বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লি আসছেন ৩ অক্টোবর। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকা গিয়ে আশ্বাস দিলেও এখনও পর্যন্ত আসামের নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে নি। বেসরকারিভাবে কূটনৈতিক ট্র্যাক-টু কৌশল অবলম্বন করে ঢাকা নয়াদিল্লির সঙ্গে অবশ্য কথা বলছে নিরন্তর। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পক্ষ থেকেও হাসিনাকে অভয় বাণী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস) নিয়ে সিদ্ধান্ত বদল তো করে নি। হাসিনা দিল্লি এলে মোদীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে, এমনটা ধরে নেওয়া যায়।
এর আগে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম এই বিলটি নিয়ে। তখন বলেছিলাম, দেশের ভিতর বিজেপির মতাদর্শগত অবস্থান এ ব্যাপারে যাই হোক না কেন, বাংলাদেশকে অসন্তুষ্ট করা কখনই ভারতের কূটনৈতিক লক্ষ্য হতে পারে না। আমরা আজ আবার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি। কিন্তু কেন? করছি, কারণ ইতিমধ্যে আসাম নামক রাজ্যটিতে এই নাগরিকপঞ্জি নিয়ে তুলকালাম শুরু হয়ে গেছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি সাংবাদিক বৈঠক করে ঘোষণা করেছেন, নাগরিকপঞ্জি থেকে এভাবে নাম বাদ দেওয়াকে বিজেপি সমর্থন করছে না। কী আশ্চর্য! এদিকে আসামের সমস্ত মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে নাগরিকপঞ্জি থেকে ১৯ লক্ষ লোকের নাম বাদ যাওয়াকে স্বাগত জানিয়েছে। এ তো অদ্ভুত কাণ্ড।
আরও পড়ুন: এনআরসি তালিকাছুটদের পরিচিতি আসলে কী? কোথা থেকে আসছে পরিসংখ্যান?
কেন এমন হলো? সংবাদে প্রকাশ, প্রথম দফায় যে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ গেছে, তাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষ কিন্তু হিন্দু। মুসলমান নয়। আর এক লক্ষ গোর্খা। এই তথ্য প্রকাশের আগেও বিজেপি এমনটা প্রত্যাশা করে নি। মনে করা হয়েছিল, আসামের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলি থেকে অনেক বেশি অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের নাম পাওয়া যাবে। বাস্তবে রিপোর্টটি প্রকাশের পর দেখা গেল, তা কিন্তু হয় নি। আবার প্রশ্ন, কেন? বিজেপির কিছু নেতা এখন বলছেন, বহু অনুপ্রবেশকারী মুসলিম এসেই তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের সাহায্যে রেশন কার্ড এবং ভোটার তালিকায় নাম ঢুকিয়ে নেন। রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল শাসক দলের। আর হিন্দু 'শরণার্থীরা', নাগরিকত্ব নিয়ে মাথা ঘামান নি। কারণ তাঁরা হিন্দু বলে তাঁদের নিরাপত্তার কোনও অভাব বোধ ছিল না।
এখানে পাঠকদের জানানো প্রয়োজন যে আসামের নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজটি কিন্তু রাজ্য সরকার করে নি। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারও করে নি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মনোনীত হয়েছেন NRC কর্তৃপক্ষ। তাঁদের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত সরকারি প্রশাসক বা আমলা। স্বয়ং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ আসামের বাসিন্দা। তিনি নিজেও এই নাগরিকপঞ্জি তৈরিতে বিশেষ উৎসাহ নিয়েছেন। তিনিই অগাস্ট মাসের মধ্যে সরকারকে তালিকা দেওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেন, আর সে কারণে অমিত শাহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর তড়িঘড়ি এই তালিকা আদালতের কাছেও জমা দিতে হয়। যেহেতু অবৈধ অনুপ্রবেশ কংগ্রেসের চেয়েও বিজেপির কাছে অনেক বড় বিষয়, সে জন্য মোদী-অমিত শাহ এখন কার্যত বাঘের পিঠে চেপেছেন। বাঘের পিঠ থেকে নামেন কী করে?
দেখুন। সোজাসাপটা বলি, এই নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজটি কিন্তু মোদী জমানায় এবং আসামে বিজেপি জমানায় শুরু হয়নি। শুরু হয়েছিল কংগ্রেস জমানায়। তখন মনমোহন সিংহ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তখনও আদালতের নির্দেশেই এই কাজ শুরু হয়।
আরও পড়ুন: সংকটে অর্থনীতি, পরিত্রাতা আছেন কেউ?
অতএব বিষয়টি প্রাচীন, কিন্তু বিজেপির মনে হয়েছিল, গোটা দেশ জুড়ে প্রচার হলে বিজেপির ভোট সুসংহত হবে। কারণ আজ গোটা পৃথিবী জুড়েই ইমিগ্রেশন এক মস্ত বড় সমস্যা। ইউরোপ বা ট্রাম্পের আমেরিকায় এখন এই বেআইনি অনুপ্রবেশ ও নাগরিকত্ব বড় নির্বাচনী ইস্যু। এ হলো দক্ষিণপন্থী পপুলিস্ট রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য। এই নাগরিকপঞ্জি গঠনের ফলে কিন্তু বিজেপির সমর্থক কুল খুবই আহ্লাদিত। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মহলেরও একাংশ মনে করছেন, মোদী-অমিত শাহর 'হিম্মত' আছে। ৩৭০ ধারা উচ্ছেদ যেমন তাঁরা করে দেখিয়েছেন, ঠিক সেভাবে এই নাগরিকপঞ্জি নিয়েও গোটা দেশে তাঁরা বিল এনে কার্যকর করেই ছাড়বেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন বাঙালির বিষন্নতাকে রাজনৈতিক ইস্যু করতে চাইছেন, তেমন বিজেপি জানাতে চাইছে, ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে।
আসামের মধ্যেও বিভিন্নতা আছে। ভারত বড় বিচিত্র এক দেশ। বৃহৎ দেশ। প্রচুর জনসংখ্যা। কাছাড় উপত্যকা, যা শিলচর বলে পরিচিত, অতীতে ছিল শ্রীহট্ট বা সিলেটের অংশ। শ্রী চৈতন্যদেব থেকে শুরু করে বিপিনচন্দ্র পাল, মনীষীদের স্মৃতি বিজড়িত এই অঞ্চলের বঙ্গসন্তানরা কিন্তু বাংলাদেশি নন, তাঁরা ভারতীয় সিলেটি। এবং তাঁরা কিন্তু বাংলাদশিদের চেয়ে কম উদ্বিগ্ন নন। বহু ভারতীয় সিলেটির বার্থ সার্টিফিকেট নেই। কারণ অতীতে প্রাচীনপন্থী পরিবারে নাগরিকত্ব নিয়ে এহেন সচেতনতা ছিল না। কী করা যাবে? তখন অনেকেই বার্থ সার্টিফিকেট করান নি। অনেকে স্কুল পরীক্ষার সময় অ্যাডমিট কার্ড পেয়েছিলেন। তাতে জন্মসন, তারিখ ও জন্মস্থান আছে। যাঁদের নেই? তাঁরা কী করবেন? এ তো কেলেঙ্কারি!
আরও পড়ুন: নাগরিকপঞ্জি বাস্তবায়নে মোদী-শাহের সামনে বাধা হতে পারে বাংলাদেশ
কদিন আগে আমি কলকাতা গিয়েছিলাম। ব্যক্তিগত কাজে দমদম পুরসভায় গিয়ে দেখি বিরাট লাইন। কী ব্যাপার? খুব ভিড়। এঁরা রেশন কার্ড করাতে এসেছেন। কলকাতার বহু পুরসভায় এখন রেশন কার্ড নবীকরণ হচ্ছে, বা যাঁদের জন্ম নথিপত্র নেই, তাঁরা নতুন করে রেশন কার্ড করাচ্ছেন। রেশনে চাল গম নেওয়ার জন্য নয়। কারণ হলো নাগরিকপঞ্জির আতঙ্ক। অমিত শাহ ১ অক্টোবর কলকাতা গিয়ে এক সম্মেলনে বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা করবেন, সরকার আসলে কী করতে চাইছে। ১ অক্টোবর অমিত শাহ কলকাতার নেতাজি ইন্ডোরে নাগরিকপঞ্জি নিয়ে সম্মেলন করছেন, আর ৩ অক্টোবর শেখ হাসিনা আসছেন দিল্লি। ওদিকে এক লক্ষ গোর্খার নাম বাদ যাওয়ায় দার্জিলিং গোর্খা পার্বত্য পরিষদের বিনয় তামাং মামলা করতে চলেছেন সরকারের বিরুদ্ধে।
এবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আসি। বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর ঢাকা গিয়ে তড়িঘড়ি করে হাসিনাকে বলে এসেছেন, উদ্বেগের কোন কারণ নেই। ভারত এমন কিছু করবে না যাতে ঢাকার সমস্যা হয়। হাসিনা সরকার কিন্তু জানিয়ে দিয়েছে, আসাম থেকে একজনকেও বাংলাদেশ গ্রহণ করবে না। বাংলাদেশ সরকার এঁদের বাংলাদেশী বলে মনেই করছে না। বোহিঙ্গা ইস্যুতে ঢাকা মানবতাবাদী অবস্থান নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। উল্টে ভারত সরকার ওই বোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদীদের পর্যন্ত খুঁজে পেয়েছে। কাজেই এখন হাসিনা নিজেও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিচ্ছেন।
একটা বিষয় বুঝতে হবে, এ ঘটনায় হাসিনা সরকার ক্ষুব্ধ। শেখ হাসিনা নারাজ। ঠিক এভাবে বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া অবৈজ্ঞানিক। বুঝতে হবে বাংলাদেশের জনসমাজ ক্ষুদ্ধ। বাংলাদেশের মানুষের বিশ্বাস যদি ভারত আবার হারায়, তাতে যদি হাসিনা সরকার-বিরোধী জনমত তীব্র হয়, যদি পাকিস্তান-পন্থী উগ্রপন্থীরা তার সুযোগ নেয়, তাতে ভারতের লাভ কী? পাকিস্তান যে এই সমস্যায় জামাতদের মদত দেবে, এ তো একটা বাচ্চাও বলে দেবে।
আরও পড়ুন: নাগরিকপঞ্জি: হিন্দু না ওরা মুসলিম…
যে ১৯ লক্ষের বেশি বাসিন্দাদের নাম বাদ গেল, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বিদেশি ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হবে, যার অর্থ হলো দীর্ঘ আইনি লড়াই। জয়শঙ্কর ঢাকায় গিয়ে যে আশ্বাস দিয়েছেন, তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান বলেছেন, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, তাই আমরা এ বিষয়ে মন্তব্য করব না। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমিনা মহসীন কিন্তু বলেছেন বাংলাদেশের এখনই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার, এবং প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে।
একটা কথা বলি, ভারত এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ। সংযুক্ত রাষ্ট্রসংঘে পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান বিরোধের ছায়া পড়ছে। কাশ্মীর নিয়ে গোটা দুনিয়া জুড়ে তুলকালাম চলছে। পাকিস্তান দুনিয়ার সামনে হেরে গিয়ে কাশ্মীরে নাশকতামূলক কাজকর্ম করার জন্য মরিয়া। চীন-পাকিস্তান অক্ষ ভাঙা কঠিন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশকে 'টেকেন ফর গ্র্যান্টেড' করাটা কিন্তু ভূল কূটনীতি। সাধু সাবধান!