/indian-express-bangla/media/post_attachments/wp-content/uploads/2020/04/PP-22-COVID-04.jpg)
এমআর বাঙ্গুল হাসপাতালের বাইরে মৃতদেহের অপেক্ষায় সৎকার কর্মীরা। আজ করোনা, কাল অন্য কিছু? ছবি: পার্থ পাল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
ঘরটা আমার, রাস্তাটা নয়।
হ্যাঁ। ঠিক এমনটাই ভাবি আমরা বেশিরভাগ পথচলতি মানুষ। ভাবি বলেই যেখানে সেখানে কফ-থুথু-পানের পিক ফেলি। খালি প্লাস্টিকের বোতল, সিগারেটের প্যাকেট, কাগজের ঠোঙা, চিপসের প্যাকেট ফেলে রাস্তা নোংরা করি। প্রতি মুহূর্তে দূষিত করি পরিবেশ। আমাদের কারণেই রাস্তা, মাঠ, রেললাইন, স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম, সর্বত্র রোগের জীবাণু কিলবিল করে। আমরা রোগ ছড়াই। যে হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসা হয়, সেই হাসপাতালকেও ছাড়ি না আমরা। এক রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে আর এক রোগ শরীরে বহন করে ফেরে মানুষ। সবই আমরা জ্ঞানত করি। সমাজের চরম ক্ষতিও কিছুই শেখাতে পারে না আমাদের।
আমার প্রথমবার প্রতিবেশী রাজ্য সিকিমে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ছিল চমকপ্রদ। রাস্তার কোথাও প্লাস্টিক, আবর্জনা পড়ে নেই। দেওয়ালের গায়ে চিত্রবিচিত্র লাল ছোপ নেই। ব্যাপারটা কী? আরও একপ্রস্থ অবাক হই, যখন সিকিম ট্যুরিজমের বাসের চালক স্টপেজ ছাড়াই হঠাৎই বাস দাঁড় করিয়ে দেন। কারণ কী? না, ওই বাসেরই যাত্রী, কতিপয় বঙ্গতনয়, চিপসের খালি প্যাকেট, কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল ফেলেছে বাসের জানালা দিয়ে। সিকিমে এটা কেউ ভাবতেই পারে না। সেখানকার মানুষ পরিবেশ রক্ষার নিয়ম মেনে চলেন। উল্টোদিকে আমরা এ বিষয়ে ঠিক কেমন আচরণে অভ্যস্ত, পাঠককে বলার দরকার পড়ে না। শুধু একটি তথ্য, সেদিন ওই ছেলের দলটিকে বাস থেকে নেমে যাবতীয় আবর্জনা তুলে আনতে হয়েছিল। তারা যথেষ্ট কুপিত হলেও নির্দেশ মানতে বাধ্য হয়। কারণ, বাসের বাকি যাত্রীরা সকলেই ছিলেন চালকের পক্ষে।
আরও পড়ুন: করোনা-পরবর্তী বিশ্ব কি দেখবে নতুন চেতনা? নাকি এবারও শিখব না আমরা?
আর একটি ঘটনা। আমার সহকর্মী এক চিত্রসাংবাদিক একবার কর্মসূত্রে গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের এক শহরে। ফিরে এসে সেখানকার ছবি দেখানোর সময় একটি দুধ-সাদা প্রাসাদের ছবির প্রতি অঙ্গুলিনির্দেশ করেন তিনি। আন্দাজ করতে বলেন, সেটা কিসের ছবি। দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে মন্দির সংস্কৃতির একটি যোগসূত্র আছে। আমরা সেই সূত্রই হাতড়ে বেড়াই। জবাবে তিনি যা জানান, তা হলো, "আমিও এটাকে মন্দিরই ভেবেছিলাম। এটা হলো চেন্নাইয়ের করপোরেশন অফিস।" বলা বাহুল্য, উপস্থিত জনতার চোখ কপালে। করপোরেশন অফিস মানেই তো চতুর্দিকের দেওয়াল ও মেঝেতে ছোপ ছোপ, নানা বর্ণ ও আকৃতির অঙ্কন, যেখানে আবার লালের আধিক্য বেশি। এটা বহুকাল আগের কথা। এখন সম্ভবত কলকাতা করপোরেশনের বহিরঙ্গে কিছুটা পরিচ্ছন্নতার প্রলেপ পড়েছে। দেখিনি অনেকদিন, তবে শুনেছি।
সেই সময় শুধু করপোরেশন কেন, রাইটার্স বিল্ডিং-এর অবস্থাও ছিল তথৈবচ। তেমনই নরক হয়ে থাকত হাসপাতালগুলি, যা আজও খুব বেশি বদলায়নি। কিছু অঞ্চল বাদ দিলে শহর কলকাতার বেশিরভাগ রাস্তার ছবি খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বলা ভালো, পুরো রাজ্য বা হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্য বাদ দিলে, পুরো দেশ এ ব্যাপারে ইদানীং তাদেরই দখলে, যারা পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যবিধির ঠিক বিপরীতে মুখে হাঁটে। আবর্জনা যত্রতত্র ফেলার ক্ষেত্রে দ্বিধাহীন এরা। পরিবেশ দূষিত করতে জুড়ি নেই এদের।
এখন এই করোনা-কালে হঠাৎ করে এইসব দ্বিধাহীন জনতাকে রোগ সংক্রমণের ভয় দেখিয়ে অভ্যাস বদলাতে বললে শুনবে তারা? যতদূর জানি, রাস্তায় প্রস্রাব করাটাও আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু শাস্তির ভয়ে কেউ কি এ কান্ড ঘটানো ছেড়েছে? রাস্তায় প্রচুর 'পে অ্যান্ড ইউজ' টয়লেট তৈরি হওয়ার পরও ছাড়েনি। এ ব্যাপারে প্রশাসনও খুব সক্রিয়তা দেখায় বলে আমার অন্তত জানা নেই। পাশাপাশি এটাও বলা জরুরি, আইনের রক্তচক্ষু আর যাই হোক, মানুষের নিত্য যাপন-অভ্যাস বদলাতে পারে না। মাফ করবেন পাঠক, এ ব্যাপারে মনুষ্যেতররা বরং ট্রেনিং দিলে শেখে। কিন্তু মানুষ? তারা হলো কিনা জীবজগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী। তাদের আর কে কী শেখাবে?
আরও পড়ুন: লকডাউনে কেন বাড়িই অনেক মহিলার পক্ষে হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বিপজ্জনক
রাস্তায় ফেলা ময়লা-আবর্জনা থেকে কফ-থুথু-পানের পিক, এই সবই যে আজই হঠাৎ করোনাভাইরাসের আক্রমণ কালে বাহকের ভূমিকা নিল, তা তো নয়। এ তো চিরকালের বোধ ও চেতনার বিষয়। পরিবেশ দূষিত করা যাবে না, আমরা শৈশবেই এই শিক্ষাটা পেয়েছি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সঙ্গে পরিচ্ছন্নতার কী সম্পর্ক, সেই পাঠ প্রাথমিক শিক্ষার স্তরেই তো পাওয়ার কথা। সেই পর্বটা কি উঠে গেছে? নাকি এগুলি কেরিয়ার নির্মাণের ক্ষেত্রে তত জরুরি নয় ভেবে আজকাল শিক্ষক-অভিভাবকগণ এসব বিষয়ে আর গুরুত্ব দেন না? পথচলতি অধিকাংশ মানুষের আচরণ তো সেটাই বলে।
বিশেষত 'পান-মশলা' সংস্কৃতি খুব বেশি মাত্রায় আমাদের অভ্যাসে ঢুকে যাওয়ার পর পথেঘাটে থুথু ও পানের পিক ফেলার মাত্রা প্রবলভাবে বেড়েছে, এ কথা অনস্বীকার্য। একদা বাঙালির পান সেবনের সঙ্গে এর পার্থক্য অতি স্পষ্ট। সেকালে একান্ত ঘরোয়া পরিবেশ, আড্ডা-মজলিশের বাইরে পান-বিলাস ছিল না বললেই চলে। অন্তত, আমাদের যৌবনকাল (নয়ের দশক) পর্যন্ত রাস্তাঘাটে চলতে ফিরতে মানুষকে এমন বিপুলহারে থুথু ফেলতে দেখিনি। বিষয়টা পান বা পানমশলা খাওয়া নিয়ে নয়। কে কী খাবেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিগত রুচি এবং অধিকার। তা নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। তবে, রাস্তা নোংরা করা, রোগ জীবাণু ছড়ানো, অবশ্যই আপত্তিকর। আসলে অধিকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায়িত্বটাও সমান গুরুত্বে মনে রাখা জরুরি।
সমান আপত্তিকর আবর্জনা ফেলার বিষয়টিও। আজকের সময়ে করপোরেশন, মিউনিসিপালিটি, পঞ্চায়েত ইত্যাদি সরকারি দফতরের কর্মকাণ্ড অনেক বেশি সক্রিয় ও প্রসারিত। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যও পাচ্ছে একাল। সেই তুলনায় মানুষের সচেতনতা কই? রিসাইক্লিং-এর মতো একটি সুবিধাজনক প্রক্রিয়া আবর্জনা দূরীকরণের হাতিয়ার আজ। কিন্তু তার আগে ব্যক্তিগত স্তরে তো প্রত্যেককে সচেতন হতে হবে। বাড়ির বাইরে যে পথ, সেই পথে আমিও তো চলি। পাড়ার ময়লা জল নিষ্কাসনের যে নর্দমা, সে তো আমার বাড়ির ময়লা জলও বহন করে। সেই সব যদি সঠিক মাত্রায় পরিচ্ছন্ন ও কার্যকর না থাকে তাহলে অপরিচ্ছন্নতাজনিত রোগগুলি তো আমার ঘরেও হানা দেবে। এই সরল সত্যগুলি কিছুতেই মনে রাখি না আমরা। রাখি না বলেই জীবাণুধর্মী রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আজ করোনা। কাল অন্য কিছু।
আরও পড়ুন: পুঁজিবাদের কবর খুঁড়তেই যেন করোনাভাইরাসের আবির্ভাব
রাস্তা ও এলাকার ময়লা সাফাইয়ের ক্ষেত্রে কলকাতা করপোরেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিউনিসিপালিটি যথাযথ কাজ করে না, এমন একটা অভিযোগ ওঠে প্রায়ই। অব্যবস্থা যে আছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই অজুহাতেও নিজেদের কুঅভ্যাসগুলির কথা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি? পাড়া বা হাউসিং, যে যেখানেই থাকুন, একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে বাড়ির আবর্জনা ফেলার রুটিন অনুসরণ করা খুবই কি কঠিন? এটা তো সকলেরই জানা যে সাফাই কর্মী আসার আগেই কাজটা করতে হবে। এই নিয়মটা মানলে সারাদিন ধরে রাস্তায় জঞ্জাল পড়ে থাকতে পারে না। পরিবেশ দূষিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আর চলাফেরার পথে কফ-থুথু-পানের পিক ফেলাটা তো একান্ত ব্যক্তিগত অভ্যাস। ন্যূনতম সচেতনতা থাকলে এহেন কাজ এককথায় অসম্ভব। দেশের যে অঞ্চলের মানুষ নিজেদের পাড়া ও রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁরা তো আর ভিন গ্রহের অধিবাসী নন! তাঁরা পারলে আমরা কেন পারব না?
আজ কোভিড ১৯। কাল অন্য কিছু। সার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, টাইফয়েড, ম্যালেরিয়া, ইবোলা, পক্স ইত্যাদি সব জীবনুবাহিত রোগ সংক্রমণের পিছনেই রয়েছে পরিবেশ দূষণ। মন্দির-মসজিদ-গির্জার অন্দরেই শুধু ঈশ্বর বাস করেন না। তাঁর বাস সর্বত্র। ঈশ্বর, যিনি পরিত্রানের প্রতীক। এই থিওরি আসলে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান, দর্শনও বটে। তাই তো বলা হয়, পরিচ্ছন্নতাই পবিত্রতা। করোনা-কাল সব ছেড়ে এই শিক্ষাটাও যদি আমাদের মগজে প্রবেশ করাতে পারে, তাতে সমাজের মঙ্গল। সমাজ ও প্রকৃতি মানুষকে ধারণ করে। পরিবেশ দূষণ বন্ধ না হলে কোনও জীবাণুর আগমন ও সংক্রমণই ঠেকানো যাবে না। হাজার প্রতিষেধক আবিষ্কার হলেও নয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন