দিল্লি চলো, বাঙালি এ আওয়াজ শুনেছে। এবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আওয়াজ তুলেছেন, অযোধ্যা চলো। ৫ আগস্ট মোদী যাচ্ছেন অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার ভূমিপূজা উপলক্ষে। অযোধ্যা এখন প্রস্তুত এই ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য।
অযোধ্যা প্রস্তুত মানে? বদ্রীনাথের মাটি, অলকানন্দার জল, সোমনাথ থেকে পাথর, কালীঘাট থেকে ফুল, এমনকি গঙ্গাসাগর, নবদ্বীপ, ত্রিবেণীসঙ্গম, কলকাতার ভুতনাথ মন্দির থেকেও মাটি-জল গেছে। চোদ্দ লাখ টাকার রুপোর ইঁট সেখানে পাতা হচ্ছে। রাম আর লক্ষণকে সবুজ পোশাকে সাজানো হচ্ছে। অযোধ্যার যে ষ্টেশন, সে ষ্টেশন যেন একটা রামমন্দিরের সাজে সেজেছে। গোমতীর জল, সীতাকুণ্ডর মাটি এসমস্ত নিয়ে অযোধ্যা প্রস্তুত।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন
ত্রিশ হাজার সাউন্ড বক্স লাগানো হয়েছে। সেখানে রামধুন হবে। আর দুপুর বারোটা বেজে তেরো মিনিট বত্রিশ সেকেন্ডে নরেন্দ্র মোদী শুরু করবেন ভূমি পুজো। লালকৃষ্ণ আডবানীর নেতৃত্বে সংঙ্ঘ সমর্থক-ভক্তরা যেদিন ওখানে যায়, ধ্বংস হয় বাবরি মসজিদ। সেই কলঙ্কিত দিনটিও ছিল ঐতিহাসিক। কিন্তু সে ধ্বংস ছিল অবৈধ কার্যকলাপ। আজও লালকৃষ্ণ আডবানীর বিরুদ্ধে আদালতে ফৌজদারি মামলা চলছে। আজও তিনি চার্জশিট মুক্ত নন, এই ৯২ বছর বয়সে। কিন্তু মোদী যাচ্ছেন আদালতের নিয়ম মেনে।
সুপ্রিমকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ অবসর গ্ৰহণের আগে অযোধ্যা বিতর্ক নিরসনে 'জাজমেন্ট' দেন। যেখানে অযোধ্যায় মন্দির ও মসজিদ দুটোই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে নিরসনের কথা বলা হয়। কাজেই অযোধ্যা নিয়ে সংঘাত নয়, এখন সমন্বয়ের চেষ্টাই হচ্ছে বলে দাবি দিল্লির সরকারের।
আরও পড়ুন- অমিতাভ বচ্চনের মুখোশ খুলতে চেয়েছিল অমর সিং, কেন?
আলবিরুনি ভারত সম্পর্কে বলতে গিয়ে এককথায় বলেছিলেন, এ হল সাংস্কৃতিক ঐক্যের দেশ। কাজেই 'ভারতবর্ষ' নামক কনসেপ্টকে বলা হয়েছিল দীর্ঘদিনের 'নিবে' আর 'দিবে'র মিলন ভূমি। ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের নতুন অধ্যায় রচিত হল। তখনও এই দেশটি একটি নিছক ভৌগোলিক ভূখণ্ড নয়, সাংস্কৃতিক ঐক্য ও রাজনৈতিক ইউনিট হিসেবেই সমগ্ৰ বিশ্বের সামনে
প্রতিষ্ঠিত হয়। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর এই বিতর্ক সম্পর্কে পশ্চিমি দুনিয়া বলছিল যে এটি হল বিশ্বের অন্যতম না মেটা এক ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক বিতর্ক। তবে কি এবার মোদী এই বিতর্কের নিরসন চাইছেন?
অযোধ্যায় এখন হাই-অ্যালার্ট। ইতিমধ্যে ভারতীয় গোয়েন্দারা সরকারকে জানিয়ে রিপোর্ট দিয়েছে যে ৫ আগস্ট পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই, লস্কর-ই-তৈবা ও জৈশ-ই-মহম্মদ অযোধ্যায় অথবা উত্তরপ্রদেশের কোনও এক প্রান্তে বড় হামলার পরিকল্পনা নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকেও গোয়েন্দারা রিপোর্ট দিয়ে সতর্ক করেছে। ঘটনাচক্রে এই দিনটি অর্থাৎ ৫ অগাস্ট হল কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির বর্ষপূর্তি। তাই পাকিস্তান, বেশ কিছু কাশ্মীরী সংগঠন এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা নাকি দুনিয়া জুড়ে এদিন মোদী বিরোধী প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছে মূলত সোস্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল মাধ্যমে।
আরও পড়ুন- মমতার জন্য সরষে পাবদা আনাতেন সোমেন দা
রূপোর ইঁট তৈরি হচ্ছে, এক একটা ইটেঁর ওজন আড়াই কিলো। ইঁটে লেখা আছে নরেন্দ্র মোদী এই মন্দিরের ভূমিপূজার উদ্বোধন করলেন। মন্দিরের ব্লুপ্রিন্ট তৈরি। ঠিক হয়েছে মন্দিরটি সুন্দরভাবে পুনঃনির্মাণ হবে। আবার এই প্রস্তুতি পর্বে যখন রামমন্দির নির্মাণের কাউন্ট ডাউন শুরু, তখন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা তথা কাশ্মীরের হিন্দু রাজা প্রয়াত হরি সিং-এর ছেলে করণ সিংহ বলেছেন, "এই মন্দির তৈরি হচ্ছে এতে করে আমি খুশি। কেননা আমি নিজে রামভক্ত। কারণ আমরা কাশ্মীরের সূর্যবংশীয় পরিবার। আমাদের পূর্বপুরুষরা জম্মুতে রঘুবীরের মন্দির নির্মাণ করেন। আমরা শৈশব থেকেই রঘুবীরের পুজো করেছি। কিন্তু এই মন্দির নির্মাণের সময় আমার প্রস্তাব, শুধু রাম নয় সীতারও পৃথকভবে একটি মূর্তি যত্নসহকারে নির্মাণ হোক। এই অযোধ্যা নগরীতেই সীতা মাকে অনেক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়। এখন যেন আর তা না হয়। দ্বিতীয়,ত এখানে শিবেরও একটি পৃথক মন্দির হওয়া প্রয়োজন। রামায়ণের কাহিনী অনুসারে রামচন্দ্র কিন্তু লঙ্কায় যুদ্ধে যাওয়ার সময় শিবপুজো করে যান, আবার রাবণ বধ করে ফেরার সময়ও রাম শিবের পুজো করেন"।
অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, এ ঘটনায় ভারতীয় মুসলিমরা কার্যত নীরব। তবে হায়দ্রাবাদের ওয়েসি এক বিবৃতি দিয়ে মোদীর এই অযোধ্যা যাত্রার ও ভূমি পূজার তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, "এর ফলে দেশে সাম্প্রদায়িকতা আরও বাড়বে বই কমবে না"।
আরও পড়ুন-কিশোরী অমলাকে নেতাজিই উদয়শঙ্করের কাছে পাঠিয়েছিলেন
প্রতিবেশী রাষ্ট্র শুধু পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশেও বাবরি মসজিদ ভাঙার তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। আর এর ফলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাওয়ের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষতি হয় অনেকটাই। রাজীব গান্ধীর শাহবানু মামলা থেকেই মেরুকরণের রাজনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। লালকৃষ্ণ আডবানী তাঁর আত্মজীবনীতেও স্বীকার করেছেন, শাহবানু মামলা হয়েছিল বলে বিজেপির পক্ষে পাল্টা তাসটি খেলা অনেক কার্যকরী হয়েছিল। রাজীব অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ কংগ্রেসের উপর রুষ্ট হচ্ছে দলের মুসলমান তোষণের জন্য। এ জন্য রাজীব গান্ধী সরকার, বন্ধ মন্দিরের তালা খুলে মন্দিরের শিলান্যাস করেছিলেন অযোধ্যায়। তখন নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বুটা সিংহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বুটা তো হিন্দু মন জয় করতে মাচান বাবার পা মাথায় পাগড়ির ওপর রেখেছিলেন। তাতে অবশ্য কংগ্রেসের উভয় সঙ্কট হল। কারণ হিন্দু ও মুসলমান দুই ভোট ব্যাঙ্কই কংগ্রেসের সঙ্গে অতীতে স্বাধীনতার আগে ছিল, এই স্মৃতিতে মশগুল রাজীব ভেবেছিলেন এখনও তাই হবে। কিন্তু বিজেপি হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কে থাবা বসাল, আর নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় বাবরি মসজিদটা ভেঙে যাওয়ায় উত্তেজিত বিজেপি কর্মী ও সমর্থকরা বাজপেয়ী-আডবানীর পাশে এসে দাঁড়াল। আর মুসলমান সমাজ এতটাই চটে গেল যে মুলায়াম সিংহ যাদব থেকে লালু প্রসাদ যাদব এমনকি বাম দলগুলি পর্যন্ত তখন মুসলিম ভোটে দখল নেয়। আর তাতে ভারতের রাজনীতি আরও সাম্প্রদায়িক হল তাই আজও এটা সত্য কংগ্রেস যদি সাবেকি স্টাইলে পুনরুজ্জীবিত হতে পারত তবে হিন্দু ও মুসলমান সমাজ দু'পক্ষের সমর্থন পেয়ে দেশে আবার ধর্মনিরপেক্ষ আবহ তৈরি হতে পারত। কিন্তু ইতিহাস পিছন দিকে হাঁটে। কংগ্রেসের অবক্ষয়ের সুযোগ নিয়ে যেসব আঞ্চলিক দলগুলি যে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করে ফেলেছে। তাও কি অবলুপ্ত হবে?
হিন্দু-মুসলমান দুপক্ষকে খুশি রাখার জন্য ভারতীয় রাজনীতিকরা যদি কাট অ্যান্ড পেস্ট কৌশল নেন। তাতেও কিন্তু ধর্ম নিরপেক্ষ ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা হবে? মনে হয় না।
আরও পড়ুন-অপরাধ-রাজনীতি হাতে হাতে ধরি ধরি
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী, তখন প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে দ্বারকার সোমনাথ মন্দির পুর্ননির্মিত হয়। নেহেরুর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সেই উদঘাটন অনুষ্ঠানে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ উপস্থিত ছিলেন। সে সময় তো বিজেপির কেন্দ্র তথা পূর্বপুরুষ ভারতীয় জনসংঙ্ঘেরই প্রতিষ্ঠা হয়নি। আডবানী কিন্তু বারবার বলেন, সোমনাথ থেকেই তিনি অযোধ্যা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পান। আর তাই রথযাত্রার রুট হয়েছিল সোমনাথ মন্দির থেকে অযোধ্যা।
আডবানী বাবরি মসজিদ ভাঙার পরই দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রবন্ধে লেখেন যে এই ধ্বংসের জন্য তিনি দুঃখিত। এ ঘটনা অনভিপ্রেত। কিন্তু এও তো ঘটনা যে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সেদিন রাতেই মসজিদের ধ্বংসস্তূপে রামলালার মন্দিরের তথাকথিত গর্ভগৃহের উপর অজ্ঞাত রামভক্তরা রামলালার একটি বিগ্ৰহ স্থাপন করে আর সে রাতেই বিগ্ৰহের পুজো শুরু হয়ে যায়। সেদিনই গোটা দেশ জুড়ে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি শাসন জারির আগেই ইস্তফা দেন। হিন্দি বলয়ের চারটি রাজ্যে বিজেপি শাসকদল ছিল। দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ এ অভিযোগে এ চার রাজ্যেও রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়। আর দেড়বছর পর ৯৩' সালের ১২ মার্চ মুম্বাই শহরে ১৩টি স্থানে একসঙ্গে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। নরসিংহ রাও যেন তেন প্রকারেণ সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, কিন্তু এই সময়ে বিজেপি দ্রুত ভারতীয় মানুষের মনের দখল নেয়।
আরও পড়ুন-চিনের নবতম রূপ, ঘরের বাইরে নজর
আজ আবার যখন ভারতীয় রাজনীতিতে অযোধ্যা অগ্ৰাধিকার পাচ্ছে, তখন ঘরপোড়া গরুদের ভয় হয়। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতে মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির তৎপরতা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মুসলিম মৌলবাদের শিকড়ে আছে মুসলিম বিচ্ছিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ। ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্য বজায় রাখতে গেলে সমস্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার অভাব বোধও কাটাতে হবে।
আপাতত মনে হচ্ছে, ৫ আগস্ট ভূমি পূজার অনুষ্ঠান ভালোয় ভালোয় অতিবাহিত হোক। হিন্দু ধর্মে অনেক দেব-দেবী আচার এ সবের উর্ধ্বে উপনিষদ অখন্ড ব্রহ্মের কথা বলে। আচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, হিন্দু শাশ্বত সত্তাকে মানে। এই সত্তাকে নিরূপণের প্রকাশের মুখ্য দু'টি পথ। একটি জ্ঞানের বা যুক্তি-তর্কর পথ, অন্যটি ভক্তির পথ বা অনুভব অনুভূতির পথ। হিন্দু ধর্মে আসলে কোনও Creed বা ধর্মবীজ নেই। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, নানা ধর্ম নানা ভাষার মত আলাদা। কিন্তু আসলে এক। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সেই ৪৭' সাল থেকেই হচ্ছে। অনেকে বলেন, গান্ধীজীই প্রথম ধর্মকে ভারতের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। এটি নিয়েও বিতর্ক কম হয়নি। আপাতত বিতর্ক থাক, একটাই প্রত্যাশা, আমরা সেই আলবিরুনির দেখা ভারতবর্ষের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে রক্ষা করি।
(লেখক দিল্লি নিবাসী প্রবীণ সাংবাদিক। মতামত ব্যক্তিগত।)