ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি, ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান’ হাতে এল। একটু দেরী করেই এল। প্রকাশ হয়েছে কয়েক বছর আগেই। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে মনে হচ্ছিল, সত্যি বাংলা ভাষার গ্রহণ করার ক্ষমতা কী বিরাট। আবার এটাও ঠিক, গ্রহণ যতটা হচ্ছে, ব্যবহার কি ততটা হচ্ছে? নবারুণ ভট্টাচার্য একবার বলেছিলেন, বাংলাকে আমরা কলকাতাবাসীরা কিছুটা মিন মিনে করে ফেলেছি। আর তা করতে গিয়ে অনেক সম্পদ আমরা হারিয়েছি। যে অভিধানের কথা বললাম, তার পাতায় পাতায় চমক। কয়েকটা আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের নমুনা এখানে দিচ্ছি, যা আমরা নিয়মিত ব্যবহার করি। অংশীদার, অছিলা, অজুহাত, অদল-বদল, অরাজি, অন্দর-মহল, অম্বর, আস্তর(ণ), আইন মাফিক, আজব, আদল, আবহাওয়া, আমদানি, আমল, আলবোলা, আলখাল্লা, আলতু-ফালতু ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সপ্তাহের বেঙ্গল লাইনে বিষয়, শব্দ, ভাষা নিয়ে রাজনীতির কথা।
আজকাল যত নেতা-মন্ত্রীদের মুখে কথায় কথায় ভারতমাতা কি জয় স্লোগান শোন যায়, আগে ততটা যেত না। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির প্রধান স্লোগান ভারতমাতা কি জয়। যাঁরা ভারতমাতা কি জয় বলে স্লোগান দেন, তাঁরা আবার ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলেন না। ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদ, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান, ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ-দের সংগঠন ‘হিন্দুস্তান সোসালিস্ট রিপাবলিক অ্যাসোসিয়েশন’- এর স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। এই স্লোগানের জন্মদাতা স্বাধীনতা সংগ্রামী উর্দু কবি হসরত মোহানি। ভারতমাতা কি জয় বলতে কারও কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। হয়ও না। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের অনেকেই বক্তৃতার শেষে বলেন, ভারতমাতা কি জয়। কিন্তু ভগত সিং-দের স্লোগান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, কোনও হিন্দুত্ববাদী নেতা-নেত্রীর মুখে প্রায় শোনাই যায় না। বোঝা যায় রাজনৈতিক অসুবিধে আছে।
করোনার দিনগুলোয় বাস্তবায়িত হোক নিম্নবিত্তের সুরক্ষা
ইনকিলাব জিন্দাবাদ, হসরত মোহানির এই স্লোগান বংলায় ঢুকে পড়েছে বহুদিন আগে। কোনও সন্দেহ নেই বামপন্থীরাই জনপ্রিয় করেছে ভগত সিংদের এই স্লোগান। এই স্লোগানের মধ্যেই বেঁচে আছেন রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লা খান, ভগত সিং, চন্দ্রশেখর আজাদরা। ইনকিলাব জিন্দাবাদ, এই স্লোগানের শব্দগুলো আমাদের এখন আর যেন উর্দু শব্দ বলে মনেই হয় না, সুদীর্ঘ সময়ের উচ্চারণে যেন বাংলাই হয়ে গিয়েছে। এই যে উর্দু শব্দের বাংলা হয়ে যাওয়া, এই প্রসঙ্গে বলা যায়, কবি নজরুলও বাংলা ভাষাকে অনেক আরবি, ফারসি এবং উর্দু শব্দ উপহার দিয়েছেন। বাংলাকে গজল উপহার দিয়েছিলেন নজরুল। সঙ্গে, তাঁর ‘বলবীর বল উন্নত মম শির’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ যেমন আজও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা, তেমনি তাঁর লেখা শ্যামা সঙ্গীত, ইসলামিক সঙ্গীত, গজল এখনও একই রকম জনপ্রিয়।
নজরুলের লেখা থেকে কয়েকটা আরবি, ফারসি এবং উর্দু শব্দের দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায় গাহে বুলবুল ‘খোশএলহান’। এলহান মানে মিষ্টি স্বর। বা, জুলুমের ‘জিন্দানে’ জনগণে আজাদ করিতে চাই। জিন্দান মানে কারাগার। তীর্থ পথিক দেশ বিদেশের/ ‘আরাফাতে’ আজ জুটল কি ফের? আরাফাৎ মানে মক্কার বিশাল মাঠ, যেখানে নামাজ পড়া হয়। এই কথাগুলো বলা এই কারণেই, যেন ভুলে না যাই। আমাদের সংস্কৃতিতে যেমন রামপ্রসাদ বিসমিল আছেন তেমনি আসফাকুল্লা খান আছেন। যেমন ভগত সিং আছেন তেমনই চন্দ্রশেখর আজাদ আছেন। যেমন রবিন্দ্রনাথ, তেমনই নজরুল আছেন। যেমন ভারত মাতা কি জয়, তেমনই ইনকিলাব জিন্দাবাদ আছে। আমাদের বাংলা ভাষায় যেমন সংস্কৃত আছে তেমনই আছে লোক-শব্দ, আছে হিন্দি, আরবি, ফারসি, উর্দু।
যে কথা হচ্ছিল। যেন ভুলে না যাই। বার বার এই কথা বলার কারণ, সচেতন না থাকলে আমরা কিন্তু ভুলে যাই। ইচ্ছে না থাকলেও ভুলে যাই। উৎপল দত্ত টিনের তলোয়ার নাটকে আমাদের অনেক ভুলে যাওয়া বাংলা শব্দ মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।
করোনা অধিমারী: দায়িত্ব ও কর্তব্য
উৎপল দত্ত তাঁর টিনের তলোয়ার নাটকে যে সব ভুলে যাওয়া বাংলা শব্দ লিখেছিলেন তার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। নাটক থেকে সংগৃহীত কয়েকটি বাক্য
এরকম-- বেটি আজ গ্রেট নেশনেলে চলে গেল ‘ডাঙস’ করে। সে শালা যে ‘ছ্যাং চ্যাংড়া’র কেত্তন শুরু করে দেবে এ সব জানতে পারলে। যেখানে যাবে পেছনে ‘মোদাগাড়ি’ ভরা মালের বোতল চলে, সে শালা হল স্বত্বাধিকারী। ও সব দালালির ‘তলাখাঁক্তি’ কথা রেখে দে, ‘পুনকে বেটি’। গ্রেট নেশনালের ‘ঘাঘিঘোচ’রা আমাদের সর্বনাশ করলে। ওই কাপ্তেনবাবু তো দেখছি ‘ভুড়ুঙ্গে বজ্জাত’। একের পর এক এমন পালা ধরছেন, যা দেখলে আমার ‘থুতকুড়ি জাগে’। আমি দল তুলে দেব তবু ভালো, অমন ‘ঢোস্কা’ পালা করতে দেব না। আপনার সান্ত্বনা দেবার ‘ঘ্যাঁতঘোঁতে’ মেয়েটা মুর্ছো যাবে। আপনার এই মেয়েছেলেটা তো বড় ‘নড়েভোলা!’
শুধু কি ঢোস্কা আর নড়েভোলা? মোটেই না। বরং এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক,
আরও এক গুচ্ছ শব্দ। টিনের তলোয়ারে পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এমন সব শব্দ- যেমন, ‘গস্তানি, নুনচুপ ড়ি, বেদেবুড়ি, হেড়াহেড়ি, চিতেন, তজবিজ, ফররার, আচাভুয়া, বালতিপোঁতা, গররা, পাতাচাপা কপাল, মাড়গে, বৌ-কাঁটকি, চৈতন ফক্কা ইত্যাদি ইত্যাদি। এ সব শব্দের অনেকটাই সম্ভবত ফুটপাথ, রক, মেলা, গ্রাম্য কথোপকথন থেকে সংগ্রহ। সাধারেণর ভাষা। কিছুটা নিচুতলারও সম্ভবত। এই সব শব্দ আমরা নেব না? সব ভুলে যাব? এই প্রশ্নই হয়তো জেগেছিল উৎপল দত্তের মনে।
এই যে সাধারণের ব্যবহার করা শব্দ নিয়ে উৎপল দত্ত ভাবছেন, এই ভাবনা তো আসলে এই কথাই বলে যে, পৃথিবীটা শুধু যাদের অনেক আছে, তাদেরই নয়, যাদের কিছু নেই, তাদেরও। এই যে সবার কথা ভাবা, এটা অনেক পুরোনো ভাবনা। অনেক দিন থেকে মানুষ এই কথা ভাবছে। অশ্রুকুমার শিকদারের লিখেছিলেন, ইতিহাস শুধু বিজয়ীর জয়গান গায়। তাই লোকজন মার্ক্স-এঙ্গেলস-লেনিনকে মনে রেখেছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক ভাবনার ইতিহাস অনেক পুরোনো। সত্যিই তাই।
প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে ১৫৬১ সালে স্যার ‘টমাস মোরে’ যখন ‘ইউটোপিয়া’ লিখেছিলেন সেই ভাবনাকেই প্রথম ইউটোপিয় সমাজতান্ত্রিক ভাবনা বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। তার পর ১৬০১ সালে ‘তোমাসো কামপেনেল্লা’র বই ‘সিটি অফ দ্য সান’। দু’জনের কবিত্বময় আলোচনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এক কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের কথা। ১৭ শতকের মাঝামাঝি, ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের সময়, যাদের বলা হত লেভেলার্স, তারা পৃথিবীর সব সম্পদ সমান ভাগে ভাগ করার পক্ষপাতী ছিলেন। ১৮ শতকের মাঝামাঝি রুশো লিখলেন, ‘the fruits of the earth belong to everyone, and the earth to no one’. ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম মন্ত্র ছিল সাম্য। বা, প্রুঁধোর সেই বিখ্যাত কথা ‘প্রপার্টি ইজ থেফট’।
শুরু করেছিলাম স্লোগানের রাজনীতি দিয়ে। শেষ করছি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের স্লোগান নিয়ে একটি অসাধারণ গানের কথা দিয়ে। ‘স্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনতে শিখি নতুন মানুষ জন, ‘স্লোগান দিতে গিয়েই আমি বুঝতে শিখি কে ভাই কে দুশমন’। প্রতুলবাবু এই গান আজকাল নিজে অবশ্য খুব একটা গান না।
ঋণ-বাগর্থকৌতুকী, জ্যোতিভূষণ চাকী
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)