বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে সিপিএম নেতা তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অবদান নিয়ে খুব বেশি তর্ক থাকার কথা নয়। সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠার সুযোগ নেই। এই রাজ্যের উন্নয়নে তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথাও কেউ ভুলবেন না। তাঁর সাদামাটা জীবনযাপন যে কোন বাম কর্মীর কাছে পাঠ্যবই থেকে তুলে আনা উদাহরণ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা কিংবা অসফলতার প্রশ্ন থাকবেই। তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। বাংলার রাজনীতিতে বুদ্ধবাবুর অবদান নিয়ে তর্ক-বিতর্ক সহজে শেষ হওয়ার নয়।
তবে রাজনীতির সঙ্গে মিলেমিশে আছে তাঁর সাহিত্যপ্রীতি এবং লেখালেখির অভ্যেস। এ রাজ্যে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা বাম সমর্থনের শতাংশ অতিক্রম করেও সাধারণ মানুষ এখনও চোখ রাখেন সিপিএমের বইয়ের স্টলে, পুজো প্যান্ডেলের পাশেই। এই বিষয়টা এখন রাজনীতির উর্দ্ধে, বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গ। ফলে তৃণমূল বিজেপির তুমুল প্রতিযোগিতার দিনেও শিক্ষিত বাঙালি সিপিএমের বইয়ের ঠেকে একবার না একবার যাবেনই। ফিরে দেখবেন মার্ক্স, লেনিন, মাও, সুকান্ত, গোর্কিকে। শিশু অবাক চোখে স্টালিনের ছবি দেখিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করবে “এটা কে”? কিশোরী একবার হাত বোলাবে বেশ পুরনো হয়ে যাওয়া ‘মা’-এর মলাটে। আমাদের ঘরে আসা মা একাকার হয়ে যাবেন সুদূর সোভিয়েতে বিপ্লবের অন্তরালে থেকে যাওয়া কোনও এক দেশমাতার সঙ্গে। ভুয়ো দেশপ্রেম নয়, ভালোবাসার ধর্ম আর রাজনীতির ইতিহাস মিলেমিশেই তো কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতীর সঙ্গে শোয়াইক যুদ্ধে যায় অধর্ম আর অসাম্যের বিরুদ্ধে।
আরও পড়ুন: ‘বাবা মৃত্যুর আগে শেষ কথাটা বলেছিলেন প্রকাশ কারাটের সঙ্গে’
আর সেই জায়গাতেই আজকেও সংসদীয় বামেদের হাতিয়ার শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। যাঁর অসুস্থতার খবরে এই বাংলার বহু মানুষের মন খারাপ হয়, যাঁর লেখা বই পুজোয় বেরোবে বলে উদগ্রীব হয়ে বসে থাকেন বাম-মনা মানুষ। বুঝতেই পারছেন, এই আলোচনা এবারের পুজোর আগে প্রকাশিত বুদ্ধবাবুর চটিবই 'স্বর্গের নিচে মহাবিশৃঙ্খলা’ নিয়ে। বইটির প্রকাশ সেপ্টেম্বর ২০১৯, দাম ষাট টাকা। প্রকাশিত ন্যাশানাল বুক এজেন্সি থেকে। উৎসর্গে লেখা, “কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তকে, যাঁর সঙ্গে প্রথমবার চীনে গিয়েছিলাম এবং চীনেই যাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল”।
একটু পুরনো দিনের কথা যাদের মনে আছে, দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার গঠনের পর চিনে গিয়েছিলেন এ রাজ্যের বাম প্রতিনিধিদল। তারপর আকস্মিক সেই মৃত্যুসংবাদ। চিন থেকে আসা কফিনের ছবি আজও চোখে ভাসে সে যুগের কমরেডের। ধন্যবাদ বুদ্ধদেববাবু, বামেদের এই হারিয়ে যাওয়া সময়ে আর একবার প্রমোদ দাশগুপ্তের কথা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে। সম্ভবত বিরাশির শেষে পিডিজির মৃত্যুতে শুরু হয়েছিল সিপিএমের পতন, যার ফল বুঝতে তিন দশক কেটে গেছে। লোকে বলত দলকে বিয়ে করেছেন প্রমোদবাবু। তেমন নেতা আজ কোথায়?
গৌরচন্দ্রিকায় যথেষ্ট বাম-প্রশংসা করে নেওয়ার পর কাজের কথায় আসতেই হয়। ঝকঝকে অসাধারণ মুদ্রণ এই বইটির। আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ। সম্ভবত বারো পয়েন্টে ছাপা বেশ বড় বড় অক্ষর। চোখে চালশে ধরলেও পড়তে অসুবিধে হবে না। বেশ কিছু মুদ্রণ সংক্রান্ত ত্রুটি আছে, তবে তাতে পাঠে বিঘ্ন ঘটে না। ভূমিকা এবং প্রাককথন বাদ দিয়ে আরও তেরোটি পরিচ্ছেদ। অন্তিমে উপসংহার। বইটির শেষ বাহাত্তর পাতায়। পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির বাহাত্তুরে ধরার সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেকথা দলের লোক বলবেন। সারমর্মে চীন সম্পর্কে বুদ্ধবাবুর এলোমেলো ভাবনার সমষ্টি এই বই। অগোছালো লেখা। তবে তিনি লিখেছেন তো, তাই পড়তে খুব খারাপ লাগে না।
আরও পড়ুন: যাদবপুরে বাবুল সুপ্রিয় ও নতুন বাম নেতার সন্ধান
কিন্তু একটু তত্ত্ব নিয়ে ভাবতে বসলে পুরোটাই গুলিয়ে যায়। ঠিক কী বলতে চেয়েছেন বুদ্ধবাবু? সম্ভবত তিনি বোঝাতে চেয়েছেন চিনের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের বিভিন্ন গোলমালের কথা। এ আর নতুন কথা কী? চিনের আপাত উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তাদের দেশের প্রায় দেড়শো কোটি মানুষের একটা বড় অংশের চোখের জল যে শুকিয়ে গেছে, এ নিয়ে পশ্চিমি গণতন্ত্রের কোনওদিন কোনও সন্দেহ ছিল না। সম্ভবত সেই ধারাতেই এই বইয়ের তেরো নম্বর পরিচ্ছেদের নাম “মানবাধিকার তথা পশ্চিমী গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি”। মাত্র আড়াই পাতার এই অংশের শুরুর দুটি বাক্য আপনাকে পড়তেই হবে। “বর্তমান যুগে চীনের অর্থনৈতিক সাফল্য যেমন অভাবনীয়, তেমনি চীনের গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের প্রবল জিজ্ঞাসা রয়েছে। দুনিয়া জুড়ে যখন, বিশেষত পশ্চিমী দুনিয়ায়, মানবাধিকার নিয়ে চর্চা, আগ্রহ দিনকে দিন বাড়ছে তখন চীন বিষয়টি নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে নির্লিপ্ত।”
সোজা কথায়, লেখক বলেছেন যে চিনে বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে মানবাধিকার। সঙ্গে বোঝাতে চেয়েছেন যে পশ্চিমি গণতন্ত্রে সত্যিই মানুষের স্বাধীনতা থাকে এবং তাদের কাছ থেকে মানবাধিকারের বিষয়টি শেখা উচিৎ। সোভিয়েত রাশিয়া, চিন, কিউবা, কিংবা সোভিয়েতের দখলে থাকা পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে গণতন্ত্র যে কিভাবে খুন হয়েছে সে খবর ইতিহাসের জানা আছে। অবশ্যই হিটলার কিংবা মুসোলিনি তাদের থেকেও সাংঘাতিক। মার্কিন দেশের সব ইতিহাসও সুবিধের নয়। ফ্যাসিবাদ বা মার্কিন বিরোধিতায় বাংলার বামেদের খামতি ছিল না। তবে দেশে বিদেশে কম্যুনিস্টদের অত্যাচারের বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা এতদিন চোখ বন্ধ করে ছিলেন। বুদ্ধবাবু নিজেদের ভুলটুকু বুঝতে পেরেছেন। পার্টিকে পাত্তা না দিয়ে লিখে ফেলেছেন সত্যি কথা।
সোজা বাংলায়, আজকে সিপিএমের স্লোগান দেওয়া দরকার যে “চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান নয়”। এ দেশের সংসদীয় বামপন্থা গণতন্ত্র শিখুক ফিনল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক থেকে। কট্টরপন্থী কম্যুনিস্টরা যে ফ্যাসিবাদের অন্য মুখ সেকথা সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারাত স্বীকার করলে আজকের ভারতে অতি ডানপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ হবে। “মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ এটাই সত্য”, এই ধরনের ডানপন্থী স্লোগান থেকে বুদ্ধবাবুর এই বই মুক্তির পথ দেখালে তার থেকে আনন্দের আর কিছু নেই।
আরও পড়ুন: ঘরে কী কী বই আছে?
আগেই বলেছি বইটি অগোছালো, তবে সুখপাঠ্য। মায়ের আঁচলের হলুদের দাগ হারিয়ে গেলেও তা যেমন এই বাংলার চিহ্ন, তেমনি সৎ সিপিএমের লেখা বুদ্ধবাবুর এই এলোমেলো কথা। বামকর্মীরা খাটছেন কম। তা না হলে একটু বেশি সময় দিয়ে এই বইটিকে আরও সুন্দরভাবে পেশ করা যেত। যারা বুদ্ধবাবুর কথা শুনে লিখেছেন, তাঁদের বোঝা উচিৎ ছিল ঠিক কী বলতে চাইছেন বুদ্ধবাবু। রাজনীতির বিভিন্ন মতের ধাক্কাধাক্কিতে চিনের কোনটুকু নেওয়া উচিৎ, আর কোনটুকু মানা উচিৎ নয়, সেকথা এই বই পড়ে সম্যক ধারণা করা যাচ্ছে না। তবে এই অক্ষমতা সব পাঠকের ক্ষেত্রে সমান নাও হতে পারে। তাই বইটা পড়ে দেখুন।
আর শত সমালোচনা সত্ত্বেও বলতে হয় যে তৃণমূল বা বিজেপির স্টলে সাজিয়ে রাখা বেশিরভাগ কাগজের বান্ডিলের থেকে এই বইটি অবশ্যই উন্নত মানের। অনেকেই মন দিয়ে পড়বেন। তবে পড়ার পর হতাশ হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাতে কী? পশ্চিমবঙ্গের নিম্নগামী রাজনীতিতে অন্তত একটা পড়ার মত বই তো পাওয়া গেল। বইটি কেনা হয়ে গেলে বাম সমর্থকরা একবার ভক্তিভরে দুর্গা মাকে প্রণাম করে আসবেন। বুদ্ধবাবুর সুস্থ জীবন আর সিপিএমের ভোট শূন্য না হয়ে যাওয়ার প্রার্থনায়। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের শেষ যুদ্ধে মা সঙ্গে থাকলে ক্ষতি কী? মা আসেন বলেই তো বামেদের বই-গুমটিতে আজও আলো ঢোকে। শেষ বিকেলে শরতের সূর্যালোক আর সন্ধের চওড়া হ্যালোজেন। দুটোই হলুদ, অর্থাৎ পীতবর্ণ। চিনেদের নিয়ে সত্যিই কি কেস জন্ডিস, কমরেড? অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি শেষে একটু বুঝিয়ে বলবেন কি? বোধহয় পারবেন না, কারণ এই বইটিতে উত্তরের থেকে প্রশ্ন বেশি।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)