"উফ্, কী মারাত্মক সুন্দর!"
নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল হৈমন্তী।
কথাটা বলে একটু লজ্জাই পেল হৈমন্তী। রায়না শুনতে পায়নি তো? মেয়েটা যদি ভাবে নিজেকে ‘সুন্দর’ বলেছে সেটা বিশ্রী হবে। আসলে ছবিটা দেখে সে এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছে যে কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ইচ্ছে করছে রায়নাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায়। মেয়েটা এতদিন একজন গম্ভীর, অতিরিক্ত পার্সোনালিটি সম্পন্ন মহিলাকে হঠাৎ এরকম একটা হালকা আচরণ করতে দেখলে কি খুব অবাক হবে? হোক অবাক। যে অন্যকে এমন চমকে দিতে পারে, তার নিজেরও অবাক হওয়া উচিত।
হৈমন্তী ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছে না। পিছনেই রায়না দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয় সে খুবই টেনশনে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। সে এতদিন মডেল নিয়ে কাজ করেছে। তারা কেউ ছবি কেমন হবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। ডিউটি শেষ হয়ে গেলে, উঠে পড়ে কাপড় জামা পরে নেয়, পেমেন্ট গুনে নিয়ে চলে যায়। ছবির দিকে ফিরেও তাকায় না। এই ছবির বেলায় ঘটনা অন্য। রায়নাকে, এমন একটা ছবি সে দেখতে চায়, যে ছবি তার নিজের থেকে সুন্দর হবে। কথার কথা ছিল সেটা। রায়না কী করে সেই কাজটা করে ফেলল! সে যতই সুন্দর হোক, এত সুন্দর কিছুতেই নয়। মেয়েটা ছবিতে কিছু একটা ম্যাজিক করেছে। সেই কারণেই এমন লাগছে। ম্যাজিকটা কী?
হৈমন্তী আবার ছবিতে মন দিল।
ছবিতে ডিভানের ওপর আধশোয়া হয়ে রয়েছে যে নগ্ন মেয়েটি, সে মায়াময়। তারপরেও ভঙ্গিতে একধরনের ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব। গোটা দুনিয়াকে যেন তাচ্ছিল্য করছে। বলতে চাইছে, ‘দেখো, আমি তোমাদের ভানভনিতা, মিথ্যাচারকে পোশাকের মতো ছুড়ে ফেলতে পারি। আমার নগ্নতা তোমাদের সব সভ্যতার চেয়ে খাঁটি ও পবিত্র। তোমার আমার এই ঠোঁট, গলা, বুক, পিঠ, জঙ্ঘা, যোনিকে তো ঠেকাতে পার, আমাকে পারবে না।
এই কি ছবিটা বলছে? রায়না বলতে পারবে?
সে যে সুন্দর, ছোটোবেলা থেকেই জানা আছে হৈমন্তীর। তাকে যেমন গ্রাহ্য করেনি, আবার করেওছে। তাকে যেমন যত্ন করেনি, আবার করেওছে। পুরুষমানুষের কাছে ক্রমাগত প্রশংসা শুনতে শুনতে একসময় বিরক্ত লাগত। মনে হতো, পুরুষমানুষ শুধু তার বাইরের রূপ নিয়ে ব্যস্ত। ভিতরের মানুষটাকে দেখবার ধৈর্য্য তার নেই। হয়তো তার জন্য তার রূপই দায়ী। আসল মানুষটাকে ঢেকে দিয়েছে। একমাত্র ঐন্দ্রিল এসে সেই ধারণা পালটে দিয়েছিল। সেটা যে কত বড় মিথ্যে ছিল, বুঝতে সময় লেগেছে। কথার জালে জড়িয়ে ফেলেছিল সেই মায়া চোখের যুবক।
"হিমি, তুমি তোমার সৌন্দর্যের থেকেও বেশি সুন্দর।"
"একথার মানে কী? আমি আমার থেকে বেশি সুন্দর হব কী করে?"
ঐন্দ্রিল হৈমন্তীর দুটো গালে দুটো হাত রেখে বলল, "মানে সহজ। নারীর থেকে তুমি মানুষই বেশি।"
হৈমন্তী হেসে বলেছিল, "নারী কি মানুষ নয়!"
ঐন্দ্রিল হৈমন্তীর মুখটা নিজের মুখের কাছে এগিয়ে নিতে নিতে বলল, "অবশ্যই মানুষ। তবে আমরা সেটা বুঝতে চাই না। পৃথিবী এত আধুনিক হয়েছে, নারী শিক্ষা, নারী অধিকার, নারী স্বাধীনতা এত বিস্তৃত হয়েছে, তারপরেও আমরা একথা বুঝতে চাই না হিমি। এটা কোনো ব্যক্তি বিশেষের কথা, সোসাইটির কথা নয়, পুরুষতন্ত্র বা মেল শভিনিজমের কথাও নয়, এটা সভ্যতার নানা সংকটের একটা। আমার একে খাটো করে দেখি। আজও একজন নারী একজন নারীই।"
হৈমন্তী মুখটা ঐন্দ্রিলের মুখের কাছে ঘন করে নিয়ে বলেছিল, "এটাই তো ভাল। আমি যদি নারী না হতাম, তোমার কি ভাল লাগত?"
"অবশ্যই লাগত না। তবে তার থেকে বেশি ভাল লাগে যখন অনুভব করি, তোমার মধ্যে একজন সহনশীল, অনুভূতিপ্রবণ, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ রয়েছে। সেই মানুষ নারীবেশে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে।"
হৈমন্তী ঐন্দ্রিলের গালে গাল ছুঁয়ে বলেছিল, "আমি যদি এমন না হয়ে অন্যরকম হতাম?"
ঐন্দ্রিল ফিসফিস করে বলেছিল, "তোমায় আমি দেখছিলাম বলে/ তুমি আমার পদ্মপাতা হলে / শিশিরকণার মতো শূন্যে ঘুরে/ শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে/ খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।' কার কবিতা বলতে পারো হিমি?"
হৈমন্তী চোখ বুজে বলেছিল, "না। শুকনো কেমিস্ট্রি পড়া মেয়ে। হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেনের খবর রাখি। কবিতার কথা জানব কী করে?"
ঐন্দ্রিল ঝুঁকে পড়ে হৈমন্তীর চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল, "এই কবিতার কবির নাম জীবনানন্দ দাশ। একদিন তোমাকে আমি সারারাত ধরে কবিতা শোনাব হিমি।"
"এখন শোনাও।"
"রাত জেগে না শুনলে কবিতাকে ছোঁয়া যায় না। রাতের নিস্তব্ধতায় কবিতা স্বচ্ছন্দ বোধ করে।"
এই পুরুষমানুষকে কী করে অস্বীকার করবে হৈমন্তী? দ্রুত কাছে চলে গেল সে। এত কাছে যে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। লেখাপড়ার জীবন শেষ হওয়ার আগেই ঐন্দ্রিলকে বিয়ে করবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল।
ঐন্দ্রিল ভুরু কুঁচকে বলেছিল, "বিয়ে! আমার মতো একজন ভ্যাগাবণ্ডকে বিয়ে করবে? তোমার মতো মেয়ে কতো ভাল বর পাবে। আমাকে বিয়ে করতে চাইছো কেন? হোয়াই?"
হৈমন্তী হেসে বলেছিল, "বিয়ে না করলে রাত জেগে কবিতা শুনব কী করে? ভাল বর বাড়ি গাড়ি দেবে। সুন্দরী বউকে পাশে নিয়ে চলবে। মানুষ খুঁজবে কই? আর টাকা বাড়ি গাড়ি, সে তো আমি নিজেই পারব। বাবা মায়ের এক মেয়ে। যেটুকু যা প্রপার্টি রয়েছে, সবই তো আমার। না হলেও কোনো সমস্যা ছিল না। যা লেখাপড়া শিখেছি, ওটুকু আমি নিজেই করে নেব।"
ঐন্দ্রিল চিন্তিত মুখে বলল, "বিয়েতে আপত্তি নেই, কিন্তু এখন তো একসঙ্গে থাকতে পারব না হিমি। আমাকে সময় দিতে হবে।"
হৈমন্তী বলেছিল, "আমিও পারব না। আমাকে লেখাপড়া কমপ্লিট করতে হবে না? চাকরি করতে হবে। তবু বিয়েটা সেরে রাখতে চাই। তোমার মতো পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।"
কথা শেষ করে হৈমন্তী জোরে হেসেছিল। ঐন্দ্রিল অন্যমনস্ক হয়ে বলেছিল, "নো জোকস্। আমি একটা ফিচার ফিল্ম করব বলে অনেকটা এগিয়ে পড়েছি হিমি। দুজন প্রোডিউসারের সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে। একজনকে ফাইনাল করব।"
হৈমন্তী বলেছিল, "এ তো দারুণ খবর।"
তিনমাসের মধ্যে রেজিস্ট্রি করে বসল হৈমন্তী। গোপনে করল। বাবা-মা তো দূরের কথা, এমনকি রাখীও জানল না। হৈমন্তী জানত, সবাই তাকে আটকাবে। প্রেমে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া ছেলে কারও কারও পরামর্শ শোনে এবং ঝগড়া করে, কিন্তু প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া কোনো মেয়ে বাধার মুখে পড়তে চায় না। তবে সমস্যা হলো অন্য। আলাদা থাকবার পরও, একমাসের মধ্যে, হৈমন্তী পিরিয়ডের গোলমালে পড়ল, জানতে পারল, সে কনসিভ করেছে। ভয় পাওয়ার বদলে সে অবাক হলো। এমনটা হওয়ার কথা নয়। সবরকম প্রোটেকশন নিয়েই সে ঐন্দ্রিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। নিশ্চয় কোথাও ভুল হয়েছে। ঐন্দ্রিলকে বলতে সে তো আকাশ থেকে পড়ল। রেগেও গেল।
"কী করে ঘটল?"
"অ্যাক্সিডেন্ট।"
"তোমার অ্যালার্ট থাকা উচিত ছিল হিমি।"
"এতো এক্সাইটেড হচ্ছ কেন? অ্যাক্সিডেন্ট তো হতেই পারে।"
"কী বলছ হিমি! এক্সাইটেড হব না? আমার সামনে ফিচারের কাজ।"
হৈমন্তী গম্ভীর হয়ে বলেছিল, "তুমি তোমার কাজ করবে ঐন্দ্রিল। আমি আমার প্রবলেম সামলাব। এখন এটা ভেরি ইজি। সবে কটা দিন হয়েছে।"
সমস্যা সামলানোর কয়েকদিনের মধ্যে ঐন্দ্রিল টেলিফোন করে বলল, "এখনই কিছু টাকার ব্যবস্থা করো। প্রোডিউসার প্রায় রাজি করিয়ে ফেলেছি। দুটো দৃশ্য তুলে দেখাতে হবে। এটুকু নিজের খরচেই করতে হবে। ফিল্ম লাইনে নিউ কামারদের অনেক ঝামেলা।"
হৈমন্তী বলল, "কত টাকা চাই?"
ঐন্দ্রিল বলল, "তিন লাখ।"
হৈমন্তী বলল, "ইমপসিবল্। অত টাকা কোথায় পাব?"
"বাড়িতে চাও। জামাইকে এইটুকু হেল্প করবে না? সে তো খাট পালঙ্ক কিছু চায়নি।"
হৈমন্তী বলল, "তুমি খেপেছ? বাড়িতে কিছুই জানে না। আমাদের বিয়ের কথাও নয়।"
"তোমার নিজের ব্যাঙ্কে কিছু নেই? ফিক্সড্?"
হৈমন্তী বলল, "পাগলের মতো কথা বলছ ইন্দ্র।"
ঐন্দ্রিল রাগের সঙ্গে বলল, "একজন ক্রিয়েটিভ মানুষ পাগলই হয়। বিয়ের আগে তোমার জানা উচিত ছিল।"
হৈমন্তী অবাক হয়ে বলল, "তুমি রাগছ কেন? আমার দিকটা বোঝো। আমার কোনো স্যাকরিফাইস নেই?"
"এসব আলোচনার সময় এটা নয়। আমি এই চান্স মিস করতে পারব না। বিয়ে নয়, ফেস্টিভালে আমার ছবি দেখানো হচ্ছে, এটাই আমার স্বপ্ন।"
কয়েকদিনের মধ্যে গয়না বেচে খানিকটা টাকা ঐন্দ্রিলের হাতে তুলে দিল হৈমন্তী। কাজ শুরু হওয়ার আগেই ঐন্দ্রিলের ছবির খবর কাগজে বেরলো। অভিনয়ের জন্য সে নতুন মুখ খুঁজছে। এর কিছুদিনের মধ্যেই নানা ধরনের খবর কানে পৌঁছতে লাগল হৈমন্তীর। সল্টলেকের ফ্ল্যাটে নতুন মুখের সন্ধানে নিয়মিত মেয়েদের নিয়ে যাচ্ছে ঐন্দ্রিল। শুধু তাই নয়, ঐন্দ্রিল এস আর এফটি আই বা সে ধরনের কোনো বড় প্রতিষ্ঠানে কখনও কাজ শেখে নি। ডকুমেন্টরি করে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ঘটনাটাও নাকি ঠিক নয়।
"এই সব খবর কি সত্যি?"
ঐন্দ্রিল নির্বিকার গলায় বলল, "আমাদের লাইনে গসিপ প্রয়োজন হিমি। আর সেই গসিপের জন্য কিছু সত্যি ঘটনাও তৈরি করতে হয়।"
হৈমন্তী বিস্ফারিত চোখে বলল, "তার মানে, তুমি নোংরামি করো আর মিথ্যে বলে বেড়াও!"
ঐন্দ্রিল হাই তুলে বলেছিল, "মিথ্যে না বললে তুমি আমাকে পাত্তা দিতে? যাক, এখন ওসব বলে লাভ নেই। আমার টাকা লাগবে হিমি, অনেক টাকা। তুমি একা সে টাকা দিতে পারবে না। তবে কি আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকব?"
একটু চুপ করে থেকে হৈমন্তী থমথমে গলায় বলেছিল, "কত টাকা লাগবে? আমি দেব। তার বদলে তুমি আমাকে ডিভোর্স দেবে।"
ডিভোর্স নিয়ে ঝামেলা করেনি ঐন্দ্রিল। হৈমন্তী সেই প্রথম জানল, পুরুষমানুষের বেইমানি কত সহজ অথচ কঠিন।
নগ্ন হৈমন্তীর বই পড়ার ভঙ্গিটিও বড় চমৎকার এনেছে রায়না। বইয়ের মলাটও দেখা যাচ্ছে। আর এখানেই যে কেউ ঘাবড়ে যেতে পারে।
(চলবে)