হৈমন্তী রোবের বেল্ট খুলতে খুলতে বলল, "আজই তো তোমার কাজ শেষ রায়না।"
রায়না ইতিমধ্যে ইজেল, রঙ ,তুলি সাজিয়ে ফেলেছে। ইজেলে রাখা ক্যানভাসের ওপর ঢাকা কাপড় সরিয়ে নিয়েছে। দুটো স্পট ছাড়া ঘরের আলো সব নিভিয়ে দিল। ওই স্পট থেকেই যেটুকু আলো পাওয়া যাবে। রায়না ভাল করে দেখে নিল, আলো আগের দিনের মতো। তার কাজে আলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নইলে কনটিনিউটির সমস্যা হবে। কনটিউনিটি ছবির বেলায় দরকার হয়। পোশাক, প্রপস্, আলো যেন অবিকল আগের মতো হয়। সিনেমায় তো কনটিনিউটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু এদিক ওদিক হয়েছে কী গেছে। চরিত্রের সঙ্গে এবং আশপাশের জিনিসকে প্রপস্ বলে। লাঠি, ছাতা, জলের গ্লাস। ধরা যাক, নায়কের বসবার জায়গার পাশে একটা অ্যাশট্রে ছিল। পরের দিনের শুটিংয়ের সময়ে সেটা রাখতে ভুল হয়ে গেল, অথচ দৃশ্য এক। শুটিংয়ের পর মনিটরে ছবি দেখে খেয়াল হলো। আরে! এখানে একটা অ্যাশট্রে ছিল না? সেটা গেল কোথায়? ব্যস, গোটাটা ফেলে দিতে হবে।
এটা কোনো শুটিং নয়, তারপরেও রায়নার রোজই মনে হয়, সবথেকে সুবিধে হত, মোবাইলে আগের দিনের ফটো তুলে রাখলে। ফটো দেখে সবটা সাজিয়ে ফেলা যায়। কিন্তু এই অ্যাসাইনমেন্টে ফটো তোলবার প্রশ্ন ওঠে না। স্পট দুটো রয়েছে ডিভানের দু’পাশে, স্ট্যান্ডে। বেঁকিয়ে চুরিয়ে, উঁচু নিচু করে ফেলা যায়। দুদিক থেকে আলো পড়ে। এটা দিয়ে যেমন আলো তৈরি করা যায়, তেমন ছায়াও তৈরি করা যায়। রায়না ঠিক করে নিল। গোটা ঘর অন্ধকার, শুধু ডিভানে আলো পড়ছে। এঘরে কিছু নড়ানড়ি হওয়ার কথা নয়। তারপরেও ঘর ঝাড়পোঁছ করবার সময়ে এদিক ওদিক তো কিছু হয়েই যায়। এবার রায়না এসেছে বারোদিন পরে। ম্যাডাম যেমন সময় দিয়েছেন।
"ম্যাডাম, আরও একটা দিন পেলে ভাল হতো।"
হৈমন্তী রোব খুলতে গিয়ে থমকে গেল।
"এরকম তো কথা ছিল না রায়না। বরং আমি একটা দিন তোমাকে এক্সট্রা দিয়েছি। টুডে ইজ দ্য এইট্টিনথ্ ডে।"
রায়না চুপ করে গেল। এই মহিলাকে সে ভয় পায়। কেন ভয় পায় সে জানে না। ম্যাডাম তাকে কোনোদিন কড়া কথা বলা তো দূরের, খারাপ ব্যবহারও করেন নি। কোনোদিন দেরি করে ফেললে হেসে বলেছেন, "আর্টিস্ট পাংচুয়াল হলে সন্দেহ হয়, সত্যি আর্টিস্ট তো?"
রায়না বলেছে, "সরি।"
ম্যাডাম বলছেন, "সরির কী আছে? তবে আমাদেরও মুশকিল। অফিস পৌঁছতে দেরি হলে, তখন ভাববে সত্যি কর্পোরেট তো? আর্টিস্ট নয় তো?"
কথা শেষ করে আওয়াজ করে হেসেছেন ম্যাডাম। রায়নাও যোগ দিয়েছে হাসিতে। এমন সুন্দর মহিলা রায়না তার স্বল্প জীবনে খুব কমই দেখেছে। মনে হয়, দেখেনি। শুধু নিখুঁত শরীর হলেই হয় না, সেই শরীরের সঙ্গে শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীন মন মিশে নারীর সৌন্দর্য তৈরি হয়। রায়নার মনে হয়, সে একজন ভাগ্যবান শিল্পী, তাই এরকম একটা ‘বিউটি’ নিয়ে কাজ করতে পারছে। তবে একটাই দুঃখ, তার কাজ কেউ দেখতে পাবে না। কারণ কাজটি ভীষণ ব্যক্তিগত এবং গোপনীয়। অথচ সে ভাল করেই বুঝতে পারে, কাজটা সবাইকে দেখানোর মতোই সে করতে পেরেছে। এক্সিবিশনে দিলে হইচই পড়ে যেত।
"ম্যাডাম, ছবি শেষ হলেও কিছু টাচ্ আপ করবার থাকে।"
"না রায়না, আমার হাতে আর সময় নেই। যা করবার আজই করতে হবে। আমি কলকাতায় যাচ্ছি। এসে আবার অফিসের কাজে বেরিয়ে যেতে হবে।"
রায়না বাধ্য মেয়ের মতো বলে, "আচ্ছা ম্য়াডাম।"
হৈমন্তী রোবের বেল্ট খুলে ফেলল। আবরণহীন হৈমন্তী প্রায় অন্ধকার ঘর আলো করে দিল! রায়না রোজই মুগ্ধ হয়, আজও হলো। শরীরে পোশাক না থাকলেও গলায় একটা সরু চেন রয়েছে হৈমন্তীর। চেনটা কালো দড়ির। ‘কার’ বলাই ভাল। সামনে একটু সোনা। সেটাও শেষ হয়েছে দ্রুত। হৈমন্তীর দীর্ঘ গ্রীবায় তা যেমন অকিঞ্চিৎকর, তেমনই ভীষণভাবে উপস্থিত। বাঁ পায়ের গোড়ালিতে একটা রূপোর সরু মল। খেয়াল করে দেখতে হয়। এই দুটোর পরিকল্পনাই রায়নার। নগ্ন শরীরে সামান্য কিছু থাকলে নগ্নতা অনেক বেশি ফুটে ওঠে।
রায়নাকে হৈমন্তী বেশ খাটাখাটনি করেই খুঁজে পেয়েছে। ইচ্ছে করলে সে পাকা, অভিজ্ঞ, নামকরা কোনো আর্টিস্ট জোগাড় করতে পারত। পুনে, মুম্বইতে প্রাইভেট কাজ করেন এমন অনেক নামী আর্টিস্ট রয়েছেন। হৈমন্তী চায়নি। নামধাম থাকলে অনেকরকম ফ্যাকড়াও থাকে। তাছাড়া, এই কাজের জন্য ঝুঁকিও আছে। রেমুনারেশন তো অনেক বেশি হাঁকবে, বাইরে পাঁচ কান করবেও। তাছাড়া, কোনো পুরুষমানুষকে দিয়ে এই কাজ করাতে অস্বস্তি হবে। এটা তো একদিনের বিষয় নয়। বেশ কয়েকটা দিন লাগবে। আর্টিস্টদের চোখ অবশ্যই আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো হওয়ার কথা নয়, তারপরেও গোলমালের গল্প শোনা যায়। কিছুদিন আগে এক পত্রিকায় খবর হয়েছে, অতি নামকরা এক বৃদ্ধ শিল্পী নাকি ইজেলের বদলে মডেলের শরীরে তুলি রঙ লাগাতে শুরু করেছিলেন। মডেল বিষয়টি নিয়ে পুলিশের কাছে যায়। কোনো লাভ হয় নি।
তাই, বয়স কম, অথচ এই কাজে ট্যালেন্ট রয়েছে, এমন কাউকে খুঁজছিল হৈমন্তী। আর্ট কলেজগুলোতে খবর নিচ্ছিল। তিনজন ব্রাইট স্টুডেন্টের খবর পেল। দু’জন ছেলে, একজন মেয়ে। কথা বলে এবং কাজ দেখে মেয়েটিকেই পছন্দ হয়েছে। কোনোরকম বাড়তি ইনবিহিশন না থাকলেও একজন মেয়ের সঙ্গে এই কাজ করাটাই স্বচ্ছন্দের হবে বলে হৈমন্তীর মনে হয়। সে রায়নাকে ডেকে পাঠিয়ে কথা বলে। ছোটোখাটো, শান্ত ধরনের মেয়েটি পছন্দ করবার মতো। কথাবার্তা, হাবভাবে এক ধরনের আর্টিস্টসুলভ ভাব রয়েছে। মারাঠি মেয়ে, বাংলা জানে না। কথা হয় ইংরেজিতে।
"আমি শুনলাম, তুমি ফাইনাল পরীক্ষায় ন্যুড স্টাডিতে খুবই ভাল নম্বর পেয়েছ।"
"ইয়েস ম্যাডাম। আমি হায়েস্ট পেয়েছিলাম।"
"কন্গ্রাচুলেশনস।"
"পেইনটিংসের এই দিকটায় আমার প্যাশন।"
"কেন?"
"আমার মনে হয়, মানুষের শরীর তার মনের গোপন কথা বলে। তার রাগ, দুঃখ, ভালবাসা, কষ্ট, খুশি সে বাইরে গোপন করতে পারে, কিন্তু শরীরে পারে না। আর্টিস্ট সেটা দেখতে পায়। সেইসব অভিব্যক্তি ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে পারলে সেটা একজন শিল্পীর জন্য খুবই তৃপ্তির।"
হৈমন্তী বলল, "তোমার এই ব্যাখ্যাটা শুনতে আমার ভাল লাগল, কিন্ত আমি পুরোটা একমত হলাম না রায়না। শুধুমাত্র সৌন্দর্যই কি এই ধরনের পেইনটিংসের পক্ষে যথেষ্ট নয়? ধর, তুমি যদি কোনো ফুলের ছবি আঁকো, সেখানে তার সোন্দর্যটুকুই কি যথেষ্ট নয়?"
"কথাটা এক অর্থে ঠিক, তবে কোনো কোনো আর্টিস্ট সৌন্দর্যের সঙ্গে আর একটু কিছু যোগ করে নেন। নইলে সেটা তাঁর চোখে ছবি হয়ে ওঠে না। একটা ফুলের সৌন্দর্যে যতক্ষণ না আমি নিষ্পাপ, পবিত্রতার কোনো সেন্স আনতে পারছি, ততক্ষণ আমি স্যাটিসফাইড হতে পারব না ম্যাডাম। আবার এমনও হতে পারে, ফুলটাকে আমি ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুললে হয়তো মনে হবে, এই ধ্বংসের পৃথিবীতে সে বড় অসহায়।"
হৈমন্তী খুশি হয়ে বলল, "এটাও ভাল বলেছ। কোন আর্টিস্টের ন্যুড পেইনটিংস তোমার ভাল লাগে?"
রায়না বলল, "পৃথিবীর সব বড় বড় আর্টিস্টরা এই কাজ করেছেন। বত্তিচেলি, মানে, রুবেনস, এমনকি পিকাসোর কাজও মারাত্মক। মাড্যাম, মানের অলিম্পিয়া ছবিটি তো আপনি জানেন।"
হৈমন্তী বলে, "হ্যাঁ জানি। ছবিটা সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?"
রায়না লজ্জা পেয়ে বলে, "অত বড় কাজ নিয়ে আমি কী বলব? তবে অনেক ক্রিটিকের মতো আমারও মনে হয়, ন্যুড পেইনটিংসের অতীত ধারা মানে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন। তাঁর পূর্বসূরী শিল্পীরা মূলত ভেনাসকে মাথায় রেখেই কাজ করতেন। তাঁর সৌন্দর্য অপার্থিব, শুধুই শিল্পীর কল্পনা। সে থাকবে দেবদূতেদের মাঝে। মানে এই ধারণাকে ভেঙে দিলেন। তিনি অলিম্পিয়া নামের এক সাধারণ রমণীকে সামনে এনে যেন বললেন, এই সৌন্দর্যও কল্পনার থেকে কিছু কম নয়...।"
হৈমন্তী খুব খুশি হয়ে বলল, "ভেরি গুড রায়না। তুমি কি জানো, তোমাকে আমি কোন কাজের জন্য ডেকেছি?"
"সম্ভবত আপনি আমার কাছ থেকে এই ধরনের কোনো পেইনটিং কিনতে চান।"
হৈমন্তী বলল, "ঠিক তাই। তবে ছবিটা হবে আমার নিজের। আমার শখ হয়েছে, নিজের একটা ন্যুড পেইনটিং আমি আমার কাছে রাখব। যে ছবিটা আমার থেকেও দেখতে ভাল হবে। এবার বলো, কাজ কবে থেকে শুরু করবে এবং তোমার পারিশ্রমিক কত। শুধু একটাই কথা, কাজটা হবে গোপনে।"
সেই ছবি আজ শেষ হতে চলেছে। হৈমন্তী রোজকার মতোই ভিজে চুল কাঁধের ওপর ফেলেছে। ডিভানের ওপর আধশোয়া হয়েছে সে। গত সতেরো দিন সে এই ভাবেই থেকেছে। বসবার পর বাঁ হাতটা এমন ভাবে রাখে যাতে শরীরের খুব গোপনীয়তাটুকু আড়াল হয়। সামনে একটা বই খোলা। বই বাছাইয়ের সময়ে রায়না খুবই অবাক হয়েছিল। এক সুন্দরী নারী নিজের নগ্ন ছবি আঁকানোর সময় এ কোন বই পড়ছে! বইটি ভয়ংকর।