নাগরিকপঞ্জি বা এন আর সি নিয়ে আসামে যে মন্থন চলছে তা যেন অতীতের হিংস্রতাগুলোকে টেনে টেনে ওপরে তুলছে। গোষ্ঠীগত সন্দেহ, সুরক্ষহীনতা, অবিশ্বাসের বাতাবরণ ঘণ হয়ে উঠছে। আশির দশকের জাতিগত দাঙ্গার স্মৃতি মনের কোন কোণায় লুকিয়ে ছিল। ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। সেই হিংস্রতারা নতুন অবতারে ফিরে আসছে। হুবহু আগের রূপে ফিরে আসছে না অবশ্য। তখন যূথবদ্ধ সশস্ত্র ভিড় অসহায় মানুষকে ঘিরে ধরে খুন করত, বাড়িতে আগুন লাগাত। এখন রাষ্ট্রের আইনি অত্যাচার এন আর সি-ছুটরা নিজেদের মধ্যেই আত্মস্থ করে নিচ্ছে। আত্মস্থ হিংস্রতার জেরে নিজেদেরই খুন করে ফেলছে। কেবল হিন্দু বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেই এন আর সি-সংক্রান্ত আত্মহত্যার সংখ্যা কুড়ি ছাড়িয়েছে। তাতেও মৃত্যুমিছিল থামছে না। ১ নভেম্বরের রাতে পাঁচ ছ’জন বন্দুকধারী সুদূর পূর্ব আসামের তিনসুকিয়া জেলার প্রত্যন্ত এক গাঁ থেকে কিছু যুবককে তুলে নদীর পারে নিয়ে যায়। তাদের সারি দিয়ে বসতে হুকুম দেয়। অতঃপর গুলি চলে। শেষ হিসেবে পাঁচ জন মারা গেছেন। এঁরা সবাই দরিদ্র শ্রমজীবী হিন্দু বাঙালি, সম্ভবত নমঃশূদ্র। আলফা (স্বাধীন), মানে যেটা আলফার বে-আইনি অংশ, এই হত্যাকাণ্ডের দায় অস্বীকার করেছে। কেন হিন্দু বাঙালিদের চাঁদমারি করা হল, এই প্রশ্নটা মনে আসা স্বাভাবিক। তার উত্তর বোঝার জন্য গত কয়েক বছরের আসামের রাজনীতির চলনকে জানতে হবে।
মণীষীদের মত হল, ইতিহাসের যখন পুনরাবৃত্তি হয় ট্র্যাজেডি ফার্স হিসেবে ফিরে আসে। করুণ রস প্রহসনে পরিণত হয়। আসামের প্রহসন পালার এক চিত্তাকর্ষক চরিত্র শিলাদিত্য দেব। শিলাবাবু বাঙালি অধ্যুষিত হোজাই বিধানসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত বিজেপি সদস্য। ওঁর দিনকাল এখন ভাল যাচ্ছে না। সরকার বাহাদুর জেলাপ্রতি এন আর সি-ছুটদের তথ্য প্রকাশ করেন নি, তবে অসমর্থিত সূত্রের খবর হোজাইয়ে এন আর সি-ছুটের পরিমাণ বিপুল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাঙালিরা আসামের স্থানীয় নয়। স্থানীয় যারা নয় তাদের জন্য এন আর সি’র চৌকাঠ উঁচু রাখা হয়েছে। ফলে বহু বাঙালি, যাঁরা পুরুষানুক্রমে আসামবাসী এন আর সি থেকে বাদ পড়েছেন। ভোটারদের কাছে সময়টা সুখের নয়, তাই শিলাবাবুও চাপে। ইতিমধ্যে শিলাবাবুর দল বিজেপি’র প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ এন আর সি-ছুটদের ঘুসপেটিয়ে (অনুপ্রবেশকারী) আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভারতধ্বংসী উইপোকা বলেও গাল পেড়েছেন। শিলাবাবুর সংকট গভীর।
আরও পড়ুন, আসাম গণহত্যা: আপন হারিয়ে এখনও শোকে বিহ্বল ওঁরা
শিলাবাবু নিজেও ধোয়া তুলসীপাতা নন। উস্কানিমূলক মন্তব্য করার ব্যাপারে ওঁর নামডাক আছে। ওঁর বক্তব্যের ধরতাইটা এরকম- আসামের বাসিন্দা মিঞারা (বাংলাভাষী মুসলমান) বাংলাদেশি। এদিক দিয়ে উনি অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কাছাকাছি। বহিরাগত মিঞাদের উগ্র জাতীয়তাবাদীরাও দেখতে পারেন না। বাংলাদেশি তকমা গায়ে সেঁটে দিলে লোকগুলোকে হয়রানি করা যাবে, বৈধতা কেড়ে নেওয়া যাবে -- অতএব বাংলাদেশি বলে ডাকো। শিলাবাবুর পক্ষে বাংলাদেশি রাজনীতি করাটা ঝুঁকির, কারণ উনি নিজে বাংলাভাষী। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা বাংলাভাষী হিন্দুদের গায়েও বাংলাদেশি তকমা লাগাতে আগ্রহী হতে পারে। এই সম্ভাবনা নাকচ করতে শিলাবাবুর হাতে দ্বিতীয় অস্ত্র হচ্ছে, মিঞারা জেহাদি, ভারতকে ইসলামি রাষ্ট্র তৈরি করার ষড়যন্ত্র করছে। আসামের বৈষ্ণব সত্রগুলোর জমি দখল করছে।
উগ্র জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে হিন্দুধর্মের সেতু বাঁধার এইসব কলাকৌশল নতুন নয়। সংঘ পরিবারের রাজনীতির ভিত সচরাচর এমন মুসলমানবিদ্বেষী কলাকৌশলের ওপরেই গড়া হয়। তবে শিলাবাবুর কায়দাগুলো কেবল বিপজ্জনকই নয়, সেগুলো বিস্ফোরক পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে। কারণ, কায়দাগুলো এমন সময়ে করা হচ্ছে যখন রাজ্য অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। ৪০ লক্ষ মানুষের নাগরিকত্ব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। জাতিগত শান্তির ক্ষেত্রে এ রাজ্যের সুনাম নেই। সাম্প্রতিক ইতিহাসে জাতিদাঙ্গা, গণহত্যা হয়েছে। এই অবিশ্বাসের বাতাবরণে বিজেপির আনা ২০১৬-র নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বাড়তি জ্বালানি জোগাচ্ছে। বিল বলছে বাংলাদেশি হিন্দুদের ভারতে কাগজপত্র ছাড়াই আশ্রয় দেওয়া হবে, পরে ন্যাচরালাইজেশন মারফত নাগরিকত্ব দেওয়া যেতে পারে। লক্ষ্যণীয়, এর ফলে যেসব হিন্দু বাঙালিরা এন আর সি থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁরা বৈধতা পেয়ে যাবে। ছাঁকনিতে পড়ে থাকবে মুসলমান এন আর সি-ছুটরা। বিজেপি ও শিলাবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন।
কিন্তু অসমিয়া জাতীয়তাবাদীদের কাছে নাগরিকত্ব বিল প্রবল মাথাব্যথার কারণ। ওঁদের ভয়, বিল পাস হয়ে গেলে পিলপিল করে হিন্দু বাংলাদেশিরা আসামে এসে জুটবে। ত্রিপুরার জনজাতিদের মত অসমিয়ারা আসামে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। ফলত, বিল সমর্থকদের প্রতি তাঁরা অসহিষ্ণু। শিলাবাবু বিলের সমর্থনে ১৭ নভেম্বরে গুয়াহাটিতে একটি বাঙালিদের (পড়ুন হিন্দু বাঙালিদের) সভা আয়োজন করেছিলেন। খোদ রাজধানীর বুকে এই ঔদ্ধত্য মেনে নেওয়া যায় না। ২৪ অক্টোবরে গুয়াহাটিতে খিলঞ্জিয়া মঞ্চ (ভূমিপুত্র মঞ্চ) একটি সভা করে। আলফার যে অংশটি আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে এসে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে, তার বিশিষ্ট নেতা মৃণাল হাজরিকা সেখানে শিলাবাবুকে হুমকি দেন। মৃণালবাবু আরও বলেন নাগরিকত্ব বিল আটকানোর উপায় হল বাঙালিদের সন্ত্রস্ত করে দাও। তাহলেই আর এস এস-এর টনক নড়বে, যাদের জন্য বিল তারাই যদি বিপন্ন হয়ে যায়, তাহলে বিল আটকে যাবে। কী ভাবে সন্ত্রস্ত কর হবে? সেই ৮২-৮৩-র দাঙ্গার দিনগুলো ফিরিয়ে এনে। ওদের বাড়িতে ঢুকে হুমকি দাও, মারপিট কর। সারা রাজ্যে পোস্টারিং কর যে বিল সমর্থন করলে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। দরকার পড়লে ম্যাসাকার কর। অসমিয়াতে দেওয়া ভাষণে ইংরিজি “ম্যাসাকার” শব্দটিই ব্যবহার করেন মৃণালবাবু। বোধহয় গণহত্যা বললে সেরকম জোশ আসে না।
আরও পড়ুন, এন আর সি: নো-ম্যানস-ল্যান্ডের দিকে পা বাড়িয়ে
২৮ অক্টোবরে পুলিশ প্ররোচনামূলক মন্তব্যের জন্য মৃণালবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ১ নভেম্বরের তিনসুকিয়ার হত্যা হয়তো প্রমাণ করল কেউ কেউ মৃণালবাবুর পরিকল্পনা হাতে কলমে করে দেখাচ্ছে। “হয়তো” লিখলাম কেননা অকুস্থলে রাষ্ট্রের আঙুলের ছাপ পাওয়া গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। আলফা (স্বাধীন) হত্যার দায় অস্বীকার করেছে বটে কিন্তু মনে রাখা ভাল ১৩ অক্টোবরে দুর্গাপুজোর ঠিক আগে গুয়াহাটির কেন্দ্রে একটি বোমা ওরা ফাটিয়েছিল। দায়ও স্বীকার করেছিল। নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে এই বোমাবিস্ফোরণ, আলফা (স্বাধীন)-এর প্রধান পরেশ বড়ুয়া জানিয়েছিলেন। নাকি স্বাধীন আলফা নয়, মৃণালবাবুর সহগামীরা, আলোচনাপন্থী আলফার লোকেরা, অতি সক্রিয় হয়ে পড়ল? শেষ খবর অনুযায়ী ২রা নভেম্বর মৃণাল হাজরিকাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
এন আর সি সংক্রান্ত গোলযোগের দরুন আসামে এখন অস্থির পরিস্থিতি চলছে। এর ওপর সামনেই পঞ্চায়েত ভোট, অদূরে লোকসভা ভোট। এই অগোছালো সময়ে সশস্ত্র এ্যাকশন, বিশেষ ভাষা ধর্ম গোষ্ঠীর লোকেদের হত্যা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাড়িয়ে তুলছে। ভয় হয়, ধার্মিক, ভাষিক কলকাঠি নেড়ে ক্ষমতালাভের চক্করে সংঘ এমন জাতিহিংস্রতার আগুনের জন্ম না দিয়ে ফেলে যা ওরা নিজেরা নেভাতে পারবে না।