উপপাদ্য মানে তার একটা আঙ্কিক বিবৃতি থাকে। তারপর বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ করতে হয় সেই বিবৃতি। প্রমাণের জন্যে কিছু স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিয়ে অঙ্ক শুরু করতে হয়। কিন্তু সমাজ আর জীবনের সব কিছু অনায়াসে প্রমাণ হয় না। যেমন খুব সহজে কি প্রমাণ করতে পারবেন যে আপনার শরীরে ২০৬ টা হাড় আছে? এটা অবশ্য ভীষণ শক্ত হয়ে গেল। তুলনায় সহজ উপপাদ্য এবং তার প্রমাণের চেষ্টা করা যাক।
চোখের ওপর চশমা ঝুলছে। বাজারে খুব মন দিয়ে অনেক বেছে বার করলেন পোকা ধরা বেগুনটাকেই। লেন্সের সহায়তায় সঠিক নির্বাচন, ঠিক যেরকমটি আমরা দেশের প্রতিটি নির্বাচনে করে থাকি। সবজিওয়ালা অনেকদিনের চেনা। সে জিজ্ঞেস করল চশমার পাওয়ার কত। ঘোষণা করলেন ঋণাত্মক দুই দশমিক পাঁচ। প্রমাণ করতে পারবেন? সেই মুহূর্তে অসম্ভব। বড়জোর বাড়ি ফিরে প্রেসক্রিপশন খুঁজে বার করে দেখাতে পারেন। কিন্তু ডাক্তার যে ভুল লিখে দেন নি, কিংবা আপনি যে একটা জাল প্রেসক্রিপশন দেখাচ্ছেন না, তার প্রমাণ কী?
ঠিক সেরকমই নাগরিকত্বের বিষয়টি। সবাই জানি আমরা প্রায় সকলেই নাগরিক। আমাদের মধ্যে একটা বড় অংশ জানি আমরা হিন্দু। কিন্তু নিজের হিন্দুত্ব ঠিক কিভাবে প্রমাণ করব, সেই উপায় জানা নেই। নাগরিকত্বের আশায় শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ থেকে অশোকস্তম্ভের ছাপ খুঁজে পাওয়া শক্ত। সেই প্রেক্ষিতে সরকার বা ক্ষমতাশালী মানুষ যা সিদ্ধান্ত নেবেন, তার ওপর নির্ভর করেই ঠিক হবে সবকিছু।
আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল: উদ্বাস্তুরা প্রতারিত হলেন
বিষয়টা একেবারেই সাদামাটা, আমাদের এই খুব চেনা ভারতের নাগরিকত্ব। কিন্তু তাকে দেখতে হচ্ছে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে। একদিকে আসছে, কী কী কারণে আপনি নাগরিক, তার বিভিন্ন প্রমাণ আপনাকে খুঁজে বার করতে হবে। কাগজ হারালেই আপনি বাদ পড়বেন জাতীয় নাগরিকপঞ্জি থেকে। এই জায়গাটা এনআরসি-র।
অন্যদিকে একটি বিশেষ ধর্মের মানুষ না হলে আপনি কী কী ভাবে এই দেশের নাগরিকত্ব পেতে পারেন, তার নিয়মবিধি। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে আপনি যে ভারতবর্ষের নাগরিক নন, সেটাই প্রথম প্রতিপাদ্য, কারণ সেই জন্যেই আপনি নাগরিকত্ব চাইছেন। এই বিষয়টিকে বলা হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা সিএবি। যে বিষয়টি এখানে গোলমেলে তা হলো, দেশের ১৩০ কোটি মানুষের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যকের ক্ষেত্রেই নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। অর্থাৎ খুব অল্প সংখ্যক কিছু অ-নাগরিক বা আধা-নাগরিকের সমস্যা চেপে বসছে দেশের বেশিরভাগ মানুষের ওপর। বুঝতে একেবারেই অসুবিধে হয় না যে যেখানেই আমাদের দেশের জমি ঠেকেছে পাকিস্তান বা বাংলাদেশের সঙ্গে, সেখানে এই সমস্যা ভীষণ আকার নেবে। আসাম ভুগছে, এখন সেই ভোগার শুরু এই বাংলাতেও। শুক্রবার থেকেই রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে শুরু করেছে ভীষণভাবে।
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের খুব বেশি করে বোঝার দরকার, বিজেপি কেন এই বিষয়টা চাইছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা যে নিজেদের ভোট বাড়াতে উৎসুক তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে সেই দলের কিছু মানুষ সৎভাবে মনে করছেন যে মুসলিম-অধ্যুষিত পাকিস্তান, আফগানিস্তান কিংবা বাংলাদেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে এদেশে আশ্রয় নিতে আসবেন অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষেরা। সেই কারণেই বছর পাঁচেক আগে পর্যন্ত এই তিন দেশ থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন এবং পার্সি, সকলকেই নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আগে এ দেশে থাকতে হত এগারো বছর, এখন পাঁচ বছর হলেই এই সুবিধে মিলবে।
আরও পড়ুন: বর্বর গরিষ্ঠতার শক্তি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল
অর্থাৎ এটা মনে করা হচ্ছে যে এই তিনটি দেশে মুসলিমরা অত্যাচারিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। এটাই দক্ষিণপন্থীদের সাধারণ যুক্তি। মুশকিল হলো, তাঁরা যেহেতু দক্ষিণপন্থী, তাই তাঁদের সংজ্ঞায় প্রগতিশীল, উদারবাদী মুসলিমদের বিষয়টি আসে না। এ নিয়ে কোনও সন্দেহই নেই যে দেশভাগের আগে এবং পরে ভারতের পড়শি দেশগুলিতে অত্যাচারিত হয়েছেন অ-মুসলিমরা, কিন্তু সেই সঙ্গে একই হাল হয়েছে সেদেশের সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলা সংখ্যাগুরু বুদ্ধিজীবীদেরও।
পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের গণতান্ত্রিক আবহাওয়া যে আজকে এতটা খারাপ, তার কারণ সে দেশের মুসলিমদেরও কথা বলার অধিকার নেই। পুরো ক্ষমতাটাই অল্প কিছু অন্ধবিশ্বাসী মৌলবাদীদের হাতে। তার হাত থেকে বাঁচতে যদি কোনও শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মুসলিম তাঁর বন্ধুবান্ধব বা পরিবার নিয়ে ভারতে আশ্রয় চান, তাহলে তো হিন্দু মহত্ত্বের কথা বলা শাসকদের খুশি হওয়ারই কথা।
অর্থাৎ এটা শুরুতেই বুঝে নিতে হবে যে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত পরিচ্ছেদ সমাজবিজ্ঞানের আওতায় পড়ে, ফলে এখানে সোজা অঙ্ক চলে না। কে নাগরিক, কেন নাগরিক, কখন নাগরিক, কোথাকার নাগরিক, এই গোটা বিষয়টা নির্ভর করে রাজনীতি এবং সমাজনীতির ওপর। ধরুন আপনি চোদ্দপুরুষ ধরে একেবারে গঙ্গার পশ্চিমে আছেন, আপনার ধর্ম হিন্দু। সমর্থন করেন উদারনীতি, সবসময় দেশ এবং রাজ্যের শাসক দল উভয়েরই বিরোধিতা করেন, সে যেই ক্ষমতায় থাক না কেন। ফলে সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি, কেউ আপনাকে পছন্দ করে না।
সেই প্রেক্ষিতে যদি হঠাৎ করে পাড়ার দাদা এসে এক কোঁৎকা মেরে আপনাকে পাকিস্তানের নাগরিক বলে দেয়, তখন আপনি করবেনটা কী? থানায় যেতে পারেন, কিন্তু আইনরক্ষক গুরুত্ব না দিয়ে আপনাকে ভাগিয়ে দেবে। আপনি উকিল ধরে আদালতে ছুটতে পারেন, কিন্তু তাতেও দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রচুর পয়সা খরচ। সব মিলিয়ে হয়রানির একশেষ। উদাহরণটা হয়ত একটু কষ্টকল্পিত হল, কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে এমনটা ঘটতেই পারে। অর্থাৎ নাগরিকত্ব নিয়ে আলোচনায় দেশের মধ্যে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে ক্ষমতাশালী শাসক শ্রেণীর যে কোনও প্রতিনিধি, তিনি পঞ্চায়েত প্রধান থেকে প্রধানমন্ত্রী যেই হোন না কেন, সাধারণ মানুষকে দেশছাড়া করার ভয় দেখাতে পারেন।
আরও পড়ুন: ঠিক কীভাবে নাগরিকত্ব ‘সংশোধন’ করবে মোদী সরকার?
গোটা গল্পের শুরু আসামের এনআরসি নিয়ে, যাকে বলা হচ্ছিল জাতীয় নাগরিকপঞ্জি। বিজেপি এই বিষয়টি লাগু করায় তুমুল উৎসাহী। তার ফলও তারা হাতেহাতে পেয়েছে। আসামে এখন তাদের সরকার। পশ্চিমবঙ্গে তারা প্রথম দুটি দলের মধ্যে আছে। লোকসভায় দারুণ ফলাফল, উপনির্বাচনে আসন হারালেও লোকসভার তুলনায় ভোট শতাংশ প্রায় একই আছে। অর্থাৎ এনআরসি লাগু করার কথা বলে দেশের কিছু অংশে তাদের ভোট বাড়তে শুরু করেছিল, সে নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
পশ্চিমবঙ্গে আপাতভাবে মনে হচ্ছে মানুষ হয়ত ভিটে হারানোর ভয় পেয়ে বিজেপিকে সমর্থন করবেন না। কিন্তু বিজেপি তো আর হারার জন্যে রাজনীতি করছে না। ফলে তাদের পেশ করার মত কিছু যুক্তি থাকবেই। তবে আসামের এনআরসি সংক্রান্ত কোনও বিতর্ক উঠলেই তারা বলছে যে এর শুরু রাজীব গান্ধীর আমলে, সেই আশির দশকে। অথবা যুক্তি দিচ্ছে যে দেশের উচ্চতম আদালতের রায়ে তাদের নাগরিকত্ব সংক্রান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তার মানে কি বাধ্য হয়ে আসামের এনআরসি সংক্রান্ত কাজ শুরু করতে হয়েছিল কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে? দল হিসেবে কি তারা এই বিষয়ে সহমত নয়? আর সেই কারণেই কি আসামের এনআরসি আপাতত মুলতুবি?
মুশকিল হলো, একথাও শোনা যাচ্ছে যে সিএবি লাগু হওয়ার পর আবার নতুন করে দেশজুড়ে চালু হবে এনআরসি-র অনুশীলন। সিএবি সংক্রান্ত আর একটি বিষয় কেন্দ্রীয় সরকার বারবার বলছে যে, উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের উপজাতি-প্রধান এলাকায় এই বিল লাগু হবে না। তাহলে সেখানে কি সিএবি চালু না হয়েই সরাসরি নতুন দফার এনআরসি-র শুরু? আসলে সমাজবিজ্ঞানে এটাই মুশকিল। কী কী হলো আর তার প্রেক্ষিতে কী কী হতে পারে, এই নিয়ে যত রকমের বিন্যাস হতে পারে, তার সবটা লিপিবদ্ধ করা অসম্ভব। সেই ফাঁকফোকরগুলো ধরেই চলে তর্কবিতর্ক, আর অত্যাচার করে সমকালের শাসক।
আরও পড়ুন: এনকাউন্টারের সপক্ষে নেটিজেন: ক্ষমতার অঙ্গুলিহেলন
সবশেষে যে আলোচনা বারবার উঠে আসছে তা হলো, সংবিধানের ১৪ আর ১৫ নম্বর ধারা। সাধারণ মানুষ আইন বা সংবিধানের কচকচি বুঝে সময় নষ্ট করতে চায় না। তার ঘর সংসার আছে। প্রতিদিনের কাজ আছে। তবু বাধ্য হয়ে যেটুকু বুঝতে হচ্ছে, তা অনেকটা এরকম। প্রথমটিতে বলা হচ্ছে যে আইনের বিচারে প্রতিটি মানুষের সমান সুরক্ষার বিষয়টি রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। পরেরটি বলছে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, জন্মস্থান, এইসব বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে কোনও বৈষম্য আমাদের দেশে চলবে না।
কিন্তু এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমানাধিকারের বিষয়টি নিয়ে দেশের উচ্চতম আদালতে সওয়াল হয়েছে বারবার। সমানাধিকারের সংজ্ঞা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। একথা বুঝতে অসুবিধে হয় না যে অ-সমের ক্ষেত্রে সমানাধিকারের বিষয়টি হয়ত কখনও অসাম্যকেই ডেকে আনে। তাই সেই যুক্তিকে সুযোগমত ব্যবহার করে আজকের শাসক বলতে চাইছে যে আমাদের আশেপাশের মুসলিম শাসিত দেশে অত্যাচারিত ভিন্ন ধর্মের শরণার্থীদের আমাদের দেশে আশ্রয় দেওয়া জরুরি। মুসলিমরা যেহেতু সেইসব দেশে ভালোই আছেন, তাই আমাদের দেশের তাঁরা অনুপ্রবেশকারী। আর ঠিক সেইখানেই প্রশ্ন আসবে যে, কোনও মুসলিম মানুষ যদি না খেতে পেয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে আমাদের দেশের উদ্দেশ্যে রওনা হন, তাহলে তাঁর হিসেব কোন অঙ্কে হবে?
একথা বাস্তব যে সন্ত্রাসবাদীদের আদর করে ডেকে এনে আমাদের দেশে ঢোকানোর কোনও অর্থ নেই। কিন্তু সেই বিচার করা জন্যে কি নাগরিকত্ব নিয়ে এত তত্ত্ব আলোচনার প্রয়োজন ছিল? সেখানে প্রয়োজন দেশের সীমান্ত কড়া হাতে রক্ষা করা, অথবা দেশের মধ্যে সুরক্ষা ব্যবস্থার কঠোরতর রূপায়ণ। কিন্তু তার বদলে নাগরিকত্ব নিয়ে গোলমালে সারা দেশের সুরক্ষাই আজকে বিঘ্নিত। আসাম কিংবা ত্রিপুরায় ভীষণ অশান্তি, ঝামেলা শুরু হয়েছে আমাদের রাজ্যেও। যদি ধরেও নেওয়া যায় যে বিজেপি আসলে দেশের মঙ্গল করতে চাইছে, সেই মঙ্গলের খরচ (আর্থিক এবং দেশের শান্তির দিক থেকে) আপাতত বাজারের সবজির মতই চড়া।
পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনের অনেক দেরি আছে। তাই এখন অনেক নিশ্চিন্তে বিজেপির প্রতিশ্রুতি রূপায়ণের কাজ চলছে। কিন্তু তাতে মোটের ওপর দেশের বুকে শান্তির আবহে যে ভাটা পড়ছে, সেদিকে নজর রাখার কথা একেবারেই ভাবছে না শাসকদল। অল্প কিছু অপ-নাগরিক খুঁজতে গিয়ে সুনাগরিকদের হয়রানি যাতে না হয়, সেই নিশ্চয়তা মানুষের কাছে না পৌঁছতে পারলে এই অশান্তি বাড়বে। তবে তাতে বিজেপির যে ভোট কমবে এমন কথা বলা যায় না। হিংসা, বিদ্বেষ, এবং অনিশ্চয়তার আবহে এই বাংলায় তৃণমূল এবং বিজেপির লড়াই আরও জোরদার হবে। উদারমনা, মধ্যপন্থী, প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভাবনার সুযোগ কমছে সারা বিশ্ব জুড়ে। আমাদের রাজ্য তার বাইরে থাকবে কিভাবে?
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)