নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি একটি চিনে রসিকতা খুব চালু ছিল। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার, রুশ নেতা বরিস ইয়েলতজিন এবং চিনের কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক জিয়াং ঝেমিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখেন সামনে দু'ভাগ হয়ে গিয়েছে পথ। কোনোরকম ইশারা না করেই ডানদিকে ঘুরলেন ক্লিনটন। ব্লেয়ার গেলেন তাঁর পিছুপিছু। অন্ধের মতো ওই দু'জনকে অনুসরণ করছিলেন ইয়েলতসিন, সুতরাং তিনি অন্য কোনওদিকে তাকালেনই না। দ্বিধাগ্রস্ত জিয়াং পিছন ফিরে তাঁর একমাত্র যাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, "কোন দিকে?" পিছনের আসনে বসা ডেং শাওপিং বললেন, "বাঁদিকে ইশারা করো, ডানদিকে ঘোরো।"
বিশ্বে গত চার দশক ধরে যে পরিবর্তন এসেছে, তার অনেকটাই ধরা রয়েছে এই কল্পিত ঘটনায়। গল্পের মূলে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতিগুলির পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে, এবং অভ্যন্তরেও, কিছু ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবর্তন। এই গল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ চিন, কারণ নিজের দেশের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বাড়ানোর তাড়াহুড়োতে ডেং ব্যাপক হারে মজবুত করেছিলেন বিশ্ব পুঁজিবাদকেও।
তবে এই বিস্ময়কর পরিবর্তনের তেল ফুরিয়ে আসছিল গত কয়েক বছরে, এবং করোনা সঙ্কট সম্ভবত তার কফিনে শেষ পেরেক পুঁততে চলেছে। আশির দশক থেকে চালু হওয়া ব্যাপক দক্ষিণপন্থী অভিমুখের বিপরীত দিকে হাঁটা এবার শুরু।
আরও পড়ুন: করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কি দেখবে নতুন চেতনা? নাকি এবারও শিখব না আমরা?
কিন্তু আরেকবার ফিরে যাই ওই চার নেতার কাছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে তার শ্রমিক শ্রেণীর শিকড় থেকে সরিয়ে নিয়ে রেগান বিপ্লব-মুখী করে দেন ক্লিনটন - যার ফল টানা হয় শিল্পে নিয়ন্ত্রণের ইতি, এবং আসে মুক্ত বাণিজ্য অর্থাৎ 'ফ্রি ট্রেড'। নিজের দলকে দক্ষিণমুখী করে আমেরিকায় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বনবাসের অবসান ঘটান ক্লিনটন। ব্রিটেনে প্রায় একই পথে হেঁটে লেবার পার্টির ভোল পাল্টে 'নিউ লেবার'-এর সংজ্ঞা তৈরি করেন ব্লেয়ার, অবসান ঘটে মার্গারেট থ্যাচার এবং জন মেজরের নেতৃত্বে প্রায় দুই দশকের কনজারভেটিভ শাসনের। ফ্রান্স এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলি 'অ্যাংলো-স্যাক্সন' পুঁজিবাদের বাড়াবাড়ি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করলেও মানিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পায় না।
সোভিয়েত ইউনিয়নের কবর খুঁড়ে পশ্চিমী মডেল সোৎসাহে বরণ করেন ইয়েলতসিন, এবং ওয়ারস প্যাক্ট (Warsaw Pact)-এর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সদস্য দেশগুলিও অর্থনৈতিক খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিয়ে ইউরোপীয় একত্রীকরণের রাজনৈতিক প্রকল্পে যোগদান করে। তবে এসবের মাঝেও চিনে পশ্চিমী পুঁজিবাদের প্রবেশ নিশ্চিত করে শেষ হাসি হাসেন ডেং শাওপিং।
তিয়ানানমেন স্কোয়ারে ১৯৮৯ সালের সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাবলীর পরবর্তী সময়ে চিন এক-আধবার নিজেদের অর্থনীতিকে বন্ধ দরজার ঘেরাটোপে রাখার কথা ভেবেছিল বটে। তবে ১৯৯২ সালে তাঁর বিখ্যাত 'দক্ষিণের সফরে' গিয়ে ডেং নির্দেশ দেন, পুনরুজ্জীবিত হোক অর্থনৈতিক সংস্কার, যা চিনের রাজনৈতিক ভাগ্য গড়ে দেয়। ডেং নিশ্চিত ছিলেন, "বামপন্থা" তুলনামূলক ভাবে "ডানপন্থার" চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক। তবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কম্যুনিস্ট দেশে 'ডানদিকে' ঘুরলেও 'বাঁদিকে' ঘোরার ইশারা করার প্রয়োজন ছিল। সুতরাং চিনের কম্যুনিস্ট পার্টি সমাজবাদের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেই থাকে, যদিও তাতে "চিনা ধরনধারণ" মেশানো হয়। নিন্দুকরা নাম দেন "লাল পুঁজিবাদ", বা "চিনা ধরনের পুঁজিবাদ"। চিনের কম্যুনিস্ট পার্টি তার কী নাম দেয়, তা অবান্তর, তবে বিশ্বে তার প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী।
আরও পড়ুন: ‘যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন, তাঁদের জন্য সরকার হাত খুলে খরচ না করলে পথ হারাব আমরা’
ওয়াশিংটনে তৈরি হওয়া নতুন ঐক্যমত্যের ফলে ফুলেফেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিপুল লাভের মুখ দেখে পশ্চিমী পুঁজিবাদ, চিনে আসে সমৃদ্ধির জোয়ার, এবং উপকৃত হয় ভারত সমেত উন্নয়নশীল আরও অসংখ্য দেশ। ইন্টারনেট অর্থনীতির প্রবেশ আরও বেশি করে সকলের মনে এই ধারণা এনে দেয় যে সীমানা-বিহীন এক পৃথিবী তৈরি হতে দেরি নেই আর।
কিন্তু এই সুখের সংসার ভেঙে দিতে উদয় হয় বিশ্বায়নে 'হেরে যাওয়া'দের দল। ব্রিটেনে ২০১৬ সালের 'ব্রেক্সিট' ভোটের দ্বারা সেদেশের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার ভাবনাচিন্তা বাস্তব রূপ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ওই ২০১৬ সালেই বাণিজ্যিক বিবাদ উস্কে দিয়ে ঢুকে পড়েন হোয়াইট হাউজে। ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল, বিশ্বায়নের ফলে চিনের হাতে চলে গেছে আমেরিকান চাকরি, যা তিনি ফেরত আনার প্রতিশ্রুতি দেন। ট্রাম্পের এই সাফল্যের ফলে বরাবর 'বড়লোকের দল' হিসেবে পরিচিত রিপাবলিকান পার্টি এখন হয়ে উঠেছে শ্রমিক শ্রেণীর মুখপাত্র, যারা বিশ্বায়নের মুষ্টিমেয় সমর্থকদের দ্বারা সৃষ্ট ভেদাভেদের বিরুদ্ধে লড়ছে! রাজনীতিতে সত্যি বিস্ময়ের কোনও শেষ নেই।
একইভাবে ব্রিটেনে ২০১৯ সালে শ্রমিক শ্রেণীর হৃদয়ে প্রবেশ করে, দেশের উত্তরভাগে লেবার পার্টির 'লাল দেওয়াল' ভেঙে, বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন বরিস জনসন। ট্রাম্প এবং জনসন উভয়েই আপাতত থ্যাচার-রেগান জমানার 'নিও-লিবারেল' অর্থনীতি উল্টে দিতে ব্যস্ত। সেই যুগের অন্যতম প্রধান কিছু উপাদান - মুক্ত বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সাবধানতা, রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রায়ন, শ্রমিক শ্রেণীকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলা, এবং চিনের সঙ্গে অংশীদারি - সবই আজ ওলটপালট।
মুক্ত বাণিজ্যের প্রতি প্রশ্নাতীত সমর্থন এখন পরিণত হচ্ছে 'ফেয়ার ট্রেড' বা ন্যায্য বাণিজ্যের আলোচনায়। ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে লন্ডন এবং ওয়াশিংটন উভয়েই কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বরাদ্দ করছে যাতে শ্রমিক শ্রেণীর বেতনে ঘাটতি না হয়। যে রিপাবলিকান পার্টি ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময় ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারকে আর্থিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করেছিল, সেই তারাই এখন অম্লানবদনে মার্কিন কংগ্রেস থেকে লক্ষ কোটি ডলার বরাদ্দ করছে।
অন্যদিকে মার্কিন মুলুকের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি প্রার্থী জো বাইডেন অর্থনৈতিক ইস্যুতে কিঞ্চিৎ বাঁদিকেই হেলছেন, যার নেপথ্যে রয়েছেন বার্নি স্যান্ডারস, যিনি নিজে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেও দলের নির্বাচনী মঞ্চে পুরোদমে সক্রিয়।
বাইডেন স্রেফ বাঁদিকে ইশারা করছেন, নাকি সত্যিই ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চিরাচরিত শ্রমিক শ্রেণীর ভিত পুনরুদ্ধার করতে চাইছেন, তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং বাইডেন মিলে চিনকে মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে আমেরিকার চেয়ে অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করে তুলেছেন, এবং চিনের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন, ট্রাম্পের এই অভিযোগ খণ্ডন করার দায়ও রয়েছে তাঁদের।
চিন, বিশ্বায়ন, এবং করোনাভাইরাস মহামারীর নেপথ্যে বেইজিংয়ের ভূমিকাকে বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাট-দের সঙ্গে এক সূত্রে গেঁথে ফেলেছেন ট্রাম্প, এবং পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নব্বুইয়ের দশকে তৈরি হওয়া 'চিমেরিকা'র ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা। ট্রাম্পকে ডেমোক্র্যাট-রা যতই হিংস্রভাবে আক্রমণ করুন, চিনের প্রতি কোনোরকম দুর্বলতা তারা প্রকাশ করতে পারবে না।
চিনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করার যে আশু প্রয়োজন বোধ করছে পশ্চিমী দুনিয়া, তাকে পুষ্টি যুগিয়েছে শি জিনপিং-এর ডেং-এর মুক্ত অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিজেদের প্রচ্ছন্ন রাখার নীতি ত্যাগ করা। বিশ্বায়নের ফলে সবচেয়ে উপকৃত চিন যে পশ্চিমী দুনিয়ার সুযোগ নিয়েছে, সেই ধারণাকে মদত যোগাচ্ছে করোনা সঙ্কট। দক্ষিণপন্থী অভিমুখ যদি গত চার দশকে বিশ্বের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন এনে থাকে, তবে বর্তমানের বামপন্থী মনোভাব - অ-বিশ্বায়ন, রাষ্ট্রের বৃহত্তর ভূমিকা, অসাম্যের অবসান ঘটানো এবং শ্রমিক শ্রেণীর নতুন করে ফিরে পাওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা - খুব সম্ভব সারা বিশ্বের রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক নীতির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। প্রভাবিত করবে পারস্পরিক রাজনৈতিক সম্পর্ককেও।
(লেখক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সিঙ্গাপুরের ইন্সটিটিউট অফ সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ-এর অধিকর্তা, মতামত ব্যক্তিগত)
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন