Advertisment

অমিতাভ বচ্চনের মুখোশ খুলতে চেয়েছিল অমর সিং, কেন?

অমর সিং বলেছিল, "এ বি সি এল-এ যখন অমিতাভ ঋণগ্রস্ত, তখন কে ওকে বাঁচিয়েছিল সেটা ও ভুলে গেছে...!"

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
amar-singh-passes-away-samajwadi-party-bachchan-family

শেষের দিকে অমর খুব চটে ছিল অমিতাভ বচ্চন আর জয়ার উপর।

কোরোনা কান্ড শুরু হওয়ার আগেও ঘন ঘন ওঁর সঙ্গে দেখা হতো। দেখা হত দিল্লির অভিজাত বাজার- খান মার্কেটে। মানুষটি অমর সিং। এই বাজারে কেন আসতেন তিনি?

Advertisment

শুনলে অবাক হবেন। অমর সিংহ এখানে আসতেন পুরোনো হিন্দি আর বাংলা ছবির ডিভিডি কিনতে। সঙ্গে থাকত সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী, ব্ল্যাক ক্যাট। একদিন ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এখন তো ইউ টিউব জমানা। ডিভিডি কেনেন কেন? তিনি বললেন, "আমি ওসব পারি না। আমার এখনো ডিভিডি প্লেয়ারে আরাধনা, গাইড বা উত্তম কুমারের সপ্তপদী দেখতে ভালো লাগে।"

publive-image অমর সিং।

দোকানটার নাম- মার্কারি। মালিকের নাম- দীনেশ আগরওয়াল। ডিভিডি বাছাইয়ের মধ্যেই আলোচনা হত রাজনীতি। মোদী-মুলায়ম থেকে মমতা।

অমর সিং উত্তর প্রদেশের ঠাকুর হলেও আসলে বলা যায় 'মেড ইন বড় বাজার'। ব্লক কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন। সুব্রত মুখার্জির চ্যালা ছিলেন, সেখান থেকে দিল্লি-লখনৌ, ক্ষমতার অলিন্দে এক বড় চরিত্র হয়ে উঠলেন। তখন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সংসদে আড্ডা হচ্ছে। প্রিয় দা' রসিকতা করে বলেছিল, বুঝলি একটা সময় ছিল যখন অমরকে আমরা দেখতাম। আর এখন তো ওই আমাদের দেখতে পারে।

আরও পড়ুন- মমতার জন্য সরষে পাবদা আনাতেন সোমেন দা

মূল্যবোধের রাজনীতি থেকে ভারতের রাজনীতি ক্রমশ ক্ষমতার রাজনীতিতে চলে গেলো নিঃশব্দে। অমর সিং এই পরিবর্তনের সাক্ষী। বরং বলা যায়, অমর সিং নিজেই এই রূপান্তরের এক প্রতীক।

publive-image মুলায়ম-অমর।

অমর সিং-এর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন আজকের বিশিষ্ট তৃণমূল নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়। ১৯৯৮৮ সাল। দিল্লির সরকারি মানে আই টি ডি সি-র হোটেল সম্রাটে তখন এলে সুব্রত দা থাকতেন। অমর সিং হোটেলের ঘরে এসেই বলল, "ফিশ ফ্রাই খাবো!" সেদিনই প্রথম শুনলাম, অমর সিং খেতে খুব ভালবাসেন। সে খাদ্য প্রেম তো এই কদিন আগেও দেখলাম। কিডনির অপারেশন হওয়ার পরেও দেখতাম বিয়ের অনুষ্ঠান বা দিল্লির পার্টিতে জমিয়ে খেতে। সাধারণত দিল্লির পার্টিতে রাজনৈতিক নেতারা খেতে চান না। শো অফ-এর সেরা রাজধানী দিল্লি। রাজনেতা উপবিষ্ট। নিরাপত্তা কর্মীরা ঘিরে আছে। কোনো অনুচর এনে দেবে হয়তো এক প্লেটে রসমালাই অথবা মাছ ভাজা। অমর সিংহের এসব পছন্দ ছিলো না। ব্যুফেতে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে হাতে প্লেট নিয়ে তিনি বার বার গিয়ে খাবার নিতেন। আর কাছাকাছি টেবিলে বসতেন।

অমর সিং-এর স্ত্রীকে সাধারণত বাইরে দেখা যেত না। ওখানে একটু রাজপুত ঘরানার সাবেকি রক্ষণশীলতা ছিল, কিন্তু ওঁর বাড়িতে গেলে দেখতাম তিনি তাঁর স্বামীর খুব যত্ন করেন। খাওয়া দাওয়া একদম নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু বাইরে এলে অমর নিয়ম ভঙ্গ করতো।

আরও পড়ুন- কিশোরী অমলাকে নেতাজিই উদয়শঙ্করের কাছে পাঠিয়েছিলেন

গেট ক্রাশার হিসাবেও অমর খুব বিখ্যাত হন। সিপিএম নেতা হরকিষেন সিং সুরজিৎ-এর গাড়ি চেপে সনিয়া গান্ধীর বাড়ি ১০ জনপথে গিয়ে। ২০০৪ সালে কংগ্রেস সরকার গঠনের প্রাক্কালে। এমনই ছিল অমর সিংহ। একবার এক কংগ্রেস নেতা বলেছিলেন, অমর হচ্ছে ভারতের রাজনীতির রাসপুটিন।

publive-image অমর-অখিলেশ।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হলে, ঝগড়া হলে আবার ভাব করে নিতেন তিনি। প্রথম জীবনে ছিলেন কে কে বিড়লার ঘনিষ্ট। স্নেহভাজন। বিড়লারা কংগ্রেসের ঘনিষ্ট। আবার কলকাতায় বাড়ি। বাংলায় কথা বলা মাড়োয়ারি। ওখানেই ওদের পাটকল। তারপর অমর হল শোভনা ভারতীর ঘনিষ্ঠ। আবার তার হাত ধরে মাধব রাও সিন্ধিয়া। তিনি বিমানমন্ত্রী, অমর হলেন এয়ার ইন্ডিয়ার বোর্ড সদস্য। মধ্য প্রদেশ থেকে এআইসিসি-র সদস্য! পরে এই অমর, অনিল আম্বানি তারপর মুকেশেরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন!

এমনকি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও ঝগড়া মেটাতে চেয়েছিলেন অমর। মোদী দেখা করার জন্য সময় দিচ্ছিলেন না প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর। কারণ, অমর অরুণ জেটলির সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতেন। সংসদে সেই সাংসদদের ক্যাশ টাকা নিয়ে আসার বিতর্কে স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি বিজেপি-র ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অরুণ জেটলির নাম জড়ানোরও চেষ্টা হয়।

লালকৃষ্ণ আডবাণীর বিবাহ বার্ষিকী। কমলা আডবাণী তখন আছেন। মোদী এসেছেন। খুব কম লোক। হঠাৎ দেখি, অমর সেখানে। এসেই সোজা মোদীর কাছে গিয়ে বললেন, "দলগত বিরোধ যাই থাক। আমার সঙ্গে দেখা তো করুন। তখনো সম্ভবত অমর রাজ্যসভা সদস্য"।

publive-image সংসদ চত্বরে অমিত-অমর।

ইকোনমিক টাইমস-এ সাংবাদিক প্রভা জগন্নাথন একবার দু'য়ের পাতায় মানে রাজনীতির পাতায় একটা ছোট্ট খবর লেখে- মুলায়ম সমাজ বাদী পার্টির সম্পাদক পদ থেকে অমরকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সকালে সে খবর পড়ে অমর, প্রভাকে ফোন করে বলে খবরটা ঠিক নয়। আসলে তখন থেকেই নেতাজির পরিবার অমরকে উত্তর প্রদেশ রাজনীতি থেকে সরাতে চাইছিল। অমরকে প্রভা বলে, "টাইমস-এ তো বেরোয়নি! সার্কুলেশন তো ইকোনমিক টাইমস-এর চেয়ে ওটার বেশি।" জবাবে অমর বলেছিল, "সে জন্যই তো সমস্যা বেশি। কারণ এই পিঙ্ক পেপার তো সকালে আম্বানি পড়ে। ব্যবসায়ীরা পড়ে, সেটাতেই আমার বিপদ বেশি। যা হোক পরদিন ভুল সংশোধনী ছাপা হয়েছিল।

নরসিংহ রাও তাখন প্রধানমন্ত্রী। বরুণ সেনগুপ্তর সঙ্গে গেছি তিরুপতি কংগ্রেস অধিবেশন। ছোট শহর তিরুমালাই। ভালো হোটেল হাতে গোনা। বরুণবাবু আগে থাকতে আমাদের হোটেল বুক করে গেছেন। দেখি হোটেলের লবিতে উদ্ভ্রান্তের মতো অমর সিংহ ঘুরছে। বরুণবাবু কে দেখে অমর বললো,"এখন শেষ মুহূর্তে শোভনা আসছে, ওঁর জন্য একটা ভাল ঘর খুঁজছি।" এটাই অমর সিংহ!

শেষের দিকে খুব চটে ছিল অমিতাভ বচ্চন আর জয়ার উপর। আমাকে অমর সিং বলেছিল, "এ বি সি এল-এ যখন অমিতাভ ঋণগ্রস্ত, তখন কে ওকে বাঁচিয়েছিল সেটা ও ভুলে গেছে! নেতাজী মানে মুলায়ম বা ওঁর ছেলে অখিলেশ, ওঁরা না হয় রাজনেতা কিন্তু অমিতাভ তো তা নয়?" সমাজবাদী পার্টিতে অমরের ক্ষমতা খর্ব হওয়ার পর এক সময় খুব কাছের জয়াপ্রদাও তাঁকে ব্যথা দিয়েছিলেন। বিজেপি-তে নাম লিখিয়েছিলেন অভিনেত্রী।

publive-image তখন সম্পর্কের উষ্ণতা ভরপুর।

অমর সিং-এর অমিতাভ কে নিয়ে একটা বই লেখার খুব ইচ্ছে হয়েছিল। বলতো, "লিখে এক্সপোস করবো। একটা ভালো সাংবাদিক যোগাড় করে দেবে যে লিখবে।" আমি বললাম, "ঘোস্ট রাইটার চান?"

publive-image সংসদে জয়া বচ্চন ও অমর সিং।

অভীক সরকারকেও বলতো, "আমি লিখতে চাই।" আমাকে বলেছিল, "অভীকবাবুর কন্যা চিকি সরকার তো মস্ত বড় পাবলিশার। ওকে অনুরোধ করেছি"। শেষ পর্যন্ত সে বই অমর সিংহ লিখে গেছে কি না জানি না। কখনো জিজ্ঞেস করিনি পাণ্ডুলিপি কত দূর? কিন্তু শুনেছিলাম, মুকেশ আম্বানি ওঁকে অমিতাভের বিরুদ্ধে লিখতে মানা করেছিল। কাদা ছোড়াছুড়ি না করাই ভালো।

আর আজ তো অমর সিং সব কাদা ছোড়াছুঁড়ির উর্ধ্বেই চলে গেল। একটু তাড়াতাড়িই।

(লেখক দিল্লি নিবাসী প্রবীণ সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত।)

amitabh bachchan Delhi Theke Bolchi
Advertisment