ্রদা, ও ইন্দ্রদা।"

ছেলেটি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফাঁকা টেবিল খুঁ‌জছিল। ডাক শুনে এগিয়ে এল।

"রাখী,  তুই!‌"

রাখী হেসে বলল, "কেন, আমি আসতে পারি না?‌ কফিহাউস কি শুধু তোমার মতো ইনটেলেকচ্যুয়ালদের জন্য?‌"

যুবকটি বলে, "তা কেন হবে?‌ বোকারাও এখানে অ্যালাউড। নইলে তোকে ঢুকতে দিত!"

রাখী বলল, "বেশ ভালো, বোকা তো বোকা। দাঁড়িয়ে আছ কেন?‌ বসো না।"

হৈমন্তীর রাখীর ওপর রাগ হল। যতই ‘‌দাদা’‌ বলে ডাকুক, তার কাছে তো অপরিচিত। একজন অপরিচিতকে দুম করে টেবিলে বসতে বলছে কেন রাখী?‌ তাছাড়া ছেলেগুলো বড্ড হ্যাংলা হয়। রূপবতী মেয়ে দেখলে আদিখ্যেতার চরম করে। জিব দিয়ে লালা গড়ায়। এই ছেলেও নিশ্চয় তাই হবে, একবার বসলে উঠতে চাইবে না।

যুবক না বসেই হৈমন্তীর দিকে খেয়াল করল। রাখী হৈমন্তীকে বলল, ‘‌আমার মামাতো দাদা ঐন্দ্রিল রায়। এসআরএফটিআই থেকে পাস করেছে। ডকুমেন্টরি বানায়। অলরেডি দুটো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়ে বসে আছে। দূর সম্পর্কের রিলেশন বলে, নাম হওয়ার পর আমাকে পাত্তা দেয় না।" তারপর যুবকের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, "মিট মাই ফ্রেন্ড হৈমন্তী। শুধু দেখতেই মারাকাটরি নয়, লেখাপড়াতেও মারকাটারি। নাও বসো।"

যুবকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, "সরি রাখী, ডবল মারকাটারির মধ্যে বসতে পারব না। তাছাড়া সুন্দরীদের আমি আজকাল অ্যাভয়েড করে চলি। দুটো কথার পরই বলে, ফিল্মে চান্স দিন। তারা বুঝতে চায় না, আমি কোনো ফিল্ম ডিরেক্টর নই।"
কানমাথা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল হৈমন্তীর। সে দাঁত চেপে বলল, "আপনি কি সুন্দরীদের ওপর ডকুমেন্টরি বানান?‌ তাদের স্বভাব সম্পর্কে এতো জানলেন কী করে?‌"

ঐন্দ্রিল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, "রাগ করলেন বলে দুঃখিত, বাট এটাই রিয়েলিটি। সুন্দরীরা ফিল্ম লাইনে পা রাখবার জন্য ছটফট করে।"

হৈমন্তী বলল, "একেবারেই নয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, যারা ফিচার ফিল্ম বানাতে না পেরে ডকু নিয়ে পড়ে থাকে তাদের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স বেশি হয়। ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স কী জানেন নিশ্চয়। হীনমন্যতা। হীনমন্যতার কারণ এদের জ্ঞানও বেশি হয়। গাধা, গরুর ওপর ডকুমেন্টারি তৈরি করতে হয় তো তাই তাদের ওপর জ্ঞান। আপনার বিষয় কী?‌"

ঐন্দ্রিল হেসে বলল, "ঠিকই বলেছেন। চার্লস ফার্গুসন, অ্যালেক্স গিডনে, জেনা ব্রিসকের মতো দুনিয়া কাঁপানো সব ডকু মেকার গাধা গরু ছিলেন।"

রাখী হাত বাড়িয়ে বান্ধবীকে শান্ত হতে বলল। "আলাপ না করেই ঝগড়া শুরু করলি?‌"

হৈমন্তী সেই হাত সরিয়ে বলল, "সরি, এঁদের সঙ্গে নিজের তুলনা করাটাও একধরনের হীনমন্যতা। যাক, আপনার ডকুমেন্টারির বিষয়টা বললেন না তো।"

ঐন্দ্রিল একটু চুপ করে থেকে হাসল। বলল, "পুরোনোগুলো নিয়ে আর বলছি না। আগামী বিষয় বরং বলি, বোকা সুন্দরী এবং বুদ্ধিমতী রাগ। যাই, ওদিকের টেবিল খালি হয়েছে।"

এই ছেলের সঙ্গে যখন হৈমন্তীর প্রেম গভীর হলো, তখন সবথেকে বেশি অবাক হয়েছিল হৈমন্তী নিজে। রাখী চোখ নাচিয়ে বলেছিল, "সেদিনই বুঝেছিলাম একটা কিছু হবে। আমার ঠাকুমার কাছে প্রবাদ শুনেছিলাম, যে যায় বিবাদে/‌ তার মন আগে কাঁদে।"

হৈমন্তী বলেছিল, "ধ্যুস। কোনো কাঁদে টাঁদে না। বাট আই কুড নট রেজিস্ট।"

‌রাখী ঘাড় দুলিয়ে বলল, "বাপু হে, প্রেম এমনই। তাকে রেজিস্ট করা যায় না। আরও আসবে, তাকেও রেজিস্ট করা যাবে না।"

হৈমন্তী বলেছিল, "কী আসবে?"

রাখী হৈমন্তীকে ইশারায় শরীর দেখিয়ে চোখ টেপে।

হৈমন্তী যেদিন প্রথম ঐন্দ্রিলের সঙ্গে শরীরের ভালবাসায় গেল, সেদিন ছিল একটা ভরা বর্ষার দুপুর। ঐন্দ্রিলই হৈমন্তীকে নিয়ে গিয়েছিল। সল্টলেকে তিনতলার ওপর ফ্ল্যাট। খাট টাট কিছু ছিল না। মাটিতে মাদুর পাততে পাততে ঐন্দ্রিল বলেছিল, "ভাবছি ফ্ল্যাটটা এরকমই রাখব।  নো ফার্নিচার। কেমন হবে?‌"

হৈমন্তী বলল, "খুব খারাপ।"

ঐন্দ্রিল হৈমন্তীকে কাছে টেনে বলল, "কেন?"

"আমি মেঝেতে শুয়ে আদর করতে পারব না।"

ঐন্দ্রিল হৈমন্তী জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, "খুব পারবে। মাটিতে আদর অনেক বেশি রাস্‌টিক, ন্যাচারাল।"

রাস্‌টিক, ন্যাচারাল আদরের জন্য ‌ঐন্দ্রিল এই ফ্ল্যাটে বহু মেয়েকে আনে, সেটা জানতে জানতে আরও একটা বছর লেগে গিয়েছিল। ততক্ষণে রেজিস্ট্রি করে তাদের বিয়ে হয়ে হয়ে গেছে। ‌ঐন্দ্রিলের ফিচার ফিল্মের জন্য দুটো গলার হার, একটা বালা বিক্রি করা হয়ে গেছে। ওই প্রথম পুরুষ মানুষের কাছে ধাক্কা খেল হৈমন্তী। বড় ধাক্কা।

হৈমন্তী শাওয়ার কিউবিকেল ডোর খুলে তোয়ালে টেনে নিল। চুল এবং শরীরের জল ঝরিয়ে তোয়ালেটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। তার ফ্ল্যাট সতেরো তলায়। ঘরগুলো ভারি পর্দা দিয়ে ঢাকা। ভোরবেলা ছাড়া জানলা খোলা হয় না। ফলে দেখবার কেউ নেই। তোয়ালেটা গা থেকে খুলে চেয়ারের ওপর ছুড়ে দিল। আলমারির সামনে এসে দাঁড়াল। এখন দুজন হৈমন্তী। দুজনেই নগ্ন। দুজনেই দুজনের গলা, স্তন, নাভি, উরু স্পট দেখতে পাচ্ছে। কোনো আড়াল আবডাল নেই।

বাইরের হৈমন্তী  ফিসফিস করে বলল, "কেমন আছ হৈমন্তী?"

আয়নার হৈমন্তী বলল, "ভালো নয়।"

বাইরের হৈমন্তী বলল, "কেন ভালো নেই? কী সুন্দর দেখতে তুমি! কত ভাল কেরিয়ার তোমার!‌‌ পুরুষেরা তোমাকে দেখে মুগ্ধ।‌ তুমি কেন ক্লান্ত হবে?"

আয়নার হৈমন্তী বলল, "এসব অসহ্য লাগে। বারবার ঠকতে ঠকতে আমি ক্লান্ত, হৈমন্তী।"

বাইরের হৈমন্তী বলল, "চিন্তা কোরো না, তুমি যাতে ভালো থাকো তার ব্যবস্থা করেছি।"

আয়নার হৈমন্তী বলল,‌ "কী ব্যবস্থা?‌"

বাইরের হৈমন্তী সামান্য হেসে বলল, "বলব না।"

আয়নার হৈমন্তী বলল, "প্লিজ বলো।"

বাইরের হৈমন্তী বলল, "আচ্ছা, শোনো।"

খাটের ওপর পড়ে থাকা মোবাইল বেজে উঠল। হৈমন্তী এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরল।

"বলো।"

চাপা গলায় পুরুষকণ্ঠ বলল, "সব ঠিক আছে?‌"

হৈমন্তী একটু চুপ করে থেকে বলল, "আছে।"

পুরুষকন্ঠ বলল, "এই কদিন আমি তোমাকে ফোন করব না।"

হৈমন্তী আবার একটু চুপ করে থেকে বলল, "ভয়?‌"

পুরুষকন্ঠ বলল, "না, সাবধান হতে। সাবধান না হলে, শুধু আমার একার নয়, তোমারও অসুবিধে। আমি ছাড়ছি।"

হৈমন্তী ফোন রাখতে না রাখতে ডোরবেল বেজে উঠল।

(চলবে)

Anabrito
Advertisment