প্রথমেই একটা নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা। ৩৫এ আর ৩৭০ তো হারিয়েছেই। আচ্ছা, কেউ কি বলতে পারেন যে কাশ্মীরে সিপিএমের বিধায়ক তারিগামি ঠিক কোথায়? সে রাজ্য এখন ভাগ হয়ে দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল, একটায় বিধানসভা আছে, অন্যটায় সেটাও হারিয়েছে। বড় বড় নেতানেত্রীরা ঘরবন্দী না অতিথিশালায় সে নিয়ে আলোচনা অব্যাহত। ফারুক আবদুল্লা ঘরেই আছেন, আর বাইরে পাহারায় পুলিশ। আশি পার করা এই জননেতার স্বাস্থ্য নিয়ে বেদম চিন্তিত ডিএমকে সাংসদেরা। সে প্রশ্নে দেশের দ্বিতীয় সর্বশক্তিমান নেতা উত্তর দিয়েছেন যে তিনি ডাক্তার নন, ফলে ফারুক সাহেবের স্বাস্থ্য নিয়ে তিনি আলোচনা করতে অসমর্থ। তবে তাঁকে নাকি ঘরবন্দী করা হয় নি।
কান পাতলে শোনা যাচ্ছে ফারুকবাবুর পুত্র ওমর আর মুফতি সাহেবের কন্যা মেহেবুবা মহাশয়াকে সম্ভবত বাড়ি থেকে সরিয়ে অতিথিশালায় আটকে রাখা হয়েছে। এখনও শীত আসে নি। হাওয়া ঠাণ্ডা হলেই সম্ভবত তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। এটুকুই ভরসা যে এঁদেরকে নিয়ে শব্দ খরচ হচ্ছে যথেষ্ট। ফলে মাঝে মাঝে তাঁদের খোঁজ নেবে সংবাদমাধ্যম। কিন্তু তারিগামিকে নিয়ে সে তুলনায় তথ্য প্রায় নেই। হবেই তো, যে দলের সারা দেশে প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গেছে, সেখানে দুভাগ হওয়া রাজ্যের বাম বিধায়কের খবর নেওয়ার মত সংবাদরসিক কম। দলীয় মুখপত্রে হয়তো কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে গভীর কিছু লেখা হচ্ছে, কিন্তু তার পাঠক সংখ্যা সীমিত। ফলে ডানপন্থীদের এই শ্রাবণ মাসে সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারাত বাজারি গণমাধ্যমে বিশেষ জায়গা পাচ্ছেন না।
আরও পড়ুন: ভারত-পাক কূটনৈতিক সম্পর্ক: এবার কী
এমনটাও হতে পারে যে সর্বভারতীয় মিডিয়ায় এই পরিস্থিতিতে বিশেষ জায়গা চাইছেন না তাঁরা। বহু খুঁজে জানা গেছে যে গত বুধবার সিপিএমের ইয়েচুরি আর সিপিআইয়ের রাজা নাকি শ্রীনগর যাওয়ার পথে বাধা পেয়েছেন। বাধা পাওয়াই ভাল, কারণ এরকম টালমাটাল সময়ে বেশি বামপন্থা কপচাতে গেলে শেষ কয়েকটা ভোটও পকেট ফুটো করে অমরনাথ যাত্রায় সামিল হবে। করবেনই বা কী? কেন্দ্রীয় সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার সমর্থনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা সমর্থনের ঢেউ বইয়ে দিয়েছেন। কংগ্রেসের বিভিন্ন কর্মকর্তাও প্রকাশ্যে সমর্থন করছেন এই সিদ্ধান্ত। রাহুল গান্ধীর টুইটার কিছু দুশ্চিন্তার কথা বলছে বটে, কিন্তু তাও কেমন ছাড়াছাড়া। দিদি বলেছেন পদ্ধতিগত ত্রুটি, আর ভাইয়েরা প্রতিবাদে ভোটাধিকার প্রয়োগে বিরত থেকেছেন।
বিরোধিতা কণ্ঠেই থাকল, সংখ্যায় নয়। কাশ্মীর নিয়ে দেশের মধ্যে উল্টো সুর গাইতে গেলে দেশদ্রোহীর পাওনা ছাপানো হয়ে গেছে - “স্বাধীনতার সময় টুইটার থাকলে বোধহয় ব্যাটা দেশকে পরাধীন রাখার কথাই বলত!” সোজা কথায় এদেশে এখন সামরিক জাতীয়তাবাদের জয়জয়কার। অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রাজ্য ভাগ করেছেন দোর্দন্ডপ্রতাপ শাসকেরা। কেটে গেছে, একটুও রক্ত পড়ে নি। ঠিকঠাক রসায়নে রাজ্যবাসীর অসাড়করণ সম্পূর্ণ। 'ভূস্বর্গ ভ্যাবাচ্যাকা' নামের রহস্যোপন্যাস লিখবেন বলে ভাবছেন লালমোহনবাবু।
গোটা ব্যাপারটা বুঝতে ইমরান কাকুর দিন দুয়েক সময় লেগেছে। তারপর তিনি ১৫ অগাস্টকে 'কালা দিন' বলে ঘোষণা করেছেন। প্রথমে বোধহয় চোদ্দ তারিখটাকেই আঁধারে ঢাকবেন ভেবেছিলেন। পরে বুঝেছেন হিসেবের গণ্ডগোলে পাকিস্তানের স্বাধীনতা একদিন আগে গুছিয়ে নেওয়া হয়েছিল! দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক আপাতত কাঁচির ডগায় কাগজের টুকরো। বেওসা খতম! ভারতের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করলে তাঁর নিজের দেশের কী হবে সেটুকুও ভাবার মত পরিসর জাতীয়তাবাদ দেয় না। ক্রিকেট অধিনায়কের আড়ালে তাই সেখানে এখনও সামরিক সরকার।
আরও পড়ুন: সংবিধানের ৩৭১ নং অনু্চ্ছেদে আছেটা কী?
মার্কিন দেশের অবস্থাও একই। বিপুল ভৌগলিক দূরত্বে গোলটার উল্টোদিকে থাকলেও, ক্ষমতাশালী হিসেবে কিছু তো একটা বলতেই হবে। তাই ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রশাসন নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে কয়েকটি শব্দ বলে দিয়েছেন। কিছু একটা, তাই সারমর্ম না জানলেও চলবে। চিন নাক গলাবে না তা কি হয়? মান্দারিন হরফের নামাবলী গায়ে জড়িয়ে তারাও বলেছে দুই পড়শী দেশ সুসম্পর্ক বজায় রাখুক। মনে এক, মুখে আর এক। নামে বামপন্থী দেশ হলেও হংকং-এর ওপর তাদের আগ্রাসন নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ভারত সীমান্তের দিকে পুকুরপাড়ের বকের মত দৃষ্টি।
সেই জন্যেই তো দেশপ্রেমিকদের বুকটা ফুলে ওঠে যখন দেখা যায়, বেশ গুছিয়ে কথা বলছে ভারত। দু-একজন নগর নকশাল ছাড়া সবাই এখন বিজেপি। দেশের ভাষাই মানুষের ভাষা। সারা বিশ্বকে ভারতবাসী দেখিয়ে দিতে পেরেছে যে মানুষের সমান অধিকারের দাবিতে তারা কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে। সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর দ্বন্দ্বে দ্বিতীয়জনকে যে গুরুজনের কথা শুনতেই হবে, এটা বেশ বুঝিয়ে দেওয়া গেছে। তাই ভারতের কাশ্মীরায়ন নয়, কাশ্মীরের ভারতায়ন-ই দেশপ্রেমের শর্ত। বিবিধের মাঝে একচ্ছত্র ক্ষমতাই পারে সবাইকে মিলিয়ে দিতে। সেটাই তো সমানাধিকারের তত্ত্ব, যেখানে ক্ষমতা থাকবে একটু বেশি সমানের হাতে, আর কম সমানেরা পাতি জনগণ। সেখানেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংবিধানে লিখে রাখা গণতন্ত্রের সঠিক রূপায়ণ।
একজন কাশ্মীরি যে আসলে ভারতীয়, এই বিষয়টা অনুধাবন করতে যাঁদের অসুবিধে হচ্ছিল, তাঁদের সামনে বারোতে এগারো পাওয়ার মত ভাব-সম্প্রসারণ লিখলেন অমিত পরাক্রমশালী শাহ মহাশয়। নেহাত বড় প্রশ্নে কাটতে হবে বলে এক নম্বর বাদ। নইলে পুরোটাই এক ডজন গল্প। একেই বলে বাড়ি তৈরির লৌহশলাকার মত মেরুদণ্ড! নমনীয় (লগবগে নয়) এবং শক্তিশালী। এরকম দৃঢ়-সঙ্কল্প সরকারকে একমাত্র চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করা যায়। সে জন্যেই তো ধারা মুছে যাওয়ার আনন্দে আলোকমালায় সেজে উঠলো সংসদ। সরকার আর একটু ক্ষমতাবান হলেই লাড্ডু আর বানাতে হবে না, একেবারে গাছে ফলবে। বেয়ার গ্রিলের সঙ্গে অভিযানে যাবেন দেশ নেতারা।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর, ৩৭০ ও ম্যাকিয়াভেলি বনাম কলহন
তবে ডানপন্থার মধ্যেও একটা নমনীয়তা থাকে। যেমনটা ছিলেন বাজপেয়ীজি। পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা করা হয়েছিল, একথা সত্যি, পাক অনুপ্রবেশের ফলে কার্গিল ঘটেছিল, সেটাও সত্যি, কিন্তু পড়শী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তের যুদ্ধ যুদ্ধ প্রচার-খেলা ছিল না। জাতীয়তাবোধে সেই বিজেপি খুব একটা পিছিয়ে ছিল না, তবে জাতীয়তাবাদের তীব্রতা ছিল কম।
ঠিক সেই রকমই এক নেত্রী সদ্য অতীত শ্রদ্ধেয় সুষমা স্বরাজ মহাশয়া। রাজনীতি ভুলে যে কোন স্তরের দেশবাসীর বিপদে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বারবার। ব্যক্তি, দল এবং রাষ্ট্রের চাহিদার দ্বন্দ্ব অবিরত সামাল দিয়েছেন এই অধিনায়িকা। বিজেপির শীর্ষ পদের সঠিক দাবীদার ছিলেন তিনি। তবে রাজনৈতিক সমীকরণে পৌঁছন হয় নি সর্বোচ্চ পদে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে পথে নামতে পারেন নি। যে দুটি ধারার অবলুপ্তি নিয়ে আজকে এত আলোচনা, নব্বইয়ের দশক থেকে তাই নিয়ে লড়াই করেছেন এই জননেত্রী। রাজনীতিতে তো ভিন্ন মত থাকবেই, কিন্তু এই দুই ধারা চালু রাখার বিপক্ষে দীর্ঘ সময় ধরে বিজেপির হয়ে সবচেয়ে যৌক্তিক মতামত পেশ করেছেন তিনি। তবে সেই মতামতে তীব্র আগ্রাসনের তুলনায় দেশকে একই কাঠামোর মধ্যে রাখার বিশ্বাস ছিল অনেক বেশি। মৃত্যুর ঠিক আগেই তিনি দেখে যেতে পেরেছেন এই দুই ধারার অবলুপ্তি। সমর্থনের সুরে টুইট করেছেন তাই নিয়ে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীরের ‘ভারতীয়ত্ব’ নয়, ভারতের ‘কাশ্মীরায়ণ’
হয়তো বা এমনটাই সময়ের সমাপতন। মূল প্রশ্ন তো আর দুটো ধারা নিয়ে নয়। সব ধারারই কিছু ভাল থাকে আর কিছু খারাপ। তাই নিয়েই তো রাজনীতির ধারাপাত। কিন্তু সংশয় জাগছে এই দুই ধারার অবলুপ্তির পর দেশের কিছু অংশে বিজেপি সমর্থকদের উল্লাস নিয়ে। সংবাদমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশে কোন এক বিজেপি বিধায়কের কাশ্মীরী মহিলাদের বিবাহ করার সুযোগ সংক্রান্ত বক্তব্য। সেই কারণেই অনেকে শঙ্কিত হচ্ছেন কাশ্মীরের সাম্প্রতিক নিস্তব্ধতা নিয়ে।
এই পরিস্থিতিতে সুষমা স্বরাজ মহাশয়ার প্রয়াণ দেশের পক্ষে এক বড় ক্ষতি। তিনি যা চেয়েছিলেন সেটাই হয়েছে, কিন্তু তা ঘটে যাওয়ার পর তাঁর দলের প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই বাঁধন-ছাড়া। সদ্যপ্রয়াত নেত্রীর রাজনীতি কখনও চরমপন্থার শেকলে বাঁধা পড়ে নি, তা ছিল সকলকে নিয়ে একসাথে পথ চলার। তাই তাঁর চলে যাওয়ার কথা মনে রেখে আজকের রুক্ষ পরিস্থিতিতে একটু চোখের জল যদি দেশের মাটিকে শীতল করে, সেটাই হবে সুষমাজির প্রতি সময়োচিত সম্মান প্রদর্শন।
প্রতিযোগিতামূলক সামরিক জাতীয়তাবাদের উল্লাস তরঙ্গে এই শোকের সময়ে বাঁধ দেওয়া যাবে কি? গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে কিন্তু উঠে এসেছে যে ৩৫এ এবং ৩৭০ ধারা বিলোপ সম্পর্কে দেশের মধ্যে বিরোধী মত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। আপাতত এটুকুই সান্ত্বনা!
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)