Advertisment

শুধু কি ভালোটাই মনে থাকে?

অপর্ণা সেন তাঁর শোকবার্তায় লিখেছেন, "রাজনীতির কাছে আমরা একজন অভিনেতাকে হারিয়েছিলাম।" তবে সেই রাজনীতিই যে তাপস পালের স্বরূপ প্রকাশ্যে এনেছিল, তাও অনস্বীকার্য।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

আমাদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে সহায়িকার কাজ করছেন মিনুদি। বাংলা সিনেমার পোকা, যার ফলে টিভিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা আমাদের বাড়িতে এলেই নানা স্বাদের বাংলা ছবি দেখতে পাবেন। সেই সুবাদে তাপস পাল মিনুদির কাছে অতীব পরিচিত নাম। আজ সকালে সেই তাপস পালের মৃত্যুসংবাদ শুনে মিনুদির প্রথম প্রতিক্রিয়া: "আমাদের ৪০ হাজার টাকা চুরি করেছিল। আমাদের গ্রামে আরও কতজনের টাকা মেরেছে। এত লোকের অভিশাপ, মিথ্যে হবে?"

Advertisment

যাঁরা রোজভ্যালি চিটফান্ড কাণ্ড সম্পর্কে অবগত, তাঁরা জানেন, এই 'চুরি'র ব্যাপারটা। আজ থেকে বছর তিনেক আগে যে মামলায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেফতার হন তাপস। গরীব, খেটে খাওয়া মানুষের কাছ থেকে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা 'বিনিয়োগ' হিসেবে আদায় করে পাততাড়ি গুটিয়েছিল গৌতম কুণ্ডুর রোজভ্যালি সংস্থা। সেই সংস্থার একজন অধিকর্তা ছিলেন ২০১৪ সালে নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেসের কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পাল। একদা রুপোলি পর্দার সম্রাট, পরবর্তীতে বাস্তব জীবনের খলনায়ক।

আরও পড়ুন: প্রয়াত তাপস পাল, স্মৃতিচারণায় মুখ্যমন্ত্রী থেকে টলিউড

এবং যতই আজ আমরা 'দাদার কীর্তি', 'সাহেব', 'উত্তরা', বা 'গুরুদক্ষিণা' কপচাই না কেন, তাপস পালের উত্তরাধিকার হিসেবে থেকেই যাবে রোজভ্যালি, 'চন্দননগরের মাল', এবং 'ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে রেপ'। আজ দেখলাম অপর্ণা সেন ফেসবুকে তাঁর শোকবার্তায় লিখেছেন, "রাজনীতির কাছে আমরা একজন অভিনেতাকে হারিয়েছিলাম।" সহমত, তবে সেই রাজনীতিই যে তাপস পালের স্বরূপ প্রকাশ্যে এনেছিল, তাও অনস্বীকার্য।

সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার বছর দুয়েকের মধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগ এবং গ্রেফতারি। অতঃপর দলীয় নেতৃত্বেরও ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে সরে পড়া। ভুবনেশ্বরে কারাবাস, অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় প্রত্যাবর্তন। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি। এতটাই, যে শেষের দিকে ছবি দেখে চেনা যেত না। ইতিমধ্যে কন্যা সোহিনীর সিনেমা জগতে প্রবেশ, এবং স্ত্রী নন্দিনীর টিভির পর্দায়। কিন্তু ওই যে বললাম, গোটা পরিবারটাকেই যেন অহরহ ঘিরে থাকত কিছু কুকর্মের স্মৃতি।

পরিবার বলতে মনে পড়ল, ২০০৫ সালে তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক তাপস পালের মা মীরা দেবী আদালতে অভিযোগ করেন, চন্দননগরে তাঁর প্রয়াত স্বামীর তৈরি বাড়িতে তাঁকে ঢুকতে দিচ্ছেন না তাপস। নানা ধরনের মানসিক অত্যাচারের অভিযোগও করেন মীরা দেবী। এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে জলঘোলা হয়েছিল, মনে আছে। শুধু আমার নয়, অনেকেরই মনে আছে। তখন কথায় কথায় ভিডিও হতো না, তবু মনে আছে।

ভিডিও যখন হলো, তার প্রভাব পড়ল মারাত্মক। প্রকাশ্য জনসভায় নিজেকে "চন্দননগরের মাল" ঘোষণা করে বিরোধীদের বাড়িতে "ছেলে ঢুকিয়ে" বাড়ির মেয়েদের ধর্ষণের হুমকি দিলেন তাপস। গোটা ভাষণটি বন্দী হলো ভিডিওতে। লুকোনোর জায়গা রইল না, পিছিয়ে যাওয়ারও না। তার পর থেকেই কার্যত মহাপতনের শুরু। তারপর এল রোজভ্যালি। ফুৎকারে উড়ে গেল 'দাদার কীর্তি' বা 'গুরুদক্ষিণা'র সেই সরল, সুকুমার চেহারার স্মৃতি। মোহভঙ্গের শোক পালন করলেন বাংলা ছবির অগণিত দর্শক।

ইংরেজিতে একটা কথা আছে, "The good that men do, lives on after them." অর্থাৎ, কেউ ভালো কাজ করলে তাঁর মৃত্যুর পরেও সেই স্মৃতি থেকে যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, খারাপ কাজের ক্ষেত্রেও কথাটা একশো ভাগ সত্যি। মৃত্যু, বিশেষ করে অকালমৃত্যু, সততই দুঃখের। এবং মৃত্যুর পরে কারোর সম্বন্ধে অপ্রিয় সত্য না বলার একটা রীতি চালু আছে আমাদের সমাজে। কিন্তু কিছু কথা না বললেই নয়।

Bengali Cinema Bengali Actor
Advertisment