তরলমতি অতি ভব্যযুক্ত নব্যযুবক। সময়মতো আপিশ যায়, দুটিবেলা মায়ের হাতে রান্না করা, বাবার বাজার খুঁজে আনা পটল ঢ্যাঁড়শ কুমড়োর তরকারি আর মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খায়, আর দিবারাত্তির বই কেনে আর পড়ে।
তরলমতির মা মমচিত্তহারিনী দেবী নিতান্ত সরলস্বভাবা। তাঁর দিনের প্রায় পুরো জাগ্রত সময়ই রান্নাঘরে কাটে। কিন্তু তরলমতির বাবা অটলপ্রসন্ন কিঞ্চিৎ অতিতরল, পক্ষান্তরে বদ ফাজিলও বলা চলে। এই যেমন ছেলের নামকরণের সময়ে তিনি ব্লেন্ডার্স প্রাইড বা অ্যাবসোলুট নামক কিছু বিশেষ তরলের কথা স্মরণ করেছিলেন। কিন্তু পুত্রের সেদিকে বিন্দুমাত্র মতি গজায়নি এখনো। শুধু তাই নয়, তাঁর মজ্জাগত ফিচলেমির কণামাত্র তাঁর সুবোধ ছেলে আয়ত্ত করতে পারেনি। এসব নিয়ে তাঁর সুপ্ত আক্ষেপ আছে।
অটলপ্রসন্ন দিনের এক চতুর্থাংশ সময় বাজার, দোকান, মুদিখানা ইত্যাদিতে কাটান। এক তৃতীয়াংশ সময় কাটান আংশিক ঘুমিয়ে ও আংশিক বিশ্রাম নিয়ে। স্নান-পান-আহারাদি ইত্যাদি বাদ দিয়ে বাকি যা সময় পান তা শব্দজব্দ আর সুডোকু করে এবং মমচিত্তবিহারিণী দেবীকে নিত্যনতুন পদ্ধতিতে উত্যক্ত করে অতিবাহিত করেন।
এই তো গতকালই, তরু, মানে তরলমতি অফিস থেকে ফিরে সবে জুতো খুলছে মোড়ায় বসে, মমচিত্তহারিনী গজ গজ করতে করতে এসে হাজির।
"এই, জামা ছাড়িস না তো। একটা শেকল আর চেন কিনে আন আগে।"
"অ্যাঁ? কেন? বাবা কুকুরছানা এনে জুটিয়েছে নাকি?"
"দূর, তোর বাবার জীবজন্তু পোষায় আপত্তি জানিস না! অমন শিকল না, ছোট দেখে আন।"
"কী বাঁধবে সেটা বলো নইলে কী সাইজের আনব আমি!"
"সে আছে। তুই সবচেয়ে ছোট যা পাস তাই আন দিকি।"
খুব সন্দেহ হয় তরুর। ওদিকে ঘর থেকে বাবার হো হো হাসি শুরু হয়ে গেছে।
"কি জন্য চাই না বললে যেতে পারলাম না।"
"উফ, তোরা সব এমন না! চেন আনবি, তালাও আনবি। টুথব্রাশ বেঁধে রাখব।"
তরুর হাঁ আর বোজে না। ততক্ষণে অটলপ্রসন্ন বেরিয়ে এসেছেন, তিনিই অবশেষে বুঝিয়ে বলেন। বয়েস হয়ে, আর থাইরয়েড বেড়ে গিয়ে অবধি মমচিত্তহারিণী খুব ভুলোমনা হয়ে গেছেন। আজ সকালে নাকি তিনি দাঁত মাজতেই ভুলে গেছিলেন, খেয়াল হয়েছে তরু অফিস চলে যাবার পর।
তড়িঘড়ি ভুল শোধরাতে বাথরুমে ঢুকে তিনি টের পেয়েছেন, লাল-সাদা (মানে বেশি লাল সামান্য সাদা) আর সাদা-লাল (মানে বেশি সাদা আর লালের একটা স্ট্রাইপ) এই ব্রাশ দুটোর মধ্যে কোনটা তাঁর সেটা তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। কিছুতেই মনে পড়ছে না।
অগত্যা, কর্তাকেই ডেকে জিগ্যেস করেছেন তিনি কোনটা দিয়ে দাঁত মাজেন। অন্যটা তাঁর নিজের হবে তাহলে, বাই প্রোসেস অফ এলিমিনেশন।
সুযোগসন্ধানী অটলপ্রসন্ন অম্লানবদনে উত্তর দিয়েছেন, "কে জানে! যখন যেটা হাতে ওঠে।"
সেই থেকে মমচিত্তবিহারিণী খেপে আছেন, ছেলে এলেই চেন তালা কিনে তিনি নিজের ব্রাশ চাবি দিয়ে রাখবেন।
আরও পড়ুন, Short Story of Bangladesh: আশার মতো মিথ্যে নেই
একটা নতুন নীল-সাদা টুথব্রাশ, এবং তার একটা নীল খাপ এনে দিয়ে তখনকার মত পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিল তরু। যদিও তার বাথরুম আলাদা, নিজের জন্যও একটা লাল খাপ নিয়ে এসেছিল একইসাথে। কে জানে বাপু... বাবা লোকটি বড়ই ফাজিল কিনা!
কিন্তু আজ সকাল থেকে যা যা হচ্ছে সে আর কহতব্য নয়। দুপুরে বারোতলার এসি ক্যান্টিনে বসে মন দিয়ে রুটি আর চিচিঙ্গে ভাজা খাচ্ছে তরু, পায়ে পায়রা ঠুকরে দিল। আরে সত্যি পায়রা, রীতিমত দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারাস পায়রা একটা। টেবিলের নীচে নীচে নেচে বেড়াল পুরো লাঞ্চটাইম সেটা। কিন্তু এত লোক থাকতে বেছে বেছে তরুর পায়েই ঠুকরোলো কেন কে জানে!
তারপর বাড়ি থেকে ফোন, মায়ের, এবং প্রবল হাহাকার, "এই বাড়ি আসার সময়ে মনে করে বাবার নতুন হার্টের ওষুধটা কিনে আনবি। যত তাড়াতাড়ি পারিস নিয়ে আয়।"
তরু ভেবলে গেল। এই তো পরশুই ডাক্তার দেখিয়ে পুরো পনেরোদিনের ওষুধ কিনে আনল! এর মধ্যে আবার লাগবে কেন?
"কেন? এনে দিলাম যে, কী হল সেগুলো?"
ওপাশে কিসব ফিসফিস হচ্ছে শুনতে পেল তরু। এদিকে আড়াইটে থেকে মিটিং, কাজেই তাড়া লাগাতেই হল,
“বলবে, কী হয়েছে?”
“ওগুলো না…মানে…উড়ে গেছে।“
তরু রিসিভার রেখে কান খোঁচাল, চোখ কচলালো, মুখ হাঁ করে বন্ধ করল। তারপর ফোন কানে তুলে বাঘাটে গলায় বলল, “কী বললে আবার বলো। জোরে, স্পষ্ট করে। শুনতে পাইনি ঠিক।“
“উড়ে গেছে।“
“বাবা?”
“আহ অলক্ষুণে কথা বলিস কেন! বাবার ওষুধ। প্লাস্টিকে মুড়ে জানলার ধারে রেখেছিলুম, ভুল করে জানলা খুলে রেখেছিলুম। এত জোর হাওয়া দিচ্ছিল আজকে, উড়ে গেছে মনে হয়।“
“মনে হয় মানে?”
“কী জানি রে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না তো। ও উড়েই গেছে, যা হাওয়ার জোর!”
“তোমাদের সাথেই এগুলো হয় কী করে বলবে মা? যাকগে, ওষুধের নাম বলো।“
“হ্যাঁ গা তোমার ওষুধের নাম কী ছিল? অ্যাঁ? আরে আমি কোথথেকে জানব, ওষুধ আমি খাই না তুমি…”
“উফ মা, প্রেসক্রিপশন দেখে বলো না!”
“প্রেসক্রিপশন? ঐ প্লাস্টিকেই গুছিয়ে রেখেছিলুম। সেও উড়ে গেছে ওষুধের সঙ্গে তো!”
তরু দুম করে ফোন রেখে দেয়। ডাক্তারের চেম্বার ওর অফিসের পাশেই। চলে যাবে? গিয়ে কী বলবে, ‘আরেক কপি প্রেসক্রিপশন লিখে দিন তো, আগেরটা হাওয়ায় উড়ে গেছে!’?
আরও পড়ুন, ছোট গল্প: একটি কলোনিয়াল কিস্সা
পৃথুলা, গোল্ডেন চশমা পরা, সানুনাসিক গলার ডক্টর পারেখ-কে গিয়ে এটা বলতে হবে ভেবেই তরুর মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল ভয়ে। বড় বদরাগী মহিলা, খেপে গিয়ে গলাধাক্কা না দেন!
ঘন্টাখানেক পরে মিটিং থেকে বেরিয়ে তরু দেখল বাড়ির দুটো মিসড কল। কল ব্যাক করতেই বাবার ব্যারিটোন, “শোনো ওষুধ আনতে হবে না এক্ষুণি, পাশের বাড়ির ওয়াচম্যান ওদের উঠোনে কুড়িয়ে পেয়ে দিয়ে গেল।“
“মানে সত্যি সত্যি হাওয়ায় উড়ে গেছিল?”
“তাই তো দেখছি। তবে প্রেসক্রিপশনটা পাওয়া যায়নি বলল, ওটার কপি লাগবে।“
যাকগে বাবা। সে পরে আনলেও হবে, আজকেই চাই না। নিশ্চিন্ত মনে কাজ মিটিয়ে তরু বাড়ি আসে। ব্যাগ ফ্যাগ নামিয়ে, অফিসের জামা প্যান্ট ছেড়ে বারমুডা গেঞ্জি পরে খেয়াল হয়, নিজে আরেকবার খুঁজে এলে হয় – যদিই পেয়ে যায় প্রেসক্রিপশনটা!
আজকের দিনটাই আজব। মনের আনন্দে ধাঁই ধাঁই করে ধুম্বো পা ফেলে ফেলে গেট থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে বাঁক নিতেই পেটে মোক্ষম খোঁচা খেল। ডান্ডাটা নিয়ে যে লোকটা যাচ্ছিল সে কেমন যেন আপনভোলা হয়ে ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে আসছিল, খোঁচা লেগেছে টের পেতেও কয়েক মুহূর্ত সময় নিল। তারপর ভয়ংকর লজ্জা পেয়ে এই এত বড় জিভ কেটে বোঁ করে ওদের গেট দিয়ে ঢুকে পালালো।
তরু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল লোকটার উস্কোখুস্কো চুল, পরণে সাদা ফুলহাতা শার্ট আর কালো হাফপ্যান্ট, গুল্লি গুল্লি চোখে কেমন চোর চোর হাবভাব, আর হাতের ডান্ডাটা আসলে...
একটা ছিপ।
মাছধরা ছিপ।
বোম্বের রাস্তায় একটা আস্ত জ্যান্ত লোক, একটা সত্যিকারের মাছধরা ছিপ নিয়ে ঘুরছে। বোম্বের রাস্তায় তরু পেটে ছিপের খোঁচা খেয়েছে।
কেউ বিশ্বাস করবে?
অবশ্য ওষুধ উড়ে যাওয়াই বা কে বিশ্বাস করবে!
পাশের বাড়ির দারোয়ান ওকে নির্ঘাৎ পাগল ঠাউরালো। একে তো ঝোপঝাড় হাতড়াচ্ছে তায় সারাক্ষণ হিজিবিজবিজের মত হেসে কুটিপাটি হচ্ছে।
হবে না? ঐ ছিপের খোঁচা খেয়ে যে তরুর জিনের মধ্যে এদ্দিন লুকিয়ে বসে থাকা বিচ্ছুমিগুলো হুশ করে বেরিয়ে পড়েছে! এখন তার মাথায় কিলবিল করছে বদবুদ্ধি, এবং এদ্দিন ধরে বাবার পাল্লায় পড়ে মা-ছেলের নানান ভোগান্তির শোধ নেবার পরম সব আইডিয়া।
পরদিন খবরের কাগজ খুলে অটলপ্রসন্ন অতি অপ্রসন্ন হলেন। তিনটে কাগজের প্রত্যেকটার শব্দজব্দ আর সুডোকুগুলো নিখুঁতভাবে কাঁচি দিয়ে কেটে নেওয়া।