Advertisment

সাহিত্য অকাদেমি ঠিক কোন ভাষার জন্য?

বাংলার সবাই গালিবের নাম জানেন, কিন্তু হিন্দি বলয়ের কোনো কবি এঁদের নাম শুনেছেন বলে মনে হয়না। সব মিলিয়ে এ সেই ছাগলের তৃতীয় ছানার গপ্পো।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Sahitya Akademi, Guruninda

বছর বছর বাংলার লেখকরা দিব্যি অকাদেমি পুরষ্কার পাচ্ছেন

সাহিত্য অকাদেমি নাকি ভারতের ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিকল্পে নিবেদিতপ্রাণ। তাদের ওয়েবসাইটের ঘোষণায় অন্তত তেমনই লেখা আছে। অকাদেমি ভারতের বিভিন্ন ভাষার বই এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় অনুবাদও করে, যাতে এক ভাষার মানুষ অন্য ভাষার সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেন। কিন্তু সেই অনুবাদের কর্মকাণ্ড দেখলে চোখ কপালে ওঠা অসম্ভব কিছু নয়।

Advertisment

যদি অকাদেমির অনুবাদ পড়ে কোনো হিন্দিভাষী বাংলা সাহিত্য বুঝতে যান, তাঁর নির্ঘাত ধারণা হবে, যে, বাংলাভাষায় সাহিত্যের শেষ ল্যাম্পপোস্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ, অকাদেমি বাংলা থেকে হিন্দিতে যা অনুবাদ করেছে, তার সিংহভাগ হয় রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাস, নয় রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বই। তাছাড়া এক-আধখানা একেবারেই নেই তা নয়, কিন্তু সে ওই এক আধখানাই।

পড়ুন, ছাপা বই বনাম পিডিএফ, বাংলার হাল ও হকিকৎ

রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী উপন্যাস-লেখকদের মধ্যে একমাত্র মহাশ্বেতা দেবীর কয়েকখানি বইয়ের অনুবাদ অবশ্য ধুলো-টুলো ঝেড়ে খুঁজে বার করা সম্ভব। তিনি হঠাৎ ছাড়পত্র পেলেন কেন, বোঝা মুশকিল, বোধহয় ইংরিজিতে নিম্নবর্গচর্চায় আলোচিত বলে। এরও বাইরে হয়তো গুদামঘরের অন্ধকারে কিছু থাকতেও পারে, কিন্তু ক্যাটালগ বা বইয়ের দোকানে বা স্টলে সেসব পাওয়া যায়না। সেখানে যা জ্বলজ্বল করে, সে ওই একমেবাদ্বিতীয়ম রবীন্দ্রনাথ।

এতদ্বারা ভিনভাষীর কাছে যা প্রতিভাত হয়, তাও খুব পরিষ্কার। বাংলা ভাষায় যা আলো জ্বালবার তা ঠাকুরবাড়ির ওই কনিষ্ঠ সন্তানই জ্বেলেছিলেন, তারপর থেকেই বেবাক অন্ধকার। বাঙালি জাতির টিউবলাইট ওই চল্লিশের দশকেই নিভে গেছে। সেখানে জীবনানন্দ বলে কেউ নেই। কল্লোল, কালিকলম, কৃত্তিবাস এসব কিছু হয়নি। শক্তি-সুনীল-উৎপল, কে অথবা কেন? দীপেন-দেবেশ-সন্দীপন -- এরা কোন বাগানের ফুল?

নামের তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই। মোদ্দা কথা হল, আমরা যারা বাংলা ভাষার ক্ষুদ্র কলমচি, তারা মোটের উপর যদিও মনে করি যে, জীবনানন্দ থেকে বাংলা ভাষা পুনরাবিষ্কৃত হয়, কিন্তু অকাদেমি তার ধার ধারেনা। তাদের কাছে ওসব মূলত আবর্জনা, যা বাইরের লোকের জানার একেবারেই প্রয়োজন নেই।

পড়তে ভুলবেন না, “বইমেলার আগুনের কারণ একটি দায়িত্বজ্ঞান সিদ্ধান্ত”- অনিল আচার্যর সাক্ষাৎকার

অবশ্য এও হতে পারে, বাংলা ভাষায় যে ১৯৪১ সালের পরেও লেখালিখি হয়, সে কথা অকাদেমি জানেনা। কিন্তু সেটা হওয়া অসম্ভব, কারণ বছর বছর বাংলার লেখকরা দিব্যি অকাদেমি পুরষ্কার পাচ্ছেন। ফলে ব্যাখ্যা একটাই দাঁড়ায়, যে ওসব পুরষ্কার-টুরষ্কার সম্ভবত দায়ে পড়ে দেওয়া। নেহাৎই দিতে হবে বলে, নচেৎ ওইসব ঝড়তি-পড়তি মাল অনুবাদের যোগ্যই নয়। হিন্দি বা উর্দু বইয়ের বাংলা অনুবাদের সঙ্গে তুলনা করলে ব্যাপারটা আরও চমকপ্রদ হয়ে দাঁড়ায়। কোনো বাংলাভাষী যদি অকাদেমির অনুবাদ পড়েন, তিনি কি ভাববেন, যে, হিন্দুস্তানি স্রেফ প্রেমচন্দেই শেষ হয়ে গেছে? একেবারেই নয়।

অনুবাদে মান্টো আর ইসমত চুঘতাই এর ছড়াছড়ি তো বটেই। গালিব অনুবাদেও বিপুল উদ্যম এবং সম্ভবত অর্থও ব্যয় করা হয়েছে। মূল গালিব থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন একঝাঁক বাঙালি কবি। তাঁরা সবাই উর্দুতে পণ্ডিত, তাও না। তাঁদের সাহায্য করতে আনা হয়েছে উর্দু বিশেষজ্ঞদের। রীতিমতো কর্মশালা আয়োজন করা হয়েছে (এসব তথ্য গালিবের অনুবাদের ভূমিকাতেই দেওয়া আছে)।

এসব তো পুরোনো দিনের গপ্পো। নব্বইয়ের দশক থেকে শুরু করে হিন্দি ভাষার নানা গন্ধের লেখার অনুবাদও হয়েছে মহাসমারোহে, যার একদিকে আছেন, বিনোদ কুমার শুক্লা, যিনি নাকি হিন্দি ভাষায় যাদুবাস্তবতার ঝাণ্ডাবাহক। উল্টো প্রান্তে আছেন গিরিরাজ কিশোর বা বিষ্ণু প্রভাকর। এঁরা কোন যোগ্যতায় অনূদিত হলেন, কিন্তু সমসাময়িক কৃত্তিবাসীরা কেন হলেননা, যোগ্যতার বিচারে সে কথা বোঝা অসম্ভব।

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সেই পঞ্চাশের দশকে যা লিখেছেন, তা ভারতীয় ভাষার ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়? অভূতপূর্ব নয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ বা যুবক-যুবতীরা বা দেবেশ রায়ের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত? গালিব অনুবাদে বাঙালি কবিরা একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, খুব ভালো কথা, কিন্তু জীবনানন্দ অনুবাদে এর ছিটেফোঁটাও উদ্যোগ কি নেওয়া হয়েছে? কালীপ্রসন্ন সিংহ বা আরও পুরোনো ভারতচন্দ্র অনুবাদের কথা নাহয় ছেড়েই দেওয়া গেল।

বাংলার সবাই গালিবের নাম জানেন, কিন্তু হিন্দি বলয়ের কোনো কবি এঁদের নাম শুনেছেন বলে মনে হয়না। সব মিলিয়ে এ সেই ছাগলের তৃতীয় ছানার গপ্পো। সেই একই গপ্পো, যেখানে সাহিত্য অকাদেমি কোনো ব্যতিক্রম নয়। গপ্পোটি এই, যে, বহুভাষিক এই ভারতবর্ষে রাজভাষা একটিই। তার নাম হিন্দি। তার ঠাট-ঠমক-মান-মর্যাদা সবই আলাদা। বাকি সবই খুচরো। যাকে কায়দা করে বলা হয় আঞ্চলিক (যেন হিন্দি কোনো আঞ্চলিক ভাষা হয়)। বাকিদের তাই লাথিঝাঁটা ও খুদকুঁড়ো খেয়েই বাঁচতে হবে। তাতে করে যতদিন বেঁচে থাকা যায়। কারণ আপনি বাঁচলে তবেই বাপের নাম। সে বাপের নাম যদি বদলে খগেন হয়ে যায় তো তাই সই।

(সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় গুরুচণ্ডালি ওয়েব ম্যাগের সম্পাদক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে

(ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় প্রকাশিত হতে চলেছে বাংলা পক্ষের গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের একান্ত সাক্ষাৎকার)

Guruninda
Advertisment