২০০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০০৩ রাজ্য সভায় পেশ ও পাশ হয়। ওই আইনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল- (১) অনুপ্রবেশকারী বা বেআইনি অভিবাসীর সংজ্ঞা নির্ধারণ, (২) জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার শর্তযুক্ত করা এবং (৩) সারাদেশে নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি করার নির্দেশ। এই বিল সংসদে সর্বসম্মতভাবে পাশ হয়।
গরিব ও নিরক্ষর দেশান্তরিত উদ্বাস্তু মানুষের নাগরিকত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে যায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের অধিকার শর্তযুক্ত করে দেওয়ায়। শর্ত হল- বাবা এবং মা, দুজনেই ভারতের বৈধ নাগরিক না হলে তাঁদের সন্তান ভারতে জন্মগ্রহণ করলেও, জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাবেন না। গত পরশু পাশ হয়ে যাওয়া ২০১৯ সালের সংশোধনী বিলে এই সম্পর্কে কোনও কথা নেই। বিরোধীরাও এই প্রশ্নে হৈ চৈ করেন নি।
বিরোধীরা নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছেন; কিন্তু তাঁরা নাগরিকপঞ্জি তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া আইনের ১৪এ ধারার বিরুদ্ধে সরব নন কেন, সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজ করা দরকার।
বর্বর গরিষ্ঠতার শক্তি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল
নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৯ -এর মূল বিষয় হল- আইনে অনুপ্রবেশকারীর সংজ্ঞা দেওয়া ২(১)(বি) ধারায় একটি সংশোধন। এই ধারায় বলা হয়েছিল- যে কেউ অর্থাৎ হিন্দু, মুসলমান, শিখ প্রভৃতি সব সম্প্রদায়ের যে কোনও মানুষ বিনা অনুমতিতে ভারতে প্রবেশ করলে বা অনুমতি নিয়ে ভারতে এসেও অনুমতির সময়সীমা পার হবার পর ভারতে থেকে গেলে, তিনি অনুপ্রবেশকারী এবং এইসব অনুপ্রবেশকারী ভারতের নাগরিকত্ব পাবার অনধিকারী।
সদ্য পাশ হওয়া সংশোধনীতে কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে অমুসলিমদের ওই ২(১)(বি) ধারা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ অমুসলিমরা অনুমতিপত্র ছাড়া ২০১৪ সালের আগে ভারতে এসে থাকলে তাঁরা আর অনুপ্রবেশকারী নন এবং চাইলে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
এখন বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার যে, এই সংশোধনীর জন্য কি হিন্দু, বৌদ্ধ উদ্বাস্তুরা ভারতের নাগরিক হয়ে গেলেন? - বি জে পি ও সংঘ পরিবার প্রচার করছে, উদ্বাস্তুরা নিঃশর্তভাবে নাগরিকত্ব পেয়ে গেলেন বা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন। এই প্রচার বহু উদ্বাস্তু মানুষ বিশ্বাস করছেন এবং খুশি হয়ে আনন্দ প্রকাশ করছেন!
কিছু উদ্বাস্তু নেতা বলছেন- উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন, এই বিল আইনে পরিণত হলে বাঙালি উদ্বাস্তুরা নাগরিকত্ব পাবেন না। তাঁদের মতে ২০০৩ সাল থেকে মতুয়া-উদ্বাস্তুদের আন্দোলনের চাপে বি জে পি নিজেদের করা আইন পরিবর্তন করতে বাধ্য হল ঠিকই ; কিন্তু তারা আবারও উদ্বাস্তুদের ধোঁকা দিল। বিরোধীরাও কোন প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনলেন না! এই প্রশ্নে উদ্বাস্তু নেতাদের যুক্তি হলো- বিলে উল্লেখ করা শর্ত উদ্বাস্তুরা পূরণ করতে পারবেন না। পূর্ববাংলা যে বাঙালি উদ্বাস্তুদের আদি বাসভূমি তার প্রমাণপত্র যেমন জোগাড় করা কঠিন, আরও কঠিন কাজ হলো ধৰ্মীয় অত্যাচারে তাঁরা যে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন, তা প্রমাণ করা।
ঠিক কীভাবে নাগরিকত্ব ‘সংশোধন’ করবে মোদী সরকার?
মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি)কে লিখিতভাবে জানিয়েছে যে, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পেতে হলে অবশ্যই তাঁদের ধর্মীয় অত্যাচারের প্রমাণপত্র দাখিল করতে হবে। নেতারা মুখে যাই বলুন, এটাই সরকারের নীতি। ধর্মীয় অত্যাচারের প্রমাণপত্র দাখিল করলে 'র' ও সরকারের অন্যান্য তদন্তকারী সংস্থা সেই দাবি যাচাই করে দেখবে বলে জেপিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে (জেপিসি রিপোর্ট অনুচ্ছেদ ২.১৮, পৃষ্ঠা ৩৩)। এমনকি জেপিসি রিপোর্টে বলা হয়েছে এই বিল পাশ হলে আপাতত মাত্র ৩১৩১৩ জন উদ্বাস্তু নাগরিকত্ব পেতে পারেন।
অনেকে বলছেন যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকি সংসদে বলেছেন- রেশন কার্ড বা কোনও প্রমাণপত্র লাগবে না, উদ্বাস্তুরা প্রমাণপত্র ছাড়াই নাগরিকত্ব পাবেন! মুখে যদি তিনি এমন কথা বলেও থাকেন, মনে হয় সে কথার তেমন কোনও গুরুত্ব নেই। তবে একটি খবরের কাগজ (আনন্দ বাজার ১০/১২/২০১৯) এ ব্যাপারে অমিত শাহের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে, - "স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে বলছি, রেশন কার্ড থাকুক বা না থাকুক, কোনও সমস্যা নেই। যে (অমুসলিম) শরণার্থীরা ভারতে শরণ নিয়েছেন তাঁরাই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন।"
বিলে যে কথা লেখা আছে তার সাথে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথার মিল আছে। এটাই সঠিক কথা, তাই হিন্দু উদ্বাস্তুদের এতে উল্লসিত হবার কারণ নেই। বরং মনে করার যুক্তি আছে যে তাঁদের সুদীর্ঘকালের সমস্যা থেকেই গেল! দরখাস্ত করতে পারলেও নাগরিকত্ব মিলবে না। বরং কিছু বাড়তি সমস্যার মধ্যে তাঁরা পড়তে পারেন। মনে হয় বিজেপি-র এটাই গেমপ্ল্যান যে, উদ্বাস্তুদের বেনাগরিক হিসাবে ভারতে থাকতে দেওয়া!
উদ্বাস্তুরা চান নাগরিকত্বের একটা ভিত্তিবর্ষ; যার আগে ভারতে এসে থাকলে তাঁদের নাগরিক বলে ঘোষণা করা হোক। যেমন অসমের ক্ষেত্রে ভিত্তিবর্ষ ১৯৭১ সাল। উদ্বাস্তুদের দাবি ছিল ২০১৯ সালকে তেমনি এক ভিত্তিবর্ষ ঘোষণা করা হোক। বি জে পি ঘোষণা করল ২০১৪ সাল। হয়তো তাও উদ্বাস্তুরা মেনে নিতেন; কিন্তু ২০১৪ সালকে করা হল আবেদন করার অধিকারের ভিত্তিবর্ষ, নাগরিকত্ব অর্জনের ভিত্তিবর্ষ নয়!
বিভিন্ন তথ্যে জানা যায় যে, ভারতে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু এসেছেন। যদি ধরে নিই যে, যখন রুলস তৈরি হবে তখন বলা হলো যে, ধর্মীয় নির্যাতন ইত্যাদির ক্ষেত্রে প্রমাণপত্র ইত্যাদির পরিবর্তে আবেদনকারীর নিজস্ব ঘোষণা বা হলফনামা গ্রাহ্য হবে। তাহলেও এই বিপুল সংখ্যক মানুষের আবেদনপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা, তদন্ত ইত্যাদি সম্পূর্ণ করে উদ্বাস্তুদের নাগরিক সার্টিফিকেট দিতে কত সময় লাগবে? কতজন আবেদনকারী জীবদ্দশায় নাগরিক সার্টিফিকেট পাবেন? তখন কোন সরকার থাকবে, কী হবে তা কে বলতে পারেন!
অথচ অমিত শাহ বলছেন - ২০২৪ সালের মধ্যে সরকার সারা দেশে নাগরিকপঞ্জির কাজ শেষ করবে। তাহলে কজন উদ্বাস্তুর নাম নাগরিকপঞ্জিতে উঠবে? এত আবেদনপত্র পরীক্ষা ও সিদ্ধান্ত নেবার মত সরকারি পরিকাঠামো আদৌ আছে কি? কত বছরে তা গড়ে তোলা সম্ভব? কেউ জানেন না যে, নাগরিক সার্টিফিকেট দেবার ক্ষমতা দিল্লির নর্থ ব্লকে কেন্দ্রীভূত থাকবে, না তা বিকেন্দ্রিকরণ হবে? - এসব নিয়ে সংসদে আলোচনা কই!
বিলটি নিয়ে উদ্বাস্তুদের একাংশের বিরোধিতা, আপত্তি ও আশঙ্কা এইসব কিছু নিয়ে। অন্যদিকে বিলের বিরোধিতা করা হচ্ছে এই বলে যে বিলটি সাম্প্রদায়িক। তা সংবিধানের মূল চরিত্রের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ! এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, সব পক্ষ মোটামুটিভাবে একমত যে, দেশভাগের শিকার হয়ে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পাওয়া উচিত। কেউ অস্বীকার করছেন না যে, অতীতে জাতীয় নেতা ও সরকার উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব নেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কেউ সেই দায়িত্বের কথা অস্বীকারও করছেন না। তবুও উদ্বাস্তুদের সমস্যা ৭৩ বছর পরেও জ্বলন্ত সমস্যা।
এখন প্রশ্ন- তাহলে এই সমস্যা কীভাবে মেটানো যায়?- যাঁরা বলছেন বিলটি সাম্প্রদায়িক ও অসাংবিধানিক তারা সংবিধানসম্মত বিকল্প প্রস্তাব দিন। বিলটি বাতিল করার জন্য সওয়াল না করে বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারেন যাতে উদ্বাস্তুদের সমস্যার সমাধান হয় অথচ সংবিধান লঙ্ঘন না হয়। কিন্তু বিরোধীরা যা বলছেন ও করছেন, তাতে উদ্বাস্তুদের মনে হতে পারে যে, মুসলমান সম্প্রদায়ের অজুহাত খাড়া করে তাঁদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা হচ্ছে। যার জন্য এই উদ্বাস্তুরা হয়তো আশ্রয় হিসাবে বিজেপি-কে বেছে নিতে চাইছেন।
এ কথা ভাবা ও বোঝা দরকার যে, নাগরিকত্ব বিল, ২০১৯ ভারতের (ভূমিপুত্র) নাগরিক হিন্দু বা মুসলমানদের কোনও বিষয় নয়। এটা হল বহিরাগতদের নাগরিকত্ব দেওয়া, না দেওয়া, কীভাবে দেওয়া হবে, সেসব বিষয় সম্পর্কিত। আরও নির্দিষ্ট করে বললে- এক দুর্গত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘকালের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট ও সীমিত সময়কালের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা- যা মুসলমানদের স্বার্থ ও অধিকারগুলিকে কোনভাবে প্রভাবিত করে না, করবে না। এই ব্যবস্থা সংবিধানের ১৪ ধারাকে লংঘন করে না; বরং দীর্ঘ সময়কাল ধরে দেশভাগের শিকার উদ্বাস্তুদের ১৪ ধারায় বর্ণিত সমতার অধিকার থেকে বঞ্চনার অবসান ঘটানো।
উত্তর-পূর্ব ভারতের মানুষের এই বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে কেউ সমর্থন নাও করতে পারি; কিন্তু তাদের বিরোধের কারণ বোঝা যায়। তাঁরা সেখানে বহিরাগত মানুষের চাপের প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলি ও মুসলমান সমাজ কেন এই বিলের বিরোধিতা করছেন, তা বোঝা দায়!
বি জে পি ও সংঘ পরিবার হিন্দু, বৌদ্ধ উদ্বাস্তুদের প্রতি সত্যি যদি আন্তরিক হত, তাহলে তাঁদের নাগরিক ঘোষণা করত। কিন্তু নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার পথে উদ্বাস্তুদের ঠেলে দেবার অর্থ দাঁড়াবে তাঁদের এক গোলোকধাঁধায় আটকে দেওয়া। সেজন্য অনেকের মনে হচ্ছে উদ্বাস্তুদের সমস্যা না মিটিয়ে জিইয়ে রেখে তাঁদের নিয়ে রাজনীতি করার চিরাচরিত পথে বি জে পিও হাটতে চাইছে।
যাঁরা ভারতের মূল নাগরিক, নাগরিকত্বের প্রশ্ন তুলে তাঁদের কোনভাবে হয়রানি করা উচিত নয়। এক খণ্ড কাগজ না থাকায় কোন নাগরিককে বেনাগরিক করে দেওয়া যায় না, তা তিনি হিন্দু বা মুসলমান যে কোনও ধর্মের মানুষই হোন না কেন। আর যেসব উদ্বাস্তু ভারতে বসবাস করছেন, এতকাল বসবাস করায় আপত্তি না তুলে, এখন তাঁদের তাড়িয়ে দেবার কথা মানা যায় না, তা অনুচিত কাজ। বাস্তবত আজ আর তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়, কোনও দেশ তাঁদের গ্রহণ করবে না।
এই অবস্থায় ভূমিপুত্র ও বহিরাগত কাউকে হয়রানি না করে যুক্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান হলো- ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী সবাইকে ভারতীয় নাগরিক ঘোষণা করে একটি ক্যাব পাশ করা এবং সব নাগরিককে জাতীয় পরিচয় প্রদান করা।
(সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালি রিফিউজিস-এর সভাপতি এবং অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের সহ সভাপতি। মতামত ব্যক্তিগত)