মাননীয় বিমান বসু, এখনও সময় আছে, আপনাদের ডাকা ৮ জানুয়ারির বনধ থেকে দয়া করে সরে আসুন। মানুষ বনধ চায় না। আপনাদের ডাকা বনধ তো আরও বেশি করে চায় না। তার জন্য হয়তো দায়ী আপনি নন। দায়ী আপনাদের ৩৪ বছরের শাসনের নানা অন্যায়।
বিমান বসুর সততা, ত্যাগ, সদিচ্ছা, স্বচ্ছতা, সন্ন্যাসীর মতো জীবনযাপন নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন আপনাদের এই মুহূর্তের পথ নিয়ে। টানা ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকাকালীন অজস্র বনধ আপনারা করেছেন, বনধের শেষে জনতাকে বিপ্লবী অভিনন্দন জানিয়েছেন নিয়ম করে, তাতে প্রকৃত অর্থে কতটুকু এগিয়েছেন একবার কি তার হিসেব কষে দেখেছেন কখনও?
এখনও সময় আছে, আজ যদি বনধের রাস্তা ছেড়ে আপনার মতো রাজ্যের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিক, একজন ৮০ বছরের মার্কসবাদী নেতা গান্ধীমূর্তির নীচে সিএএ-র প্রতিবাদে অনশনে বসেন, তাতে একটা বনধের থেকে হাজার গুণ বেশি সাড়া জাগানো সম্ভব। আপনাকে কেন্দ্র করে আরও বহু মানুষ গান্ধীমূর্তির নীচে আপনার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। অনশনে যোগও দিতে পারে।
আরও পড়ুন: নয়া নাগরিকত্ব আইন: ভবঘুরে রাস্তাবাসীদের কী হবে?
ধর্মঘটে আপনারা, সারা ভারতে তো প্রশ্নই ওঠে না, এই রাজ্যেও মানুষকে পাশে পাবেন না। ধর্মঘট হাস্যকর রকমের ব্যর্থ হবে। এমনিতেই আপনাদের জনসমর্থন এখন কমতে কমতে ১০ শতাংশের নীচে। কোথাও কোথাও ৫ শতাংশেরও নীচে। আপনাদের রাজনীতি-সচেতন বিপ্লবী সমর্থকদের রক্তেই পুষ্ট হয়ে বিজেপির আজ ১৮টা আসন লোকসভায়। আপনাদের সংগঠনে সেই ক্ষয় এখনও অব্যাহত। লোকসভা ভোটের আগে এমন যে ঘটতে চলেছে, আমরা সাংবাদিকরাও লিখেছিলাম, আপনাদের কাছেও খবর ছিল। কিন্তু আপনারা জেনে-শুনে সেটা আটকানোর জন্য কোনও পদক্ষেপ নেন নি। তখন মমতা এক নম্বর শত্রু। ফলে যা হচ্ছে হোক, এই ছিল আপনাদের লাইন।
আপনারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিজেপি-সম্পর্কের অতীত নিয়ে বলে যান। ভুল নয়। কিন্তু সাভারকারের শিষ্যদের নানাভাবে সমর্থন তো আপনারাও দিয়েছেন। রাজীবকে সরাতে সাভারকারের শিষ্যদের আড়াল থেকে সমর্থন করাটা যে ভুল হয়েছিল, আজ তো তা প্রমাণিত। সাভারকারের একনিষ্ঠ শিষ্যদের হাত ধরে কলকাতায় আপনারা সভা করেছেন, সে ছবি তো পুরোনো কাগজ খুঁজলে যে কেউ দেখতে পারে।
'না দেখি মাছ, শুধু ছুঁই পানি' মানসিকতা নিয়ে ভি পি সিংদের সঙ্গে বামপন্থীরাও কংগ্রেসকে হটাতে যেটা করেছিল, সেটা হল সাভারকরের শিষ্যদের দলের গা থেকে সাম্প্রদায়িক তকমাটা একটু ঝাপসা করে করে দিয়েছিল দেশের মানুষের কাছে। তার ফলেই তাদের আসন এক লাফে ১৯৮৪-তে দুই থেকে বেড়ে ১৯৮৯-এ হয়েছিল ৮৪। আজ প্রমাণিত, ওই সমর্থনের ফলে সবার রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছিল, একমাত্র লাভবান হয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা।
ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা রাজ্যে যা করেছেন, আপনারা সারা দেশে তাই করেছেন, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপিকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে সাহায্য করেছেন। একথা দেশের মানুষের কাছে জলের মতো পরিষ্কার, সিপিএম, টিএমসি, কংগ্রেস, কেউই সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল নয়। সিপিএম এবং টিএমসি, দুটো দলই তাৎক্ষণিক লাভের আশায় সাভারকারবাদীদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেঁছে। ক্ষতি হয়েছে উভয় দলেরই। তবে যদি প্রশ্ন ওঠে, কোন দল বেশি সাহায্য করেছে বিজেপিকে? সর্বভারতীয় রাজনীতির বিচারে উত্তর অবশ্যই, বামপন্থীরা।
আরও পড়ুন: জাতীয়তা ও নাগরিকত্ব
মাননীয় বিমানবাবু, এই মুহূর্তে খোঁজ নিয়ে দেখুন, সারা ভারতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিএএ-বিরোধী লড়াই ইতিমধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা নিয়ে নিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ ঘুরে আসা সাংবাদিকদের মুখে শুনেছি, বন্দুক-প্রিয় যোগীর রাজ্যে বহু মানুষ তাকিয়ে আছেন মমতার দিকে। বিশ্বাস করেন তাঁরা, 'মমতাদি'-ই পারেন সিএএ রুখতে। মমতাকে কেউ পছন্দ করুন বা না করুন, মমতা এখন দেশের রাজনীতিতে সিএএ-বিরোধী মুখ্যমন্ত্রীদের তালিকায় এক নম্বরে। পরে পিনারাই বিজয়ন সহ একের পর এক মুখ্যমন্ত্রী তাঁর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এমনকি ধীরে ধীরে বিজেপি সহযোগী অনেক দলের মুখ্যমন্ত্রীরাও বাধ্য হয়ে কার্যত মমতার পিছনেই।
হিন্দুত্ববাদীরা গরু, গোবর, ত্রিশূল, হনুমান, লিঞ্চিং, পাকিস্তান-ভিত্তিক একটা মুসলিম-বিরোধী ভারতের চর্চা শুরু করেছিল হিন্দু রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপনের প্রথম ধাপ হিসেবে। এগিয়েওছিল বেশ খানিকটা। তারই প্রতিবাদে, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন, সেখান থেকে উঠে এল হিন্দুত্ববাদীদের পাল্টা এক ভারত। যেখানে ফিরে এসেছে ভুলে যাওয়া ফয়েজের সুর, শোনা যাচ্ছে জাতীয় সঙ্গীত, তরুণ প্রজন্ম প্রতিজ্ঞা করছে সংবিধান রক্ষার জন্য আপ্রাণ লড়াইয়ের।
এখানেই ১৯৭৪-এর তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের এবং আজকের আন্দোলনের ফারাক। সংবিধান রক্ষায়, জাতীয় পতাকার প্রকৃত সম্মান প্রদর্শনে এর আগে কখনও স্বাধীন ভারতের তরুণ প্রজন্ম রাস্তায় নামেনি। সেই কারণেই এই আন্দোলন মহৎ।
আরও পড়ুন: নতুন বছরে পুরোনো দেশ, এবং নাগরিকত্বের বিদেশ গমন
বিমানবাবু, মনে করিয়ে দিই, সেই সংবিধান, ১৪-০১-৫০-এর এক পার্টি চিঠিতে যে সংবিধানকে বলা হয়েছিল, "২৬ জানুয়ারি যে সংবিধান চাপানো হবে তাতে রয়েছে ফ্যাসিস্ট ডিক্টেটরশিপ প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা....রিপাবলিক নামটা ব্যবহার করে নেহরু সরকার মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। ওই দিন দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখানোর ডাক দেওয়া হলো। যাতে ‘বুঝে নিক আমেরিকান আর ইংরেজ যুদ্ধবিলাসীরা যে বৃথাই তাদের নেহরু-প্যাটেলের উপর ভরসা করা’ (উত্তাল চল্লিশ অসমাপ্ত বিপ্লব, অমলেন্দু সেনগুপ্ত)।"
ঠিকই, এই অবস্থান আপনারা ফেলে এসেছেন। কিন্তু চিন্তায় কতটা পরিবর্তন এসেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুযোগ কিন্তু এসেছে আবার। এই আন্দোলনে, শুধুমাত্র এই আন্দোলনের জন্য, মমতার পাশে দাঁড়ান। ধর্মঘট প্রত্যাহার করুন। যদি প্রতিবাদ জানাতে হয়, গান্ধীমূর্তির নীচে অনশন করুন। সমর্থন করবে মানুষ। ধর্মঘটে গেলে এখনও যে সাত-আট শতাংশ সমর্থন আপনাদের পক্ষে আছে তা আর কমার হয়তো জায়গা নেই, কিন্তু বঙ্গ রাজনীতিতে একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার সম্ভাবনা পাকা হয়ে যেতে পারে। সেই বিষয়ে সাবধান করতেই এই লেখা।
(শুভাশিস মৈত্র বর্ষীয়ান সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়তে ক্লিক করুন এই লিংকে