Advertisment

চোখ হারানোর আশঙ্কায় রুশদি, স্বপ্ন তবু নাছোড়

রুশদির চোখের সমস্যা রয়েছে অনেক আগে থেকে। দীর্ঘ সময় জেগে থাকার জন্য চোখের উপরের পাতা পড়ে যাওয়ার বিড়ম্বনা।

author-image
Nilarnab Chakraborty
New Update
Salman Rushdie, Salman Rushdie stabbed, Salman Rushdie injuries, Salman Rushdie attacked, Indian Express news

এক চোখে দৃষ্টিশক্তি হারালেন বুকারজয়ী লেখক!

ধর্মদ্রোহ বা ধর্মনিন্দা। ইংরেজিতে যাকে বলে ব্লাসফেমি। সলমন রুশদি যে অভিযোগে কাঠগড়ায়। স্যাটানিক ভার্সেস, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় শয়তানি কাব্য, সকলেই জানেন এই বইটি লেখায় ওই কাঠগড়ায় সলমন। অনেক দিন ধরেই তিনি কাঠগড়াটিতে দৌড়চ্ছেন, লুকোচুরি খেলছেন। নিউইয়র্কের শেটোকায়া ইনস্টিটিউটের অ্যাম্পিথিয়েটারে কিন্তু ধরা পড়ে গেলেন। একটি ভূত যেন হাজির হল ১২ অগস্ট। মঞ্চের উপর একেবারে ছুরিতে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত করে তুলল রুশদিকে। হামলাকারীকে ভূত না বলে লোন উল্ফ বা একাকী নেকড়েও বলতে পারেন। যে এখন হিরো। জিরো থেকে শিরে। শিরোনামে, শিরঃপীড়ায়।

Advertisment


হাদি মাতার তার নাম, বয়স ২৪, স্যাটানিক ভার্সেস ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়, তখনও সে পৃথিবীর আলো দেখেনি। ইরানের একদা সর্বাধিনায়ক আয়াতুল্লা খোমেইনির মৃত্যু হয় ১৯৮৯ সালের ৩ জুন। বইটি প্রকাশের ন’ মাসে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে রুশদির বিরুদ্ধে জারি করা মৃত্যুর ফতোয়া পুনর্নবীকরণ কিন্তু হয়ে চলেছে। প্রথমে রুশদিকে হত্যায় পুরস্কারমূল্য ঘোষণা করা হয়েছিল ২ মিলিয়ন ডলার, করেছিলেন খোমেইনি স্বয়ং, ১৯৯৭ সাল সেইটি বাড়িয়ে দেওয়া হয়, এবার ‘মহান’ কাজটি করেন আর এক ইরানি সরকারি এবং ধর্মীয় নেতা হাসান সানেই। বাড়িয়ে করা হয় ২.৫ মিলিয়ন ডলার। তার পর আরও বাড়ে খুন-পুরস্কারের অর্থমূল্য। ২.৮ মিলিয়ন, ৩.৩ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাল।


হামলায় রুশদির চোখ খোয়ানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একটি বই উপলক্ষে যে ভাবে বলি হচ্ছেন, পৃথিবীটা ধর্মোন্মাদনায় এই ‘এক ক্লিকে কামালে’র যুগেও যেভাবে কাঁপছে, তাতে চোখ খুলতে তিনি চাইছেন কিনা, সেই প্রশ্ন থাকছে। কথা বলতে পারছেন না রুশদি, বাকস্তব্ধতাও এখন ওই একই ব্যঞ্জনায় স্বাভাবিক। অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ,/ তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।।/ শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম, / প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান।… না, করুণাকণা দান করলে হবে না, শিল্পিত করা দরকার যারা মৃত তাদের, একমাত্র তা হলেই প্রাণ ফুটবে। শিল্পবোধ মৌলবাদকে মুছে দিতে পারে, তাই আর্টের আর্টারিগুলিকে সব খুলে দেওয়া জরুরি। সলমন রুশদি মকবুল ফিদা হুসেন তসলিমা নাসরিনদের না হলে বাঁচাবো কি করে আমরা। জিভ আমাদের লজ্জায় কাটতে হচ্ছে। ধর্মনিন্দার বিরুদ্ধে সারা পৃথিবীতে একের পর এক দেশ কানুন তৈরি করেছে। মোটামুটি ৩৩টি দেশে এই আইন।

আরও পড়ুন: < হামলার পর কেটে গিয়েছে কয়েকঘণ্টা, কেমন আছেন বুকারজয়ী লেখক রুশদি? >

কিন্তু আইন করে তো আর আর্টিস্টকে আটকানো যায় না। আসলে এক জন আর্টিস্ট, এক জন লেখক বুঝতেই পারেন না তিনি যা করছেন, সেইটা ধর্মবিরোধী বা ধর্মের পক্ষে নিন্দাজনক কিনা। তিনি কাজ করে চলেন সৃজনের চরিতার্থতায়। ধরে নেওয়াও যদি হয়, ঈশ্বর মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা, তা হলে শিল্পী মহাবিশ্বকে নতুন করে সৃষ্টি করছেন। হয়তো এই ভাবে তার সঙ্গে প্রকৃত ঈশ্বরের বিরোধ সেই শুরু থেকে। সে ভাবে শিল্পীও ঈশ্বর, কারণ তিনি সৃষ্টিকর্তা। তাই তাঁর স্বাধীনতা অসীম। অবাধ। সেইটা মৌলবাদের মাথায় গজাল মেরেও ঢোকানো যায় না।


কিন্তু স্যাটানিক ভার্সেসের মতো এক অসামান্য পুস্তকের সাহিত্যগুণের কথা আমরা বলি না। বিতর্কের দিকটা অনেক বেশি করে গ্লোরিফাই করে দেওয়া হয়। রুশদি ছুরিকাহত হওয়ার পর তো আরও বেশি। শিল্পীদের ভিতরের দুঃখ এটাও। তাঁরা বিখ্যাত হয়ে যান, লোকে লস্করে তাঁদের কথা জেনে যায়, কটা বউ তাঁদের, মাতাল কিনা, ঋণভারে জর্জর কিনা সব জেনে যায়। লোফালুফি চলে এ সব নিয়ে, কিন্তু তাঁদের কাজকর্ম সেই তুলনায় সামান্য লোক জানেন, এই দুঃখের তিমিরেই তাঁদের জীবন শেষ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বউদির প্রেমের দ্রবণ যত জন জানেন, সোনার তরী কবিতায় দ্রবীভূত তাঁদের সিকিভাগ তো হন না। ব্লাসফেমির ব্লাস্ট জাস্ট বাদ দিয়ে রুশদির এই বইটি পড়লেই বোঝা যায় ভাষা ম্যাজিক কাকে বলে।


রুশদির চোখের সমস্যা রয়েছে অনেক আগে থেকে। দীর্ঘ সময় জেগে থাকার জন্য চোখের উপরের পাতা পড়ে যাওয়ার বিড়ম্বনা। সব সময় যেন ঘুমতে চাইছে চোখ দুটি কিন্তু ঘুমানো সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্রাম না পাওয়ার জেরে উদ্ভুত চোখের পেশীর সমস্যা। সে জন্য রুশদিকে সার্জারিও করাতে হয় ১৯৯৯ সালে। হ্যাঁ, স্বপ্নটাই তাঁকে জাগিয়ে রেখেছে, স্বপ্নের বয়ান তিনি বিনিদ্র চোখে লিখেছেন। আর জাগিয়ে রেখেছে হন্যে খুনির দল। হাসপাতালে গিয়ে হয়তো এই মওকায় একটু ঘুমোলেন রুশদি, চোখ জোড়া দীর্ঘ ক্ষণ বুজে থাকার সুযোগ পেল। যার একটি দিয়ে কিছু দেখতেই হয়তো পাবেন না তিনি আগামীতে। এত নষ্টামি একটু কম দেখলে ক্ষতি নেই! প্রাণ কেন গেল না! হয়তো ভাবছেন, চোখ বুজে এক মনে রুশদি। স্বপ্নটা সলমন তবুও দেখছেন।

Author Salman Rushdie
Advertisment