স্তব্ধ স্টুডিও পাড়া, সঙ্কটে ইন্ডাস্ট্রি।
কোনও নায়ক বাসন মাজছেন। ঝাড়ু হাতে নাচছেন বলিউড নায়িকা। এক সুপারস্টার চুলদাড়ি না কেটে, ডাই না করে, হঠাৎ একেবারে প্রবীণ চেহারায়। নায়িকারা বিউটি ট্রিটমেন্টের অভাবে সাদামাটা হয়ে টিভির পর্দায়। আর প্রায় সকলেই হয় টিভিতে নাহয় টুইট করে জনতার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন শুভ বার্তা, 'ঘরে থাকুন। লকডাউন মেনে চলুন। মাস্ক পরুন। সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুতে ভুলবেন না'। ইত্যাদি ইত্যাদি। কিছুটা সামাজিক দায়, কিছুটা সময় ব্যয়। মুম্বই, কলকাতা ও দক্ষিণের বহু তারকাই মোটামুটি শুরুতে এভাবেই জনসংযোগে ছিলেন। টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রগুলিও তাদের পরিবেশনায় সর্বক্ষণ রোগ, মৃত্যু, অর্থনৈতিক জটিলতার খবরের বাইরে গিয়ে তারকাদের ব্যক্তিজীবন নিয়ে তৈরি কিছুটা ভিন্ন স্বাদের ক্লিপিং ও তথ্য দিয়ে দর্শকদের খুশি রাখার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু যাদের উদ্দেশ্য করে মিডিয়ার এই প্রচেষ্টা, সেই দর্শক, থুড়ি আম জনতা, তাঁরা কী করবেন বা করলেন? তাঁরা যে বিষয়টাকে নিজেদের মতো করে মেপে নেবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক! আর এই মেপে নেওয়ার পর যে প্রতিক্রিয়া, তার ঢেউটা সোশ্যাল মিডিয়াতেই যে আছড়ে পড়বে, এও তো জানাই ছিল। যেমন ভাবা, তেমন ভাবেই শুরু হলো পোস্ট, ট্রোল, মিম এবং সেসব ভাইরাল করা। যার মূল বক্তব্য একটাই, ওঁদের আর কী? ওঁদের কি টাকার অভাব? প্রভাব খাটিয়ে হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন, যা কিছু প্রয়োজন। ভালোই আছেন সব। আর সিনেমা-সিরিয়াল বন্ধ থাকলে কার কী অসুবিধা? সমাজের এতে কিছু আসে যায় না। এটা তো আর জরুরি পরিষেবার মধ্যে পড়ে না।
আরও পড়ুন: আমফানে বিপর্যস্ত বাংলা! ভরসা জোগাতে পাশে বলিউড
মুশকিল হলো, কেউই তলিয়ে দেখছেন না, এই 'ওঁরা'টা আসলে কারা? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মানে কি শুধু নায়ক-নায়িকা, প্রযোজক, পরিচালক, স্ক্রিপ্ট রাইটার? এর সঙ্গে জড়িয়ে আরও বিরাট সংখ্যক মানুষ। বন্ধ সিনেমা হল, মাল্টিপ্লেক্স এবং স্টুডিও পাড়া। শুধু পরিচালক-অভিনেতা নন, কর্মহীন টেকনিশিয়ান, এডিটর, মিউজিক ডিরেক্টর ও মিউজিশিয়ান, কোরিওগ্রাফার ও ডান্সার, স্টান্টম্যান ও অ্যাকশন ডিরেক্টর, কস্টিউম ও মেকআপ আর্টিস্ট, হেয়ার স্টাইলিস্ট, সাউন্ড রেকর্ডিস্ট, ইলেকট্রিশিয়ান, জুনিয়র আর্টিস্ট, স্পট বয়, কেটারার থেকে সিনেমাহলের কর্মী এবং আরও নানা পেশার মানুষ। যুক্ত বিভিন্ন স্টুডিও, শুটিংয়ের জন্য ব্যবহৃত ভাড়া বা লিজ নেওয়া বাড়ি থেকে অসংখ্য অনুসারী শিল্প।
এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষরা প্রত্যেকেই সিনেমা বা সিরিয়ালের অনুষঙ্গে জড়িত যাবতীয় প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি নির্মাণ বা সরবরাহ করেন। রয়েছে প্রমোশনের একটা বিরাট অধ্যায়। বহু এজেন্সি শুধু সিনেমার প্রচারের কাজটাই করে। মোদ্দা কথা, এক বিরাট সংখ্যক মানুষের বেঁচে থাকা নির্ভরশীল এই ইন্ডাস্ট্রির ওপর। লকডাউনে তাঁরাও বিপুলভাবে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত। সঙ্কটে তাঁদেরও পরিবার। অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তাঁদের জীবনযাপনও বিঘ্নিত। তাঁরা সকলেই অর্থবান নন। এঁদের মধ্যে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়।
লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে সকলের কাছেই বিষয়টা ছিল একেবারে নতুন এবং অভিনব এক অভিজ্ঞতা। সেসময় দেশের মানুষের প্রতিক্রিয়া মূলত ছিল রক্ষণাত্মক। ভাইরাস আক্রমণের ভয়ে অধিকাংশ মানুষই নিজেদের ঘরবন্দি রেখেছিলেন। মেনে চলছিলেন জরুরি স্বাস্থ্যবিধি। কিছুদিন যেতে না যেতেই চিন্তাধারায় পরিবর্তন শুরু হলো। কাজকর্ম বন্ধ থাকার ফলে রোজগারের চিন্তা, সারাদিন ঘরে থাকার একঘেয়েমি, সামগ্রিকভাবে বিশ্ব জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত অস্থিরতা শুরু হলো। এর সঙ্গে ভাইরাস আক্রমণকে ঘিরে মারাত্মক আতঙ্ক তো আছেই।
আরও পড়ুন: ‘হাওয়ায় কাড়লো ভবিষ্যৎ, হাওয়ায় হাওয়ায় শব’, আমফানের তাণ্ডবে বাংলার পাশে তারকারা
ঠিক এই সময়টাতেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর কোভিড-১৯ সংক্রান্ত বিশেষ ত্রাণ তহবিলের ঘোষণা করলেন। আরও কিছু সংস্থাও এগিয়ে এল এই একই পদক্ষেপ নিয়ে। এসব ক্ষেত্রে সচরাচর যেমন ঘটে, সেলিব্রিটি, মূলত ফিল্মি তারকারাই সবার আগে হাত উপুড় করেন। হ্যাঁ, অন্তত রাজনৈতিক নেতাদের তুলনায় একটু বেশিই করেন। যদিও আর্থিক ক্ষমতায় তাঁদের অনেকেই তারকাদের চেয়ে কিছু কম যান না। যাই হোক, এখানেও বলিউড ও টলিউডের তারকারা নিজেদের ক্ষমতা ও বিচারমতো টাকা দিলেন। আর এটা নিয়েই আবার শুরু হলো একপ্রস্থ বিতর্ক ও সমালোচনা। যাঁদের দানের কথা খবরে জানা গেল, তাঁরা হলেন সব প্রচারলোভী। যাঁদেরটা জানা গেল না, তাঁরা কিপ্টে আখ্যা পেলেন।
অর্থাৎ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখানোর পরও তাঁরা সমালোচনার উর্দ্ধে যেতে পারলেন না। ধরে নিচ্ছি, এসব বাহুল্য। দান-অবদান তো ওঁদের রুটিন দায়িত্ব। কিন্তু যেটা ওঁদের রুটিন জীবন? ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মানুষের ওঠাপড়ার ইতিহাস প্রসিদ্ধ। উন্নতির শিখরে উঠে হারিয়ে যাওয়া প্রায়ই ঘটে। পেশা হিসেবে খুবই নিরাপত্তাহীন। প্রবল প্রতিযোগিতা। প্রতিনিয়ত অভিনেতাদের টিকে থাকার কঠিন লড়াই চালিয়ে যেতে হয়। আর সবাই তো তারকা হতে পারেন না। অনেক মাঝারি মাপের শিল্পীও কাজ করছেন এখানে। আর যাঁরা তারকা, তাঁদেরও সেই স্টেটাস কতদিনের? দু-চারজন বাদ দিলে, বেশিরভাগই স্বল্প আয়ুর তারকা। যে কারণে অনেকেই অভিনয় চলাকালীন সিনেমা প্রযোজনা বা অন্য ব্যবসায় টাকা লগ্নি করেন। যেটাই হোক, প্রবল খেটেই তাঁদেরও উপার্জন করতে হয়। প্রতিভা, মেধা, চর্চার কথা তো ছেড়েই দিলাম। একটা কথা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একশো ভাগ প্রমাণিত সত্য, যোগ্যরাই এখানে টিকে থাকেন।
আরও পড়ুন: "দয়া করে আমাদের কথাও একটু ভাবুন", সরকারের কাছে আবেদন বিনোদন জগতের
এখানে কারও পেনশন বা প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই। যা আয় করছেন, তারই কিছুটা জমিয়ে রাখতে হয় অবসরের জন্য। সেদিক থেকে এই পেশার অনিশ্চয়তা যে কোনও অসংগঠিত ক্ষেত্রের মতোই। আজ এই লকডাউনকে কেন্দ্র করে ইন্ডাস্ট্রি যে ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তা বহু মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে জড়িয়ে। তারকারাও তার বাইরে নন। তাঁরাও জমা পুঁজি ভেঙেই খাচ্ছেন। পেশার কারণেই একটা ন্যূনতম 'স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং' তাঁদের রক্ষা করতেই হয়। তাঁরা যদি আমার-আপনার মতো পায়ে হেঁটে বা ট্রামে-বাসে যাতায়াত করেন, তবে পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে আর পর্দায় তাঁদের কেউ দেখতে যাবে না।
একইভাবে পোশাকআশাক থেকে ত্বক ও চুলের পরিচর্যা গ্ল্যামার দুনিয়ায় টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য। আজকাল সবাই ফিটনেস সচেতন। তার মধ্যেও তারকাদের আলাদা করে এই বাবদ অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। শুটিং একটি অত্যন্ত পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজ। কিন্তু তাই বলে পর্দায় ক্লান্ত দেখালে চলে না। সব মিলিয়ে ওঁদের বেঁচে থাকার ব্যয় অন্য যে কোনও ক্ষেত্রের ধনী মানুষের তুলনায় বেশি।
এই মুহূর্তে পুরো ইন্ডাস্ট্রি ঘরে বসে। সেখানকার সব স্তরের মানুষই দুশ্চিন্তায় কাটাচ্ছেন। অভিনেতারাও তার বাইরে নন। কর্মহীন মুহূর্তে ওঁদেরও হতাশ লাগে। ছবির শুটিং, ছবি নিয়ে আলোচনা, ছবি মুক্তি, এসবই ওঁদের জগৎ। শুধু রোজগার নয়, আশ্রয়ও। এর বাইরে অন্য কিছু করেন নি বেশিরভাগই। দুশ্চিন্তা আজ তাঁদেরও রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। ভালো নেই ওঁরাও। অপেক্ষা করছেন, কবে শুনবেন, লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশন!
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন