যে-ঘটনাটার কথা লিখতে যাচ্ছি, তার কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আজও অবধি আমি পাইনি। যা ঘটেছিল, সেটাই অবিকল লিখছি। যদি আপনারা এর কোনো যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা বের করতে পারেন, দয়া করে আমাকে অবশ্যই জানাবেন; জীবনের একটি দুর্বোধ্য প্রহেলিকা থেকে অন্তত আমি মুক্তি পাবো তাহলে। ঘটনাটা বলার আগে তার পটভূমিকাটি অবশ্যই তুলে ধরা দরকার, তা না-হলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। মন দিয়ে শুনুন।
আমি ছোটোবেলায় ক্লাস টেন অবধি যে-গ্রামের স্কুলে পড়ে বড় হয়ে উঠেছি, সেটা মেদিনীপুর জেলার একটা অজ পাড়া গাঁ—অন্তত আশির দশকে সেই গ্রামটা ওরকমই ছিল। কলাগ্রাম। তখনও সে-গ্রামে বিদ্যুৎ পরিষেবা আসেনি, খবর কাগজ নেই, হাতে গোনা কয়েকটি রেডিয়ো সেট বহির্জগতের সঙ্গে কোনোমতে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে। চারিপাশে চাষের জমি, জমির পাশে কুবাই নদী, নদীর ধারে গ্রামের শ্মশান। গ্রামের মাঝখানে আমাদের স্কুল কলাগ্রাম শহীদ ক্ষুদিরাম স্মৃতি বিদ্যাপীঠ। স্কুলের পেছন থেকেই ধূ ধূ করা চাষের ক্ষেত ধূসর দিগন্তে গিয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। সেই আবছা হয়ে আসা দিগন্ত রেখার কাছে অস্পষ্ট জটলার মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গ্রাম; উচাহার, থাউর, গড়াইপুর...ওইসব গ্রাম থেকে প্রতিদিন ছেলেমেয়েরা মাঠের আলপথ ধরে পড়তে আসত কলাগ্রাম স্কুলে।
আমি এই স্কুলে ক্লাস সেভেনে এসে ভর্তি হই। আর ক্লাস সেভেন থেকেই আমার সঙ্গে পড়ত জুলফাই মল্লিক। ঘটনাটা তাকে নিয়েই।
জুলফাই আর তার দাদা জুলহাস আসত উচাহার গ্রাম থেকে রোজ। আমরা গ্রামের স্কুলের ছেলে, আমাদের তখনও অবধি কোনো নির্দিষ্ট ইউনিফর্মের বালাই ছিল না। সাদা পায়জামার উপর শার্ট পরেছি উঁচু ক্লাসে। আর নীচের ক্লাসে হাফপ্যান্ট আর যে-কোনো রঙের শার্ট। মেয়েরা ফ্রক আর শাড়ি।
জুলফাই লম্বা ছিল বেশ, শ্যামলা রঙ। সে মাঠের ধারের জঙ্গল থেকে দেশলাই বাক্সের মধ্যে ধরে আনত কাঁচপোকা। কখনও বা সুদর্শন পোকা। সুদর্শন পোকা জানেন তো? পোকাটিকে বিখ্যাত করে গেছেন বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ আর বিভূতিভূষণ। ‘সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে’—লিখেছেন জীবনানন্দ। বিভূতিবাবুও ‘পথের পাঁচালি’তে সুদর্শনের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। দুর্গা পোকাটিকে নিয়ে খেলছিল, তার কাছে প্রার্থনা করছিল, ‘সুদর্শন ভালাভালি, অপুকে ভালো রেখো...নীরেনবাবুকে ভালো রেখো’ এই গোছের।
সেই পোকাটার গায়ের রঙ উজ্জ্বল নীলাভ সবুজ। রোদ লেগে একেবারে ঝিকমিক করে। ক্লাসের মেয়েদের হাতে যাতে এই পোকা না-পড়ে তার জন্য আমরা ছেলেরা খুব সাবধান ছিলাম। গ্রামের মেয়েরা পোকাটিকে মেরে তার গায়ের শক্ত আবরণ ছাড়িয়ে নিয়ে টিপ তৈরি করে কপালে পরত। কাঁচপোকার টিপ। এ নিয়ে পরে আমি যতই কাব্যি করে থাকি না কেন, সেই বয়সে ব্যাপারটাকে আমার যথেষ্ট নির্দয় বলেই মনে হত। কিন্তু আমরা ছেলেরাও এ পোকাটাকে নিয়ে যা করতাম, তাকেও যে খুব সদয় ব্যবহার বলা যায়, তা নয়। টিফিন পিরিয়ডে দেশলাই বাক্স থেকে পোকাটাকে বের করে পোকার পায়ে মিহি সুতো পরিয়ে সুতোর একপ্রান্ত হাতে ধরে তাকে শূন্যে ওড়াতাম। নদীর বাতাসে বোঁ-ও, বোঁ-ও শব্দ করে পোকাটা ঘুরে ঘুরে উড়ত। তারপর খেলা শেষ হয়ে গেলে সুতো খুলে পোকাটাকে ছেড়ে উড়িয়ে দিতাম। এই ছিল প্রতিদিন আমার, রঞ্জনের আর জুলফাইয়ের খেলা।
জুলফাইকে নিয়ে সত্যি বলছি এটা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু মনে নেই। শেষ দেখা মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট আনতে গিয়ে। তখন আমরা দুজনেই একটু বড় হয়ে গেছি। আমার হালকা হালকা গোঁফ, জুলফাইয়ের থুতনিতে সামান্য একটু নূর।
ব্যস, তারপর আর দেখা নেই। আমি মেদিনীপুর শহরে চলে এসেছি। সেখান থেকে কলকাতায়। তারপর অনেক পথ ঘুরে প্রথম যৌবনে ঘর ছেড়ে চলে গেছি মাদ্রাজে, অনিকেত জীবন আমার। জুলফাইয়ের আর কোনো খবর রাখিনি।
যে-গ্রামে স্কুলজীবন কাটিয়েছি, সেই কলাগ্রামের পাঁচ সাত মাইল দূরেই কেশপুর। কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের সেই নিরুপদ্রব কেশপুর থানা উঠে আসবে ভয়ংকরভাবে রাজ্যের রাজনৈতিক মানচিত্রে। বহু রাজনৈতিক অস্থিরতা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, নারকীয় হত্যাকাণ্ডে এমনই পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে সেই স্থান যে, কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার সাকিন জানতে পেরে সহপাঠী সহপাঠিনীরা আঁতকে উঠে আমাকে বলবে, বলিস কী রে? তুই সেই ভয়ানক কেশপুরের ছেলে?
যাক, সেসব স্থানচিহ্ন তো আর কয়েক বছরের মধ্যেই আমার গা থেকে খসে গেল। অনিকেত সাধুসমাজে কে কোথায় জন্মেছে, কে কী পাস, কোথাকার লোক, কেউ জানতে চায় না। জানতে চাওয়াটাও খুবই অ-সাধুসুলভ। আমিও দিনে দিনে ভুলেছি আমার ছোটোবেলা, সেই গ্রাম, সেই স্কুল, জুলফাই কিংবা রঞ্জনদের; অন্তত সেসব ঘটনা মনের চেতন স্তর থেকে অবচেতনের স্মৃতিকৌটোর মধ্যে চালান হয়ে গিয়েছে বহুদিন।
মাদ্রাজ থেকে বেলুড় মঠে এসে আছি তখন। স্কুল ছাড়ার দিন থেকে গুনলে কমপক্ষে পনেরো ষোলো বছর তো ততদিনে কেটে গেছেই। আমরা তখন থাকি বেলুড় মঠের ভেতর দিকে ব্রহ্মচারী ট্রেনিং সেন্টারের তিনতলা বাড়িটাতে। সেখান থেকে খাওয়ার ঘর, গঙ্গার ধার, মন্দির—ব্যস, এর বাইরে আমাদের আর গতিবিধি ছিল না। দুটি বছর সমস্ত জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াশোনা, জপধ্যান আর কাজকর্মে মহা আনন্দে ডুবে ছিলাম।
ট্রেনিং সেন্টারের তেতলায় বড় একটা হলঘরে ও হলঘর-সংলগ্ন বারান্দায় সন্ধেবেলায় আমরা শ’দেড়েক যুবক নিঃশব্দে জপধ্যান করতাম। মনে হত, তেতলা বাড়িটা সম্পূর্ণ জনশূন্য, যেন কেউ এখানে থাকে না। ঠাকুরের ছবির কাছে স্তিমিত একটা আলো জ্বলত। আর সব অন্ধকার। কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলতাম না। আলো-আঁধারির মধ্যে ছায়ামূর্তির মতো একেকজন আসতেন। জপধ্যান শেষ হলে ঘণ্টাখানেক পর একইভাবে নীরবে উঠে চলে যেতেন। সারাদিন এত হৈচৈ, এত গান, গল্প, হাসির হররা—অথচ সন্ধে হলেই এক লহমায় সব যেন নিশ্চুপ হয়ে যেত। নীরব মঠবাড়ি, দূরের নক্ষত্রখচিত আকাশ, গঙ্গার বিবাগী বাতাসের মধ্যে অনেক দূর থেকে ভেসে আসা পরপারের মন্দিরদেউলের শাঁখঘণ্টার শব্দ...
এরকমই একটি শীতের রাত্রি। তা আটটা নাগাদ হবে। আমি জপধ্যান সেরে সেই হলঘর থেকে দোতলায় নিজের ঘরে এসেছি। তিনজন একই ঘরে থাকি; ঘরে এসে দেখলাম বাকি দুজন তখনও আসেননি। আরও আধঘণ্টা পরে খাওয়ার ঘণ্টা পড়বে। বড় আলো জ্বালাবার নিয়ম নেই তখন। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছি। জানি, ঘণ্টা পড়লেই থালা নিয়ে চলে যাব ডাইনিং হলে। শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি।
তখনই সেই অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখলাম। দেখলাম, বেলুড় মঠে যেন জুলফাই ও আরও তিনজন ছেলে এসেছে। তারা আমাকে খুব খুঁজছে। আমি খবর পেয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেছি। তাদের চুল উসকোখুসকো, চোখ লাল, জামাকাপড় ধূলিধূসর ও ছেঁড়া। তারা হাঁফাচ্ছে, যেন অনেক দূর থেকে তারা ছুটতে ছুটতে এসেছে। জুলফাই জল চাইল। এক নিঃশ্বাসে দু-গ্লাস জল খেয়ে সে আমাকে বলল, ‘তোমাদের এখানে একটু জায়গা হবে?’
আমি বললাম, ‘কেন? কী হয়েছে?’
একইরকম অস্থিরতার সঙ্গে ছটফট করতে করতে জুলফাই বলল, ‘ওরা আসছে। হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে। আমাদের মেরে ফেলবে। আমরা ওদের তাড়া খেয়ে এখানে এসে ঢুকেছি। হবে একটু জায়গা? ক-দিন আমাদের এখানে লুকিয়ে রাখতে পারবে তুমি?’
সে আর তার বন্ধুরা আমার হাত ধরে করুণ স্বরে মিনতি করতে লাগল। আমি বললাম, ‘দেখছি, কী করা যায়।’
এর পরেই স্বপ্নটা ভেঙে গেল খাওয়ার ঘণ্টার আওয়াজে। উঠে মুখহাত ধুয়ে থালা নিয়ে তড়িঘড়ি ডাইনিং হলে চলে গেলাম।
সে-রাত গেল। পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ শাস্ত্রপাঠের ক্লাস করছি, এমন সময় একজন ক্লাসে ঢুকে আমাকে বললেন, ‘তুমি এখনই মিশন-অফিসে চলে যাও। তোমার একটা জরুরি ফোন আছে। বলছে, মেদিনীপুর থেকে।’
আমি যে বেলুড় মঠে এসেছি, বাড়ির লোকেরা জেনেছেন। নিশ্চয়ই বাড়ি থেকেই ফোন। আমি সবরকম খবরের জন্য প্রস্তুত হয়েই মিশন অফিসের পথে পা বাড়ালাম।
অফিসে ঢুকে ফোন ধরতেই আমার ভাইয়ের গলা পেলাম। ‘কী ব্যাপার?’
—দাদা,একটা খারাপ খবর আছে।
—কী খবর, বল।
—জুলফাই মল্লিককে মনে আছে?
—হ্যাঁ, আমার সঙ্গে পড়ত। কী হয়েছে জুলফাইয়ের?
—কাল সন্ধেবেলা জুলফাই ও আরও তিনজন যুবক নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেছে। ওরা কেশপুর থেকে গ্রামে ফিরছিল। বাসলাইনের পাশে কারা যেন ওদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে কেটে ফেলে দিয়ে গেছে।
—সে কী রে! কখন হল?
—পুলিশ বলছে, রাত্রি আটটা-সাড়ে আটটা নাগাদ। রাজনৈতিক ব্যাপার আছে...
আমি ভাইয়ের কথা আর কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। মাথা ঘুরছে। টেলিফোনের ওপাশে ভাই কীসব যেন বলে যাচ্ছে। হুঁশ হতে শুনলাম, বলছে, ‘ওরা পালাচ্ছিল। কেশপুর থেকেই আততায়ীরা ওদের ফলো করে। ওরা বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু বোকার মতো ভিড় বাস থেকে মাঝপথে নেমে পড়ে। তারপরই... তারপরই রাস্তার ধারে খুনটা হয়।’
ফোন ছেড়ে মিশন-অফিস থেকে ট্রেনিং সেন্টারে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, ঠিক খুন হওয়ার সময়টাতেই আমি জুলফাইকে স্বপ্ন দেখলাম? তার কথা তো এতদিন আমার মনেই ছিল না একেবারে।
স্বপ্নে জুলফাই কাতর হয়ে আমার কাছে আশ্রয় চাইছিল। খুন হয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তবে কি তার মনে পড়েছিল অনেক দিন আগের এক বন্ধুর মুখ? সে খুন হল কেশপুরে বাসরাস্তার পাশে। আর আমি বেলুড় মঠে শুয়ে তাকে ঠিক সেই মুহূর্তেই স্বপ্নে দেখলাম! কীভাবে?
ধুলামাটির বাউল সিরিজের সব লেখা একত্রে পড়ুন এই লিংকে