আলফা (স্বাধীন) অর্থাৎ পরেশ বরুয়ার নেতৃত্বাধীন নবগঠিত আলফা প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে ধলা-সদিয়ার পাঁচজন বাঙালীকে তারা গুলি করে মারেনি। অথচ গণহত্যার অব্যবহিত পরেই পুলিশ জানিয়েছে এই হত্যাকাণ্ড আলফা (স্বাধীন) ই সংগঠিত করেছে। কী করে বোঝা গেল? উত্তরে জানা গেল আলফা নাকি এইভাবেই বড় অপারেশন সম্পন্ন করতো। এইভাবেই, মিলিটারির পোষাক পরে। কিন্তু তখনও কি তারা অপারেশনে গিয়ে হিন্দি ভাষায় কথা বলতো? আর উত্তর নেই। যে পুলিশ বাহিনী স্থানীয় মানুষদের অভিয়োগ অনুযায়ী ২০০ মিটারের মধ্যে থানা হওয়া সত্ত্বেও এসে পৌঁছাতে পারেন না, ওসি মোবাইল অফ করে দেন, তারা এসেই বুঝে গেল একাজ পরেশে বরুয়ার দল ছাড়া আর কারও কাজ হতেই পারে না।
তার মানে এটা অবশ্যই নয় যে পরেশ বরুয়ার আলফা(স্বাধীন) এ কাজ করে নি। কিন্তু এও তো হতে পারে যে, প্রায় সমগ্র আলফা নেতৃত্ব যখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে, তখন প্রাণপণ চেষ্টা করেও পরেশকে সারেন্ডার করানো বা বৈঠকে এখনও পর্যন্ত রাজি করানো যায়নি। ফলে তার মর্যাদাহানির জন্যই ঘটনা ঘটানো হয়নি তো? আবার উল্টোটাও হতে পারে। আসামের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাওয়া পরেশ বরুয়া দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এমন একটি ঘটনাই ঘটাতে চাইছিল। কিন্তু তাহলে তারা দায় অস্বীকার করলো কেন? বিশেষত কিছুদিন আগেই শুক্রেশ্বর মন্দিরের বাইরে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার দায় আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নেওয়ার জন্য তাদের ব্যগ্রতা ছিল চোখে পড়ার মত। প্রশ্ন হচ্ছে এরা না হলে কারা?
আরও পড়ুন, আসামে আশির ছায়া
এধরণের গুপ্তহত্যা, ব্যক্তিহত্যা আসামে কিন্তু বেশ পুরোনো এবং প্রচলিত। নেলী, গহপুর বা মোকালমোয়া বা ধেমাজী জাতীয় গণহত্যার কথা বলছি না, প্রফুল্ল মহান্তের আমলের বহু যুবক-যুবতী, এমন কি আলফা পরিবারের সদস্যদের সিরিয়ালি হত্যা করার কথা বলছি। কালীপদ সেন বা সৌরভ বরা, অনন্ত কলিতা, উমাকান্ত গগৈ, ডিম্ব রাজকোঁওর, ধরণীধর দাস, হরেন টেরন, রাজীব কোচ, সুকুরি বোডো, সুশীলা রাভা, পারাগ কুমার দাস, হীরকজ্যোতি মোহান্ত বা অমর তাঁতীর মত মানুষদের প্রকাশ্যে হত্যা আসামকে একটা সময় কিলিং ফিল্ডস এ পরিণত করেছিল। শেষ দিকে রাষ্ট্রীয় হত্যার তো হিসেবই রাখা যায়নি।
এ ধরণের ঘটনা যে ঘটতে চলেছে তা পূর্বানুমান করা যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন আলোচনাপন্থী আলফার মধ্যমণি অনুপ চেটিয়া থেকে শুরু করে তদীয় শিষ্য জিতেন দত্ত বা মৃণাল হাজারিকা বাঙালী হিন্দু বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করেছিল।মুদ্রার উল্টোদিক অর্থাৎ বাঙালি মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছিল বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেব। তার মানে এই নয় যে এই চারজনই বাংলাদেশি বিদ্বেষের নামে হিন্দু মুসলিম বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। অসমীয়া এবং বাঙালি দু পক্ষই হিন্দু মুসলমান এই দুই মেরুতে ভাগ হয়ে গেছে। এখানেই বিজেপির সাফল্য। আসামের বাইরের অনেক গোষ্ঠি ও ব্যক্তি এন আর সি-কে এই বিভাজনের জন্য দায়ী করছেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে আমি এমন কোনও রাজনৈতিক দল দেখিনি যারা সার্বিকভাবে এন আর সি প্রক্রিয়ার বিরোধী। মনোভাবটা হল, প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকত্ব পাক, বাকিরা যথা ইচ্ছা তথা যাক। শুধু আমার এবং আমার চেনা গণ্ডি, মানে আমি, আমার পরিবার, বন্ধু বা আত্মীয় স্বজন তাদের সবার নাম যেন থাকে। বাকিরা গোল্লায় যাক। ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস, হিন্দু পন্থী বিজেপি, মুসলিমপন্থী এআইইউডিএফ, মার্ক্সপন্থী ছোট বড় মাঝারি, মধ্যপন্থী দলিত, আদিবাসী, মূলবাসী, উপজাতি জনজাতি, ছাত্র সংগঠন, বৃদ্ধ সংগঠন সবাই এন আর সি সমর্থক। প্রকৃত ভারতীয় (তারা কারা কেউ জানে না, শুধু জানে যে তারা একদিন নাগরিক পঞ্জির মাধ্যমে চিহ্নিত হবে এবং বিতাড়িত হবে) ছাড়া বাকিদের দেশ থেকে নির্মমভাবে বিতাড়িত করতে হবে (কোথায় কেউ জানে না, জানতে চায়ও না)। অতএব এন আর সি নিয়ে কারও কোনও বিরোধ ছিল না, নেইও।
তবে একটু খুঁতখুঁতানি ছিল। এক, এন আর সি তালিকাছুট মানুষের সংখ্যাটা চল্লিশ লক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া। সেটা শোনা যাচ্ছে আরও বাড়তেও পারে। চল্লিশ লক্ষ মানুষ রাতারাতি রাষ্ট্রহীন হয়ে যাচ্ছে? একটা গোপন পাপবোধ হৃদয়তন্ত্রীতে খোঁচা মারে বৈকি। দুই, গোটা প্রক্রিয়ায় সেই বিজেপির প্রতিটি পদক্ষেপই তো মেনে নিতে হচ্ছে। কখনও আন্তর্জাতিক নিয়মের দোহাই দিয়ে, কখনও সুপ্রিম কোর্টের দোহাই দিয়ে। যতই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্তের কথা বলা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত সেই বিজেপির জয় জয়কারই তো মেনে নিতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও একটা গোপন লজ্জাবোধ হৃদয়তন্ত্রীতে খোঁচাখুঁচি করে।
আরও পড়ুন, এন আর সি: নো-ম্যানস-ল্যান্ডের দিকে পা বাড়িয়ে
এদিকে বিজেপিও আতান্তরে পড়েছে। এন আর সি-র মাঝপথে বিজেপি আশংকা করতে শুরু করেছিল যে তালিকাছুটদের একটা বড় অংশ হিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা। ফলে তারা "প্ল্যান বি" হিসেবে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ বাজারে নিয়ে আসে। কিন্তু তার জন্য যে সারা আসামে আগুন জ্বলে যাবে, এটা সম্ভবত তাদের পূর্বানুমানে ছিল না। বিজেপি নিজে এবং কিছু ক্ষীণবল হিন্দু সংগঠন ছাড়া বাকিরা কোমর কষে বিলের বিরোধিতায়, অর্থাৎ বিজেপি বিরোধিতায়, চিত্তশুদ্ধিতে নেমে পড়ে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে কী আছে, তা সবাই জানে। বিজেপি ভাবছে এই মওকায় দেশের হিন্দুদের কাছে নিজেকে তারা মেসায়া হিসাবে তুলে ধরতে পারবে। কিন্তু কীভাবে? যতটা ভাবা যাচ্ছে ততটা সহজ হবে না বিষয়টা। একজন গিয়ে বললো আমি বাংলাদেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত, অতয়েব বিল অনুযায়ী আমাকে নাগরিকত্ব দিতে ভারতীয় রাষ্ট্র বাধ্য, বিষয়টা অত খেলা খেলা নয়। প্রথমে প্রমাণ দিতে হবে তিনি হিন্দু, তারপর প্রমাণ করতে হবে তিনি ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত। যদি কোনও ভাবে তিনি এই দুটি শর্ত পূরণ করেও ফেলেন, তারপরেও, মানে যে সব বাংলাদেশ প্রত্যাগত হিন্দু যাঁরা এই নাগরিক পঞ্জিতে আবেদন করে বসে আছেন তাঁরা বিলের সাহায্যে নাগরিকত্ব চাইলে আরও কিছু সংকট সৃষ্ট হতে পারে। কেননা এন আর সি- তে তাঁকে আগে প্রমাণ দিতে হবে তিনি এই দেশের নাগরিক, তাঁর ঠিকানা ভারতবর্ষ। আর নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল অনুযায়ী নাগরিকত্ব পেতে হলে তাঁকে প্রমাণ করতে হবে তিনি বাংলাদেশি এবং তার ঠিকানা বাংলাদেশে। কিন্তু এন আর সি-তে তো তিনি নিজেকে প্রকৃত ভারতীয় হিসাবে ঘোষণা করেছেন এবং ভারতবর্ষীয় ঠিকানা লিপিবদ্ধ করিয়েছে। এ তো মিথ্যা তথ্য পরিবেশন হবে। এই মিথ্যাচারের জন্য তাকে হাজেলা অ্যান্ড কোং ছেড়ে দেবে? আইন বিশেষজ্ঞেরা কী বলেন?
অসমীয়া জনগোষ্ঠির তো এন আর সি তে আপত্তি নেই। এন আর সি তে সমর্থকদের তারা মারতে যাবে কেন খামোখা? আসলে প্রগতিশীলদের মতো তাদের অবস্থানও এক্ষেত্রে বিজেপি বিরোধী। কিন্তু রিফিউজি ও অনুপ্রবেশকারী, এই দুই শব্দবন্ধে তারা বিভক্ত। তাদের বোঝানো হয়েছে বাংলাদেশ থেকে ঢুকে আসা লক্ষ লক্ষ মানুষ বাঙালি এবং তারা অসমীয়াদের ঘাড়ে চেপে বসে থাকবে অনন্ত কাল। এই স্রোতও বহমান থাকবে। দুটি বৃহৎ বিবদমান ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে (তারও ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে), ধর্মীয় গোষ্ঠীতে ভেঙ্গে চারটুকরো করে, নিজেদের কাজটাকে সহজ করে নেওয়া হয়েছে মাত্র। ভোটে জেতা তার একটি প্রত্যাশিত সুফল মাত্র।
অমিত শাহের মতো অনুপ্রবেশকারীদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর অবাস্তব পরিকল্পনা না করে সত্যি যদি ভারতবর্ষেই কোথাও তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হতো তামিল উদ্বাস্তুদের মতো, তবে বিষয়টির সাময়িক সমাধান হলেও হতে পারতো। কিন্তু সেটা করলে তো এর পিছনের রাজনৈতিক খেলাটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে। খেলাটা এখন আর হিন্দু মুসলমান বা অসমীয়া বাঙালির দ্বন্দ্বে আটকে নেই। বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক। খেলোয়াড়েরা আন্তর্জাতিক স্তরের। জেলা বা রাজ্য বা জাতীয় স্তরে তা আর সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন দেশ এমনকি দু একটি মহাদেশও জড়িয়ে আছে। লেনদেন শুধু কূটনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক স্তরের। এ খেলা অত সহজে থামানো যাবেনা। তিব্বতী, তামিল বা হালের রোহিঙ্গিয়া সমস্যার মতো এ এক অন্তহীন প্রক্রিয়া। আমরা খেলার বোড়ে মাত্র।