Advertisment

'বিসি' ও 'এসি', করোনার বাজারে অর্থহীন অর্থনীতি

এত অন্ধকারে অবশ্য আশার ছবি দেখা যাচ্ছে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে। তথ্যপ্রযুক্তির ভিত্তিতে 'টেক বাস্কেট' বা 'জোম্যাটো'-র মতো ব্যবসা চলছে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus economy

এই অন্ধকার সময় আশার আলো দেখাচ্ছে কৃষি উৎপাদন। ছবি: জসবীর এস মালহি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

করোনা পরিস্থিতি যে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা এখন আমরা বুঝতেই পারছি না। করোনা আবহের আগে অর্থনীতিবিদরা কিঞ্চিৎ আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ২০২০-২১ আর্থিক বছরে শতকরা দু'ভাগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। তারপর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বিশ্লেষণ বদলে গিয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, করোনা-পরবর্তী কালে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি শতকরা এক ভাগ হওয়া মানেই যথেষ্ট! এক সাংবাদিক বন্ধু বললেন, একে বলা যায় 'বিসি অর্থনীতি' আর 'এসি অর্থনীতি'। 'বিসি' মানে 'বিফোর ক্রাইস্ট' নয়, 'বিফোর করোনা'। আর 'এসি' মানে 'আফটার করোনা'।

Advertisment

ভারতের অর্থনীতিতে শতকরা ৫৫ থেকে ৫৭ ভাগ মধ্যবিত্ত হলেন চাকুরীজীবী। শতকরা ২৯-৩০ ভাগ মানুষ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। আবার, শতকরা ৬৫ ভাগ মানুষ কৃষিক্ষেত্রে যুক্ত। কিন্তু করোনার কারণে লকডাউন তো সর্বব্যাপী! উৎপাদন বন্ধ। শুধু কলকারখানা নয়, বিমান, ট্রেন, ও আন্তঃরাজ্য পরিবহণও বন্ধ। মল, সিনেমা হল বন্ধ। বন্ধ অন্যান্য অনেক পরিষেবাও। এতে আর্থিক ক্ষতি ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অর্থনীতিবিদরা কেউ কেউ বলছেন, আমাদের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রোস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) প্রায় আট থেকে নয় ভাগ লোকসানের সম্ভাবনা, যা ইতিমধ্যেই ১২ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন: ভারতের যে ‘করোনা যোদ্ধাদের’ কথা কেউ বলছেন না

এখন পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রীতিমতো আলোচনা হচ্ছে। যে শ্রমিকরা সব কারখানা বন্ধ বলে দু'বেলা ক্ষুন্নিবৃত্তি না করতে পেরে শহর থেকে যে যাঁর নিজের গ্রামে ফিরে যেতে চাইছেন, এঁদের শতকরা ৯০ ভাগ অসংগঠিত ক্ষেত্রের। ৪০ কোটি মানুষ তাই আরও এক ভয়াবহ দারিদ্রের মুখোমুখি হতে চলেছেন। অর্থাৎ, বলা যায়, ৪০ কোটি মানুষ আরও বেশি গরীব হতে চলেছেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে মানুষ আরও গরীব, কর্মহীন হলে যাঁরা মাসিক বেতন পান, তাঁরাও প্রভাবিত হবেন। বেতনভুক্ত শ্রেণীতেও চাকরি হারানোর সম্ভাবনা বাড়ছে। করোনা-উত্তর ভারতে চাকরি ক্ষেত্রের ছবিটা তাই স্পষ্ট নয়।

coronavirus economy ভয়াবহ দারিদ্রের মুখে পড়তে চলেছেন দেশের ৪০ কোটি মানুষ। ছবি: বিশাল শ্রীবাস্তব, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

ধরুন, ছোট ছোট কারখানা যাঁরা চালান, অর্থাৎ অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, ও মাঝারি উদ্যোগের (মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বা এমএসএমই) ক্ষেত্রে সমস্তটাই বন্ধ। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। দিল্লির উদ্যোগ নগরী। ছোট ছোট জমিতে বেশ কিছু ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে সরকারি উদ্যোগে। করোনার পর এখন সরকার এই উদ্যোগপতিদের বলছে, সম্ভব হলে কারখানা খুলে অসংগঠিত শ্রমিকদের ওই কারখানার জমিতে রাখুন। কারখানার মালিকরা প্রায় কেউই এই প্রস্তাবে রাজি হন নি। তাঁরা বলেছেন, তাঁদের কারখানার জমি খুবই ছোট। এত স্বল্প পরিসরে তাঁরা শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করবেন কী করে? তাছাড়া, শ্রমিকরা তো একটা সুনির্দিষ্ট এলাকা থেকে আসেন না যে বাস পাঠিয়ে সবাইকে আনা যায়। লকডাউন সাময়িকভাবে তুলে এই শ্রমিকদের সামাজিকভাবে আলাদা করে রাখা কী করে সম্ভব?

তবে এসব হতাশার মধ্যে একটা সুখবর হলো, এবার বর্ষা সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ভালো। ইতিমধ্যে রবি শস্যের উৎপাদন হচ্ছে, শস্য যাচ্ছে বাজারে। খারিফ শস্য উৎপাদন সম্পর্কেও আগাম রিপোর্ট ভালোই আসছে। কৃষি উৎপাদনকে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্রে আমরা যদি এখন সুষ্ঠুভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে ভালো খবর পাওয়া যেতে পারে। তবে সেখানেও বেশ কিছু সমস্যা আছে। প্রথমত, এ দেশে চাষিদের নিজস্ব জমির পরিমাণ খুবই কম। শতকরা ৮৬ ভাগ চাষির জমির আয়তন দুই হেক্টর-এরও কম। আবার শতকরা ৭০ ভাগ চাষির জমির আয়তন এক একরের চেয়েও কম। একে পশ্চিমবঙ্গে আমরা 'জমির খণ্ডিকরণ' বা 'ফ্র্যাগমেন্টেশন' বলতাম। এসব খণ্ড চাষিদের চাষের লাভ পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির। এক, কোওপারেটিভ বা সমবায়; দুই, কন্ট্র্যাক্ট; তিন, 'কালেক্টিভ ফারমিং' করে ফসল বিক্রির বাজারের লাভ চাষিদের পাইয়ে দেওয়া। সরকার ও স্থায়ী প্রশাসনের উপরেও অনেকটা নির্ভর করছে এই 'কন্ট্র্যাক্ট ফারমিং'-এর সাফল্য।

আরও পড়ুন: কোভিড-১৯: বিজ্ঞান, তথ্য, এবং কিছু সরকারি বিবৃতি

অনেকে বলছেন, ভালো চাষের উৎপাদন হলে বাইরের দেশে এবার তা রপ্তানি করার সুযোগ আসবে। বাইরের দেশে চাষের ফসল বিক্রি করে অর্থ রোজগার সম্ভব। এখানে একটাই কথা, আগে দেখতে হবে, আমাদের দেশের মানুষের যা চাহিদা, তা পূরণ হচ্ছে কিনা। তা যদি হয়, তবেই আমরা বিদেশে কৃষি পণ্য রপ্তানি করতে পারছি কিনা তা ভাবার অবকাশ আসবে। তাছাড়া, আমাদের কৃষিপণ্যের গুণ অন্য দেশের তুলনায় ঠিক কতটা ভালো, তার বিচারও করতে হবে। বিদেশের বাজারে আমাদের কৃষিপণ্যের দাম কত হবে, কতটা বাজার সত্যি সত্যি আমরা পাব, সেটাও দেখতে হবে।

coronavirus economy অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কাজেও রয়েছে ব্যবসায়িক লাভের আশা। ছবি: পবন খেংরে, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

এই গভীর সঙ্কটে অবশ্য মনরেগা (MGNREGA)-র মতো সরকারি প্রকল্প এক ন্যূনতম আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মনরেগা তো আপনারা জানেন, পুরো নাম মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট। মনমোহন সিং যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখনই এই সামাজিক প্রকল্পটি চালু হয়। বলা হয়েছিল, একজন শ্রমিক দিনে অন্তত ১০০ টাকা আয় করবেন। মোদী সরকার এই প্রকল্পে কিঞ্চিৎ বদল এনেছে। কাজের সম্ভাবনা এই প্রকল্পে বাড়ানো হয়েছে। দেখা যাক, এই করোনা সঙ্কটে মনরেগা-কে ঠিক কীভাবে কাজে লাগানো হয়।

অবশ্য ভারতে লকডাউন কতদিন কার্যকর হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। লকডাউনের ফলে শুধু তো কলকারখানার নয়, বিমান পরিষেবারও প্রভূত লোকসান হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ইন্ডিগো-র কথাই ধরুন। একটি বিমানে ১৮৬ জন যাত্রীর আসন। গড় বিমান ভাড়া যদি তিন থেকে চার হাজার টাকা ধরি, তাহলে একটি বিমান সফরে কত টাকার রাজস্ব সংগ্রহ হয় হিসাব করুন। দিনে ১৬ ঘণ্টায় সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা বিমান চলাচল ন্যূনতম। এসব এখন বন্ধ তো বটেই, উল্টে বিমানবন্দর ব্যবহারের জন্য যে নিয়মিত 'লিজ রেন্টাল' (ভাড়া) দিতে হয়, তাও দিতে হচ্ছে। তাছাড়া ইঞ্জিনগুলি সচল রাখার জন্য মাঝেমাঝে বিমান চালাতে হচ্ছে, যেমনভাবে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনকে সচল রাখতে হয়। তার জন্য খরচ হচ্ছে ভালোই। একে বলা হয় 'পুশব্যাক ইঞ্জিন এক্সপেনডিচার'। যে বিমানে আমরা যাতায়াত করি, সেরকম একেকটি বিমানে ২০ থেকে ২৫ জন কর্মী কাজ করেন। এয়ারহস্টেস থেকে পাইলট, গ্রাউন্ড স্টাফ। লকডাউনে বিমান না চললেও এঁদের বেতন দিতে হচ্ছে।

অনেক কোম্পানি অবশ্য আর্থিক সঙ্কটে বেতন ছাঁটাই শুরু করে দিয়েছে। কর্মীদের লম্বা ছুটিতে যেতে বলা হচ্ছে, বেতন না দিয়ে। যাঁদের কাজ করতে বলা হয়েছে, তাঁদেরও বহু ক্ষেত্রে বেতন কমানো হচ্ছে। তাছাড়া বিমান চলাচল তো শুধু নয়, ভ্রমণের সঙ্গে তো আরও অনেক কিছুই যুক্ত। কত মল, কত দোকান, চারদিকে কত হোটেল, একে বলা হয় 'চেন অফ সার্ভিস', অর্থাৎ পরিষেবা শৃঙ্খল।

এর আরও উদাহরণ দিচ্ছি। ধরুন, হরিয়ানার মানেসরে মারুতি ফ্যাক্টরির দুটি ইউনিট আছে। একটিতে গাড়ি তৈরি হয়, অন্যটিতে ইঞ্জিন। বলা হলো, মারুতি গাড়ি উৎপাদন করতে পারবে, কিন্তু ইঞ্জিন তৈরির কারখানাটি 'রেড জোন' বা 'হটস্পট' এলাকায় - তাই ইঞ্জিন তৈরির কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। তাহলে ইঞ্জিন ছাড়া গাড়ি তৈরি হবে কী করে? তাছাড়া, গাড়ি বিক্রির ডিলার, অটোমোবাইল সংস্থার পরিষেবাও তো খুলতে হবে। শুধু  মারুতি নয়, আইটিসি, ডাবর, নেসলে, হিন্দুস্তান লিভার (বর্তমানে ইউনিলিভার), এসব কোম্পানির অনেকগুলিরই সংশ্লিষ্ট কারখানা 'রেড জোন' বা 'হটস্পট' এলাকায়।

আরও পড়ুন: করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কি দেখবে নতুন চেতনা? নাকি এবারও শিখব না আমরা?

এত অন্ধকারে অবশ্য আশার ছবি দেখা যাচ্ছে ই-কমার্সের ক্ষেত্রে। তথ্যপ্রযুক্তির ভিত্তিতে 'টেক বাস্কেট' বা 'জোম্যাটো'-র মতো ব্যবসা চলছে। শুনলাম বিশিষ্ট শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েঙ্কার পুত্র শাশ্বত এখন তাঁদের স্পেন্সার রিটেল-এর সঙ্গে 'জোম্যাটো', 'ওলা' প্রভৃতি সংস্থার 'টাই আপ' করে শাকসবজি ও নানা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবসা করছেন। দারুণ সাড়া পাওয়া গিয়েছে এই ব্যবসায় এখন। শ্যাম্পু, সাবান, প্রসেসড ফুড, চাল, ডাল, গম, মাছ-মাংস, শাকসবজি সব 'ডোরস্টেপ ই-কমার্স' ব্যবসার মাধ্যমে পৌঁছে যাবে আপনার কাছে।

তাই 'করোনা অর্থনীতি' বলে তো কিছু হয় না। অর্থনীতিবিদ দীপঙ্কর দাশগুপ্ত 'সংবাদ প্রতিদিন' পত্রিকায় ঠিকই লিখেছেন। করোনা একটি স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা। এই সঙ্কট দূর করতে চাই ভ্যাকসিন। এর জন্য আলাদা কোনও অর্থনীতি হয় না। ১৯৩০-এর দশকে আমেরিকার 'গ্রেট ডিপ্রেশন' বা মহামন্দা কোনও ভাইরাস আক্রমণ ছিল না। সে ছিল পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির সঙ্কট। তাই চিকিৎসকদের অন্যতম ছিলেন অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কীনস। কিন্তু করোনা-কালীন লকডাউন দেশের উৎপাদন ও সার্বিক পরিষেবা, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা অচল করে দিয়েছে। এখন তো ডিএ-র বর্ধিত হারও একবছর স্থগিত রাখা হয়েছে। পেনশন কমে যাবে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মীদেরও। ব্যাঙ্কের সুদের হারও আগামী দিনে কমে যাওয়া অসম্ভব নয়।

শেষের সে দিন তবে কি সত্যিই ভয়ঙ্কর?

coronavirus COVID-19
Advertisment