Advertisment

অতি প্রচারে বিভ্রান্তি, তা থেকে উৎপন্ন অমানবিকতা

আম জনতা যথাযথ তথ্য ও জ্ঞান বিষয়ে ততটা আগ্রহী নয়, যতটা হুজুগে। আর তাদের সন্দেহ নিরসনের চেষ্টা করার লোকই বা সমাজে ক'জন? আগুনে ধুনো দিতেই ব্যস্ত সবাই।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus covid 19 information

নিয়ম মেনে কাজ করাটা আজও আমাদের ঠিক মজ্জাগত হলো না। মঙ্গলবার হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় বেলিলিয়াস রোড। নিজস্ব চিত্র।

চেন্নাইয়ের এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসকের করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী, বন্ধু, ও পরিবারের সদস্যদের কপালে কী ভোগান্তি ঘটে, সেটা এখন মোটামুটি সকলেরই জানা। যে অ্যাম্বুল্যান্স তাঁর মরদেহ বহন করছিল, তার ওপর প্রচুর পরিমাণে ইট-পাটকেল ছোড়া হয়। মারাত্মক জখম হন গাড়ির চালক ও এক স্বাস্থ্যকর্মী। করোনায় মৃত কোনও ব্যক্তির সমস্ত সৎকার বিধি মেনে দেহ সমাধিস্থ করার সময়ও স্থানীয়রা বাধা দেয়। একই ঘটনা ঘটে চেন্নাইয়ের আম্বাত্তুর এলাকাতেও। ইনিও একজন চিকিৎসক। সমাধির সময় বাধা দেয় স্থানীয়রা।

Advertisment

চেন্নাই থেকে চলুন কলকাতায়। দমদমের এক প্রৌঢ়ের মৃত্যু হলো করোনায়। তাঁর স্ত্রীও করোনায় আক্রান্ত, ভর্তি এমআর বাঙ্গুরে। ছেলে আমেরিকায়। ছেলের সকাতর অনুরোধে রাজ্য সরকার দায়িত্ব নেয় সৎকারের। যাবতীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় নিমতলা শ্মশানঘাটে। সেখানে তখন অপেক্ষমান বিশাল জনতা। তারা কিছুতেই ওই প্রবীণ মানুষটির দেহ সৎকার করতে দেবে না। বহু কষ্টে, বিপুল পরিমাণ নাকাল হয়ে, রীতিমতো প্রশাসনিক সাহায্য নিয়ে বিষয়টিকে সামাল দিতে হয়।

করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির দেহ সৎকার বা সমাধিস্থ করা নিয়ে বারবার জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, এখন থেকে ধাপার মাঠে সৎকার ও বাগমারিতে সমাধিস্থ করা হবে। তাতেও শান্তি নেই। ধাপার মাঠে সম্প্রতি এক ব্যক্তির সৎকারে বাধা দেয় আশপাশের বস্তি থেকে জড়ো হওয়া বিশাল এক জনতা। তাদের বোঝাতে কালঘাম ছুটে যায় পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্মীদের। চিকিৎসকদের মতে, মৃতদেহ সৎকারের সময় উদ্গত ধোঁয়ায় জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা কম। তার থেকে অনেক বেশি ভয়ের এক জায়গায় এত মানুষের জড়ো হওয়া। লকডাউনের উদ্দেশ্যই তো ব্যর্থ হয়ে যাবে তাহলে। কিন্তু এসব শোনা বা বোঝার জায়গায় নেই জনতা, বোঝাই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: লকডাউন কার্যকর করার ‘অপরাধে’ হাওড়ায় ‘প্রহৃত পুলিশ’!

অমানবিক! এটাই বলব আমরা। মৃতদেহ সৎকারে বাধা দেওয়ার ফলে পরিবারের মানুষগুলি শোক ও বেদনার পাশাপাশি যে পরিমাণ হেনস্থার শিকার হচ্ছেন, তা নিশ্চিতভাবে নিন্দনীয়। চেন্নাইয়ের চিকিৎসকের ঘটনাটি তাঁর এক আত্মীয় ভিডিও করেন এবং সেটি সোশ্যাল মিডিয়ায় অচিরেই ভাইরাল হয়। সর্বত্র ধিক্কার ওঠে। নিন্দা আমরাও করছি। এই আচরণ কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু কথা হলো, শুধু নিন্দায় সোচ্চার হয়ে,  জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াকে অমানবিক ট্যাগ লাগিয়েই থেমে থাকব আমরা? না, কিছুটা হলেও তাদের এই আচরণের ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করব? তারা কি শুধুই অমানবিক? আতঙ্কিত, বিভ্রান্ত, সংশয়াচ্ছন্ন নয়? নানা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তারাও কি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছে না?

'নভেল' করোনাভাইরাস, ভাইরাসের দুনিয়ায় একেবারে নতুন চেহারায় ইনি, তাই নভেল। শুরুতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রসঙ্গে তথ্য ও বিবৃতি দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। কারণ, এর সম্পর্কে তেমন তথ্য তো তাদের ভান্ডারেও ছিল না। এখনও করোনা সম্পর্কে সব জ্ঞান করায়ত্ত নয়। মাঝেমাঝেই সে তার গতিবিধি বদলাচ্ছে। উপসর্গ পরিবর্তিত হচ্ছে। চিকিৎসক, গবেষকগণ দিবারাত্র এক করে লেগে আছেন সুলুকসন্ধানে। প্রতিষেধক আবিষ্কারের প্রানপণ চেষ্টা চলছে। একদিকে রোগের লক্ষণ, বিস্তারের হার বুঝে নেওয়া, প্রতিষেধক আবিষ্কার ইত্যাদি নিয়ে কাজ চলছে। অন্যদিকে যত এর প্রকোপ বাড়ছে, তত জরুরি হয়ে পড়ছে উন্নত ও যথাযথ চিকিৎসা পরিষেবা।

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯: বিজ্ঞান, তথ্য, এবং কিছু বিকৃতি

প্রশ্ন হলো, এই জায়গাটায় কতটা প্রস্তুত আমরা? আমরা মানে যদি এখানে বিশ্বকে মাপকাঠি করি, তাহলে আমেরিকার মতো উন্নত দেশে কী ঘটছে, তা আমাদের চোখের সামনে। সেক্ষেত্রে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের অবস্থাটা কোন বিপজ্জনক জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা সহজেই বোঝা যায়। এই যে মানচিত্র, এই যে জানা-অজানার দোলাচল, এটাও আতঙ্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনুঘটকের কাজ করছে অনেকটাই।

এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া দরকার, করোনা রোগীর মৃতদেহ সৎকারের ক্ষেত্রে  WHO-এর স্পষ্ট নির্দেশিকা রয়েছে। এই 'ইনফেকশন প্রিভেনশন কন্ট্রোল অ্যান্ড সেফ ম্যানেজমেন্ট অফ ডেডবডি'-র পর্যায়গুলি এইরকম। দেহ ওয়ার্ড থেকে বের করে শেষকৃত্যের সময় বিশেষ জীবাণুনিরোধক রাসায়নিক দিয়ে লিক প্রুফ প্যাকেটে (জীবাণুনাশক ব্যাগ) সিল করে নিয়ে যেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, শরীর থেকে যেন কোনও রস গড়িয়ে না পড়ে। সেই জন্যই শয্যা থেকে সরানোর আগে খুব ভালো করে বন্ধ করতে হবে চোখ, মুখ, নাক ও কান। একই সঙ্গে দেহে লাগানো নলগুলি খুলে সেই ছিদ্রগুলিও হাইপোক্লোরাইড দিয়ে বন্ধ করতে হবে।

চিকিৎসকদের মতে, মানুষের দেহ থেকে নির্গত অতি ক্ষুদ্র জলবিন্দু থেকেই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি থাকে। যাঁরা মৃতদেহ বের করবেন, তাঁদেরও পরতে হবে জল নিরোধ এপ্রন, গ্লাভস ও N-95 মাস্ক। দেহ দেখতে পাবেন বাড়ির লোক, কিন্তু ছুঁতে পারবেন না। দেখার পরও স্যানিটাইজেশনের নিয়ম মানতে হবে যথাযথ। এই নির্দেশিকা সঠিক মানলে সৎকার-পরবর্তী রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।

আরও পড়ুন: অসংখ্য গবেষণায় বাড়ছে গোলযোগ

মুশকিল হলো দু'তরফেই। একদিকে নিয়ম মেনে কাজ করাটা আজও আমাদের ঠিক মজ্জাগত হলো না। অন্যদিকে আম জনতা, তারা যথাযথ তথ্য ও জ্ঞান বিষয়ে ততটা আগ্রহী নয়, যতটা হুজুগে। আর তাদের সন্দেহ নিরসনের চেষ্টা করার লোকই বা সমাজে ক'জন? আগুনে ধুনো দিতেই ব্যস্ত সবাই।

অতিরিক্ত তথ্য প্রচার, আলোচনা ও বিশ্লেষণও কখনও কখনও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কের রমরমার যুগে সেটা যে কোন ভয়াবহ স্তরে যেতে পারে, সেটা সহজেই বোধগম্য। সংবাদ মাধ্যমের কথাও যদি বলি, সেখানেও করোনা ছাড়া আজ আর কোনও খবর নেই। বিশেষত টিভির খবরে করোনাভাইরাস তো সুপারস্টারের মর্যাদা পেয়ে গেছে। এর কারণ কি এই যে, করোনা এমন এক ভাইরাস, যা ধনী-দরিদ্রের ভেদাভেদ মানছে না? ইংল্যান্ডের রাজপুত্র, হলিউডের টম হ্যাঙ্কস থেকে গলির রিকশাচালক, যে কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। আর্থ-সামাজিক বেড়া না মানাই কি করোনাকে এত 'স্পেশাল' করে তুলেছে?

আর সোশ্যাল মিডিয়ার কথা তো ছেড়েই দিলাম। এখানে সকলেই বিশেষজ্ঞ। সকলেই নিজের হিসেবে জগৎ জুড়ে বার্তা (লেখা/অডিও/ভিডিও) পাঠাচ্ছেন বা বিনিময় করছেন। প্রচুর ভুল এবং উদ্দেশ্যমূলক প্রচার, রাজনৈতিক অভিসন্ধি ইত্যাদিও কাজ করছে করোনাকে ঘিরে। অর্থাৎ, মানুষের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েই চলেছে। ভাবতে খারাপ লাগে, মানুষই এটা করছে।

সবশেষে খুব জরুরি কিছু তথ্য ও প্রশ্ন। করোনা নিয়ে মাতামাতির পাশাপাশি এই পরিসংখ্যানটাও মাথায় রাখা দরকার। ভারতে প্রতি বছর টিবি অর্থাৎ যক্ষ্মা রোগে গড়ে ৪ লক্ষ মানুষ মারা যান। দৈনিক গড়ের হিসেবে যা ১,২০০। যার ধারেকাছে নেই করোনায় মৃতের সংখ্যা। প্রায় ৪.৪ লক্ষ ভারতীয় যক্ষ্মায় মারা যান ২০১৮ সালে। যেটা সারা বিশ্বের ১৫ লক্ষ রোগীর প্রায় ২৯ শতাংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি টিবি আক্রান্ত দেশগুলির তালিকায় ভারতের নাম রয়েছে প্রথম আটের মধ্যে। এই মুহূর্তে করোনায় (COVID-19) আক্রান্তের মধ্যে মৃতের হার ৩.৩ শতাংশ। যক্ষ্মায় ২০.২৩ শতাংশ। তুলনাটা লক্ষ্যনীয়।

আরও পড়ুন: চিকিৎসক ও সমাজ – মহামারীর দ্বিপ্রহরে 

ঋতুকালীন H1N1 (ইনফ্লুয়েঞ্জা A ভাইরাসের একটি প্রজাতি) আক্রমণে এদেশে মারা যান গড়ে ১,০০০ জন মানুষ। মৃত্যুর হার ৪.২৫ শতাংশ। WHO-এর সমীক্ষা বলে, বিশ্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা জনিত কঠিন রোগের কবলে পড়েন ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষ। তার মধ্যে ২৯০,০০০ থেকে ৬৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায়। ভারতে ইতিমধ্যে মার্চ মাস পর্যন্ত ছোঁয়াচে H1N1 ভাইরাসে আক্রান্ত ১,৪৬৯ জন রোগীর মধ্যে মৃত ২৮ জন। প্রতি বছর হৃদরোগ, শ্বাসকষ্ট, পেটের রোগ, কিডনির অসুখে লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যান। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী করোনায় মৃত ৮৬ শতাংশের কোনও না কোনও কঠিন পার্শ্বরোগ (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, কিডনির অসুখ) ছিল।

এছাড়াও রয়েছে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, অ্যাকিউট এনকেফালাইটিস, জাপানি এনকেফালাইটিস। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুতে ভোগেন। ২০১৫ থেকে ২০১৯, এই দুই রোগে ভারতে যথাক্রমে মৃত্যু ১,০৫৫ ও ১,০৯৪ জন মানুষের। ২০১৭ সালে বিশ্বে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ২১.৯ কোটি, তার মধ্যে মৃত ৪ লক্ষ ৩৫ হাজার। এখানে ভারতের অবদান ৪ শতাংশ।

এরপরও যদি করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, সাধারণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায় এবং সাধারণও সেই আতঙ্কের ফাঁদে পা দিয়ে ভুল পথে চালিত করে নিজেদের, তবে সেটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। সে যে প্রেক্ষিতেই হোক। আতঙ্কে রোগ লুকোনো বা মৃত মানুষের সৎকারে বাধার সৃষ্টি, সুস্থ হয়ে ফিরলেও তাঁকে একঘরে করে রাখা। এর কোনওটাই এই রোগ প্রতিরোধে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারে না।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment