Advertisment

প্রশ্ন একটাই: বন্ধ তালা খুলবে কবে?

এদেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। অথচ তাঁরা আয়কর এবং জিএসটি, দুটোই দিয়ে থাকেন। সারা বছর এত খাতে এত টাকা কর হিসেবে পাওয়ার পরও সরকারের খাজানা বিস্ময়কর ভাবে খালি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus india lockdown third phase

লকডাউনের তৃতীয় পর্বে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা গ্রাস করছে দেশকে। ছবি: অরুল হরিজন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

আমাদের কৈশোর-যৌবনকালের কথা। রাজনৈতিক ডামাডোলে উত্তাল বাংলা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে একের পর এক কারখানা। 'লক আউট' কথাটা তখনই প্রথম শুনি। চোখের সামনে দেখলাম, এক বিশাল সংখ্যক মানুষের দিনযাপনের চালচিত্রটাই কেমন বদলে গেল। এদেশের হতভাগ্য মানুষের তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। হয়েই চলল।

Advertisment

চিচিং ফাঁক!

চিচিং বন্ধ!

একটি জিনিস এই লম্বা জীবনে চলতে চলতে বুঝে গেলাম, তালা একবার বন্ধ হয়ে গেলে, আর খোলে না। যদি বা খোলে, হারানো দিন আর ফিরে আসে না। লক ডাউনের তৃতীয় পর্বে পৌঁছে দেশের অর্থনীতির হাল খুব সঙ্গত কারণেই উস্কে দিল লক আউটের স্মৃতি। একমাস পার হয়ে গেছে দেশের মানুষ গৃহবন্দি। কোভিড ১৯-এর সংক্রমণ ঠেকাতে শুরুতে অপরিহার্য এই সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে বিস্তারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বিশ্ব জুড়ে এই ভাইরাসকে ঘিরে আতঙ্ক তুঙ্গে উঠেছিল। 'উঠেছিল' বলছি, কারণ, এই মুহূর্তে যেন সেই আতঙ্ককে ছাড়িয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার ভয়াল ছবি। সমীক্ষা বলছে, ভারতে ২ কোটির ওপর মানুষের কাজ হারাবার সম্ভাবনা। এই মুহূর্তে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

'বাড়িতে থাকুন!

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন!'

শুনতে শুনতে ক্লান্ত মানুষ।এখন তাঁদের মনে প্রশ্নের পাহাড়। কবে উঠবে লকডাউন? খোলার পরও তো থাকছে সংক্রমণের ভয়। এই যে এতদিন ঘরে বসে থাকার ফলে বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়লাম, তার ভরপাই কী করে হবে? লকডাউন কবে উঠবে, তাই নিয়ে এখনও খুল্লাম খুল্লা কিছু বলছে না কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্য সরকারগুলির পক্ষ থেকেও এই নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত মেলেনি। এরই সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্র-রাজ্য সমন্বয়ের অভাব। আর সংক্রমণ, পরীক্ষানিরীক্ষা, চিকিৎসা, রেড-অরেঞ্জ-গ্রিন জোন, কন্টেইনমেন্ট ইত্যাদি নিয়ে যে করোনা-মহাভারত তৈরি হয়েছে, তাতে সংশয় আরও বেড়েছে।

আরও পড়ুন: ‘খালি পেটে মরে যাও, করোনায় মোরো না’, মধ্যবিত্তের যন্ত্রণা রুদ্রনীলের ভিডিওতে

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইনফেকশাস ডিজিজ রিসার্চ অ্যান্ড পলিসির গবেষকরা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের মহামারী শেষ হতে এখনও দু'বছর লাগতে পারে। বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের মধ্যে এই রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসবে না। প্রসঙ্গত, এমন একটি আভাস বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ( WHO)-এর পক্ষেও দেওয়া হয়েছিল। ভারতের মতো মাত্রাতিরিক্ত জনবহুল দেশে বিষয়টা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।

তাহলে কি ততদিন পর্যন্তই লকডাউন চলবে? সেটা নিশ্চয়ই বাস্তবে সম্ভব নয়। এই প্রেক্ষিতেই উঠে এসেছে 'হার্ড ইমিউনিটি'-র মতো গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বের কথা। হার্ড ইমিউনিটি মানে, যাঁর শরীরে যতটুকু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, তার শক্তিতেই ভাইরাসের মোকাবিলা করা। রোগে আক্রান্ত হওয়া ও গোষ্ঠী সংক্রমণের মধ্য দিয়েই প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। কথা হলো, হার্ড ইমিউনিটির প্রয়োগ হলে, সেটা এত দেরিতে কেন? তাহলে লকডাউনের যৌক্তিকতা আর কতটুকু রইল? মোদ্দা কথা, দিনের শেষে আমাদের করোনা আপডেট কী? সংক্রমণ প্রতিরোধ হলো বা হবে কিনা জানা নেই। হার্ড ইমিউনিটির তত্ত্ব সত্যি হলে, এখন আর সেটা কতদূর ফলপ্রসূ হবে? প্রাপ্তি কিছু ধর্মীয় টোটকা, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে কিছু ভুল, মিথ্যে ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচার, এবং রাজনৈতিক দলগুলির নানা স্বার্থসিদ্ধির সমীকরণ।

এবার অর্থনীতি প্রসঙ্গ। সারা বিশ্বের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলছেন, কর্মহীনতার এই বন্ধ তালা এক্ষুনি খোলা প্রয়োজন। মানুষকে নিজের স্বার্থে সংক্রমণ প্রতিরোধের নিয়মগুলি মানতে হবে। সেটা একটা দিক। কিন্তু কৃষি, শিল্প ও পরিবহণ আর বেশিদিন বন্ধ রাখলে সর্বনাশ ঠেকানো যাবে না। মুশকিল হলো, করোনা নিয়ে যে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, যে পরিমান বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, তাতে যে কোনও সমান্তরাল ভাবনা, সে যতই বাস্তবোচিত হোক, আমরা অনেকেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আর নিজের গায়ে আঁচ না লাগা পর্যন্ত অন্যের সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকাটা তো আমাদের জাতীয় চরিত্র। তাই অনেকেই লকডাউনের সমর্থনে সোচ্চার।

আরও পড়ুন: ‘পরিযায়ী শ্রমিকরা চলে গেলে সমস্যা হবে’, বণিকসভার দাবির পরই শ্রমিক স্পেশাল বাতিল কর্নাটকের

বিশ্বখ্যাত টেলসা ও স্পেসএক্স-এর সিইও ইলন মাস্ক টুইটারে লকডাউনকে ফ্যাসিজমের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ওঁর কথায়, এটা নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। বলা বাহুল্য, এর জন্য বিপুল সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি। খোদ মার্কিন মুলুকেই এই নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। লোকজনের বক্তব্য, মাস্কের নিজের গাড়ির ব্যবসায় ক্ষতি হচ্ছে বলেই তাঁর এহেন অভিমত। কথাটা হয়তো ভুলও নয়। কিন্তু কোথাও কি ওঁর মতামত অপ্রিয় হলেও সত্য নয়? এই জাতীয় যে কোনও বৃহৎ ব্যবসার সঙ্গে যে অনুসারী শিল্পগুলি জড়িয়ে, সেখানেও তো পড়ছে প্রভাব।

এ তো গেল বৃহৎ শিল্প। ক্ষুদ্র, কুটির, মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পের ক্ষেত্রেও তো একই কথা প্রযোজ্য। কারখানার কাজ, কাঁচামালের যোগান, কাঁচামালের উৎপাদন, সর্বত্র ছড়িয়ে আছে মানুষের শ্রম ও বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই শিল্পগুলির ওপর বহুলাংশে দাঁড়িয়ে বাজার অর্থনীতিও। টাকার লেনদেন না হলে থমকে যাবে অর্থনীতির চাকা। এছাড়া পণ্য যতটুকু মজুত ছিল, তা বাজারে এসে এবার শেষ হওয়ার পথে। এখনই এগুলির উৎপাদন শুরু না হলে বাজারেও টান পড়বে। অর্থাৎ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ওষুধের উৎপাদন। লকডাউনের ফলে পরিবহন বন্ধ থাকায় এমনিতেই বাজারে ওষুধের সঙ্কট। এখনই উৎপাদন শুরু না হলে বিপদ।

অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় অনেক আগেই সরাসরি টাকা ছাপিয়ে নিম্নবিত্ত মানুষের হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। এতে টাকার মূল্য আরও একটু পড়ে গেলেও এই মুহূর্তে এই মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে এর বিকল্প পথ নেই। এখানেও সেই বাজার অর্থনীতির রথের চাকাটাকে চালু রাখার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে জোর দিয়েছেন তিনিও। সাহায্য হিসেবে সরকারি রেশন, অনুদান ইত্যাদি যথেষ্ট নয়। তারপরও আবার সরকারি প্রতিশ্রুতি মতো টাকা বা অন্যান্য দ্রব্য মানুষের হাতে যথাযথ পৌঁছয় না। আছে অসাধুতা ও অবহেলা। এসবের তদারকি করার লোকেরও অভাব। এক্ষেত্রে গরীব মানুষ সরাসরি টাকাটা সঠিক মাত্রায় পেলে অন্তত স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন। ওঁর মতে, নাগরিক পরিচয়পত্র বিষয়টিকেও আপাতত দূরে রেখে মানুষকে সাহায্য করার ভাবনাটা জরুরি। প্রয়োজনে সাময়িক পরিচয়পত্র তৈরি করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: কোভিড অর্থনীতি- নিম্ন আয়ের কর্মীদের কাজ হারানোর আশঙ্কা বেশি

আদতে ভূমিহীন কৃষক, কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের থেকে খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই মধ্যবিত্তও। অনেকেই কর্মহীন, এবং চাকরি থাকলেও কবে বেতন পাবেন, আদৌ পাবেন কিনা, সেই চিন্তায় বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন। এখানে 'ওয়ার্ক ফ্রম হোম'-এর পরিকাঠামো সব সংস্থার ক্ষেত্রে নেই এখনও। পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ চালু না হলে অফিসকাছারি খোলা সম্ভব নয়। এদেশের মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। অথচ তাঁরা আয়কর এবং জিএসটি, দুটোই দিয়ে থাকেন। কথামতো যে কোনও একটি ব্যবস্থা চালু রাখার প্রতিশ্রুতি রাখেনি সরকার। বছর বছর দেওয়া ট্যাক্সের বিনিময়ে আর্থিক বিপদের সময় কেন সাহায্য পাবেন না তাঁরা, তার কোনও জবাব নেই। এদিকে ব্যাঙ্কের সুদ কমেই চলেছে।

সম্প্রতি দুটি পরস্পর বিরোধী সিদ্ধান্তে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিতর্ক তুঙ্গে। এই ভয়াবহ আর্থিক অপ্রতুলতার মধ্যে কেমন করে বিশাল পরিমান টাকার ঋণ মকুব করা হলো মেহুল চোকসি, বিজয় মাল্য ও রামদেবের মতো আর্থিক দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের? এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান মোটেই স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরানোর ট্রেনভাড়া নিয়ে তো রীতিমতো নাটক হয়ে গেল। প্রথমে শ্রমিকদের ভাড়া দিতে হবে জানানো হলো। সঙ্গে বাড়তি ৫০ টাকা। তারপরই কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী জানালেন , তাঁর দল এই ব্যয়ের পুরোটাই বহন করবে। এরপর আবার সরকারি সিদ্ধান্ত বদল। কেন্দ্র দেবে ভাড়ার ৮৫ শতাংশ, বাকিটা রাজ্য। যদিও সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়। কেন সেটা জনসমক্ষে আসেনি, সেই জবাব মেলেনি।

সারা বছর এত খাতে এত টাকা কর হিসেবে পাওয়ার পরও সরকারের খাজানা বিস্ময়কর ভাবে খালি। সেখানে ঘটা করে করোনা মোকাবিলায় একটি দান-খয়রাতির যোজনা খোলা হয়েছে। এটি করমুক্ত। এর কোনও অডিটও হবে না। সেখানে ইতিমধ্যেই কী পরিমান টাকা জমা পড়েছে জানতে চাইলে শুধু গুগল পে (এমন অজস্র আছে। আছে ব্যক্তিগতকৃত দান) অ্যাপটি নিয়মিত দেখতে পারেন। চোখ কপালে উঠবে। নিশ্চিন্তও হতে পারেন এই ভেবে যে এরপর নিশ্চয়ই দেশের আর্থিক দৈন্যদশা ঘুচবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus Lockdown
Advertisment