যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেমন জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতা আন্দোলনের আদর্শের যোগ, জামিয়া মিলিয়ার সঙ্গেও তেমনই। জামিয়া মিলিয়া মানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জাকির হোসেন সহ যারা এই বিশ্ববিদ্যালয় আজ থেকে ১০০ বছর আগে তৈরি করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবার সঙ্গেই ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক। দিল্লির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনা অনুমতিতে ঢুকে পুলিশ ছাত্র-ছাত্রীদের পিটিয়েছে, এই অভিযোগ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আমরা সে ছবিও দেখেছি।
এই ঘটনার পর থেকেই নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে সারা দেশের প্রায় সব নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে দেশের সেরা ছাত্র-ছাত্রীরা লেখা-পড়া করেন, তারা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের এই ভাবে পথে নামা বলা যায় বিরল ঘটনা। গান্ধীকে বাদ দিলে অতীতে তিনটে এমন নজির আছে। ১৯৬৭-৭০, চারু মজুমদারের ডাকে বন্দুক তুলে নিয়েছিল দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু পড়ুয়া। তার পর ১৯৭৩-৭৪। জয়প্রকাশের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-ছাত্রীরা যার অভিঘাত ছিল চারু মজুমদারের আন্দোলনের থেকে বহু গুণ বেশি। যে আন্দোলনের ধাক্কায় ইন্দিরাকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে শেষ পর্যন্ত ইন্দিরা-সঞ্জয়কে পরাজিতও হতে হয়েছিল নির্বাচনে। তৃতীয় নজির আন্না হাজারের অনশন। সেই আন্দোলনের পাশেও অনেকটা এইভাবে পড়ুয়াদের দেখা গিয়েছিল। তবে তা আজকের মতো এত বড় মাপের ছিল না।
পড়ে দেখুন, ঋত্বিকের ছবিতে উদ্বাস্তুরা কি কেবলই হিন্দু?
এই যে তরুণশক্তি, যাদের আজ পথে দেখা যাচ্ছে, এরা আজই সফল হবে কি না তা বলার সময় এখনও আসেনি, কিন্তু এটাই সেই শক্তি, যাদের ছাড়া কোনও বড় আন্দোলন সফল হয় না। এরাই নতুন ভারত। গোটা দেশ এদের উপরেই ভরসা করে। এটা সেই কারণ, যে কারণে একশো বছর পার হয়ে গেলেও, ‘একবার বিদায় দে মা’-র মতো সামান্য একটা গান, জনমনে স্থায়ী হয়ে যায়।
হিন্দুত্ববাদীদের যে রাজনীতি, তা মূলত প্রতিবেশীকে ঘৃণা-নির্ভর একটি রাজনীতি, যাদের কোনও আত্মত্যাগের, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস নেই। ৩৭ শতাংশ ভোট এবং ৩০৩টি আসন পেয়ে তাদের হাতে এখন ১৩০ কোটি মানুষের ভাগ্য নির্ভর করছে। তারা সুযোগ পেয়েছিল ভারতবাসীর সামনে একটা আধুনিক বিকল্প তুলে ধরার। কিন্তু তারা সে চেষ্টাই করল না। প্রথম থেকেই তারা অতি দ্রুত পিছনে হাঁটতে শুরু করল। মিনি বাসে উঠলে যেমন কনডাক্টররা চিৎকার করে বলতে থাকে, পিছন দিকে এগিয়ে যান, এ-ও অনেকটা তেমনই।
আন্দোলন করতে গিয়ে মৃতের সংখ্যা ১৬ ছাড়িয়েছে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ‘বদলা’ নেওয়া হবে বলার পরই মৃত্যু বাড়তে শুরু করে। যদিও উত্তরপ্রদেশ সরকারের দাবি এই সব মৃত্যুর কারণ আন্দোলনকারীরা নিজেরাই। পুলিশ কোথাও কোনও গুলি চালায়ন। আন্দোলনকারীরা নিজেরাই নিজেদের মেরে ফেলছে। এমন কথা বলা বোধহয় যোগী আদিত্যনাথের পক্ষেই বলা সম্ভব। নরেন্দ্র মোদী, ভারতীয় দারিদ্র্যকে লজ্জায় ফেলে দিতে পারে এমন একটা ঢাউস বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বানানোর পর, ‘গরু সাফারি’ যাঁর মাথা থেকে বেরিয়েছে, সেই যোগী আদিত্যনাথ, প্রায় নরেন্দ্র মোদীকে টেক্কা দেওয়ার মাপে একটা রামচন্দ্রের মূর্তি বানানোর জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই বেআদব, অবাধ্য পড়ুয়ারা তাঁর রাজ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে। তিনিও বলেছেন বদলা নেওয়া হবে। বদলা যে হচ্ছে তা বোঝাই যাচ্ছে। মৃত্যু বেড়েই চলেছে। পুলিশ বলেছে তারা একটিও গুলি চালায়নি। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই কোনও এক দিন এর তদন্ত হবে। তখন প্রকৃত সত্য জানা যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা গোলমাল করছে তারা কারা তাদের পোশাক দেখলে চেনা যায়। পশ্চিমবঙ্গে ট্রেনে ইট ছোড়ার সময় কয়েকজনকে জনতা ধরে ফেলে। দেখা যায়, তারা লুঙি, ফেজটুপি পরে ট্রেনে ইট ছুড়ছিল। তাদের মধ্যে একজন বিজেপির স্থানীয় নেতা। তাদের ওই ইট ছোড়ার ছবি ভিডিও করা হচ্ছি,। অনুমান করা যায়, কাজে বাধা না পড়লে, সেই ছবিও সোশাল মিডিয়ায় ঘুরত, এবং ফের একবার হয়তো প্রধানমন্ত্রী বলতেন, পোশাক দেখে চিনুন, কারা হাঙ্গামা করছে।
দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলির পড়ুয়ারা পথে নেমে প্রতিবাদ করছে। অক্সফোর্ড সহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি নামী বিশ্বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। সরকার ৩০৩ আসনের অহঙ্কারে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিতেই পারে তারুণ্যের এই দাবি। যদি তারা সফলও হয় এই কাজে, দেশে যদি নির্বাচন ব্যবস্থা টিকে থাকে, তাহলে একদিন না একদিন নতুন কোনও সরকার এসে এই আইন বাতিল করবেই। যেমন ইন্দিরা গান্ধীর তৈরি অগণতান্ত্রিক আইনের ক্ষেত্রে হয়েছিল জরুরি অবস্থার পর। মনে রাখতে হবে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস ১৯৭১ সালে লোকসভা ভোটে ৩৫২ আসন পেয়েছিল। ভোট পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ। ১৯৮৪-র লোকসভা ভোটে কংগ্রেস ভোট পেয়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ, আসনের সংখ্যা ছিল ৪০৪। কেউ হয়তো বলবেন সেটা ছিল ইন্দিরার মৃত্যুতে আবেগের ভোট। সে তো ২০১৯-এর ভোটও ছিল পুলওয়ামা আর সার্জিকাল স্ট্রাইকের আবেগের ভোট। পুলওয়ামার আগের সব সমীক্ষাই বলছিল নরেন্দ্র মোদির সামনে কঠিন লড়াই। ৭১-এর বিপুল জয়ের পর ক্ষমতা ধরে রাখতে জরুরি অবস্থা জারি করতে হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে। ১৯৮৪-তে ৪০৪ আসন পেয়েও ১৯৮৯-এ পতন হয়েছিল কংগ্রেস সরকারের। এসব বেশি পুরোন দিনের কথা নয়।
আরও পড়ুন, নাগরিকত্ব বিতর্ক ও রামরাজ্যে গণভোট
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পোশাক দেখে চিনুন’। অমিত শাহ বলেছেন, ‘চুন চুনকে নিকাল দেঙ্গে’। দিল্লির বিজেপিনেতা কপিল মিশ্র পড়ুয়াদের মিছিল সম্পর্কে বলেছেন, ‘শালোকো গোলি মারো’। মেঙ্গালুরুতে পুলিশের গুলি এবং আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর ঘটনায় বিজেপি নেতা এইচ রাজা নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, ‘গুলির বদলে গুলি তো চলবেই’। যদিও আন্দোলনকারীরা গুলি চালিয়েছে, বা তাদের গুলিতে কোনও পুলিশ আহত হয়েছে, এমন কোনও ঘটনার কথা এখনও কারও জানা নেই। কর্নাটকের মন্ত্রী সি টি রবি, সংখ্যাগুরুর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলে কী হতে পারে বলে, নরেন্দ্র মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাট দাঙ্গার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ভারতের সংখ্যালঘু মানুষদের। যদিও এই আন্দোলন শুধু সংখ্যালঘুদের আন্দোলন নয়। মিছিল দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। রেলের প্রতিমন্ত্রী সুরেশ অঙ্গারি বলেছেন এর পর রেলের সম্পত্তির ক্ষতি করলে গুলি চালানো হবে। যদিও রেলের সম্পত্তির ক্ষতি কারা করছে তাদের একটা দল ইতিমধ্যেই ধরা পড়ে গিয়েছে।
দেশজুড়ে পতাকাবিহীন তারুণ্যের এই জনজোয়ার প্রমাণ করে, জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ভারত। দৈনন্দিন রাজনীতি নিয়ে হয়তো এই তরুণসমাজ মাথা ঘামায় না, কিন্তু দেশ সংকটে পড়লে যে তারা পথে নেমে প্রাচীর গড়তে পারে তা আবার প্রমাণ হল। বেশ জোরের সঙ্গেই প্রমাণ হল। এই মিছিলের পাল্টা মিছিল কী হচ্ছে না? হ্যাঁ হচ্ছে। সারা দেশে তো হয়েছেই, আমাদের রাজ্যে উত্তরবঙ্গেও হয়েছে। শুধু হয়েছে না, সেই মিছিল সংখ্যায় অনেক বেশি। তা দৈর্ঘ্যেও অনেক বড়। এর উত্তর বলতে হয়, শাসকদলের সঙ্গে বিদ্বেষ-আদর্শে পা-মেলানো ভিড়, ইতিহাস বলে, অনেক সময়ই তার জয় হয়েছে, কিন্তু শেষ কথা বলেনি। কারণ তাদের নতুন কিছু বলার নেই। দেওয়ারও নেই।
(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)
এই কলামের সব লেখা পড়ুন এই লিংকে
পড়তে ভুলবেন না বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইন ও ইসলাম ধর্ম