Advertisment

পুরভোটেই মিলবে বিধানসভার আভাস

এখন চলছে ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই নিজের নামে করা এই ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন। আত্মপ্রচারে এ-ও এক নজির বিহীন কাজ।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Corporation Election

ভাষা সম্পর্কে অবশ্য সতর্ক হওয়া উচিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও

রাজ্যের তত্ত্বাবধানে ফের একটা বড়ো ভোট এসে গেল। রাজ্যের তত্ত্বাবধানে শেষ গুরুত্বপূর্ণ ভোট হয়েছিল ২০১৮ সালে। পঞ্চায়েত ভোট। তার স্মৃতি খুবই ভয়ের। সরকারি এবং পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা, সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বিস্ময়কর ভূমিকা এবং রাজ্য জুড়ে লাগাম ছাড়া হিংসায় বহু প্রার্থী মনোনয়নই জমা দিতে পারেননি সেই পঞ্চায়েত ভোটে। ২০০৮ সালে বামফ্রন্টের শেষ পঞ্চায়েত ভোটে, বিরোধীরা মনোনয়ন না দিতে পারায় যেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছিলেন ২,৮৪৫ জন। ২০১৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের তত্ত্বাবধানে হওয়া দ্বিতীয় পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন ২০, ১৫৯ জন তৃণমূল প্রার্থী।  ভোট দিতে পারেননি এক কোটির বেশি ভোটার। ভোটারদের যে ক্ষোভের প্রভাব পড়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে। বিরোধী-শূন্য কৌশলটা বামপন্থীদের থেকে ধার করা হলেও প্রমাণ হয়ে গিয়েছে প্রয়োগে অনেক এগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস।

Advertisment

কানার মধ্যে ঝাপসা ভালো। কোনও সন্দেহ নেই হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিপরীতে মমতা বন্দ্যপাধ্যায়ের টিএমসি-ই এখন সেকুলার এবং লিবারাল শক্তি। আদর্শগত ভাবে বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস তুলনায় অনেক বিশ্বস্ত সেকুলার রাজনৈতিক শক্তি হলেও ক্ষমতায় তারা এখন বড়ো বড়ো নিধিরাম। তার উপরে আবার বামপন্থীদের একজন প্রকাশ কারাট আছেন। এই চার আনার নেতা জীবনে কখনও বামপন্থীদের ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি, জীবনে কখনও ভোটে দাঁড়াননি, কিন্তু দলের ভিতর দলে ভারী হওয়ায় তিনিই ঠিক করে দেন জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না, সোমনাথ চ্যাটার্জিকে দল থেকে তাড়ানো হবে কি না, সীতারাম পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রার্থী হবেন কি না। এই মহাপ্রকাশের থাবার নীচে দল এখন অক্সিজেন মাস্ক পরে, ক্যাথিটার লাগিয়ে ভেন্টিলেশনে। ফলে কানার মধ্যে ঝাপসা, তৃণমূলই এখন প্রগতিশীল শক্তি এই রাজ্যে।

প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন, ইতিহাস বিস্মৃত এই নারী দিবসের উদযাপনই কি আমরা চেয়েছিলাম?

কলকাতা, হাওড়া, বিধানগর, শিলিগুড়ি ইত্যাদি কর্পোরেশন সহ ১২৫টি পুরসভা এবং নোটিফায়েড অথরিটিতে ভোট হবে আগামী এপ্রিল থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে। শিলিগুড়ি বাদে এই মুহূর্তে রাজ্যের সব কর্পোরেশন, পুরসভা এবং নোটিফায়েড অথারিটি তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে। এর মধ্যে অনেকগুলি পুরসভায় অনেক আগেই ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিজেপি ভালো ফল করতে পারে এই আশংকায় সে সব পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। সিপিএম ভেবেছিল তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকবে। তাই তারা এই রাজ্য ভোটের আইনটা এমন ভাবে তৈরি করেছিল যাতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের থেকেও রাজ্যের হাতে বেশি ক্ষমতা থাকে। এই আইনে শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকারই ঠিক করে দেয় কবে কোথায় ভোট হবে। সিপিএম বিদায় নেওয়ার পর ওই আইনের যাবতীয় সুবিধা বর্তমান সরকার পাচ্ছে। এবারেও ভোট এক দিনে হবে না। সম্ভবত কলকাতা হাওড়া এক দিনে হবে। বাকি ভোট এক বা দু’দফায় হবে।

গত লোকসভায় বিজেপি খুব ভালো ফল করলেও পরে রাজ্যের বিধানসভা উপনির্বাচনের ফল দেখে এটা স্পষ্ট, পুরোনো সেই শক্তি মোটেই ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি। অনেকটাই কমেছে। এই কমার পিছনে কিছুটা কাজ করেছে তৃণমূলের ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের দাওয়াই। যার অন্যতম ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি। এখন চলছে ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই নিজের নামে করা এই ‘বাংলার গর্ব মমতা’ কর্মসূচি উদ্বোধন করেছেন। আত্মপ্রচারে এ-ও এক নজির বিহীন কাজ।

বাংলায় উপাধি দেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ভারতপথিক বিবেকানন্দ, বাংলার বাঘ আশুতোষ,  বাংলার রূপকার বিধান রায় এমন আরও অনেক আছে। গান্ধীকে জাতির পিতা বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কিন্তু গান্ধী যদি ডান্ডি আভিযানে বেরিয়ে নিজেকেই জাতির পিতা ঘোষণা করতেন?

কল্পনাও করা যায় না এমন একটা ঘটনা। এসবের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হয়। কয়েক বছর আগে নেত্রীকে সততার প্রতীক বলে বড়ো বড়ো কাটআউটে শহর ভরিয়ে দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। নেত্রীর আপত্তি থাকলে তো এমনটা হতে পারে না। এই রাজ্যের মানুষ তাঁকে ভোট দিলেও ওই তকমাটা নেয়নি। এবার এল বাংলার গর্ব। ভবিষ্যৎই বলবে মানুষ এই বিশেষণ গ্রহণ করে কি না!

অশ্লীলতার দায় বড় দায়, বিশেষত এ রাজ্যে

একটা নির্দিষ্ট সময় না গেলে বোঝা যায় না ইতিহাসে কোন তথ্যের কী গুরুত্ব? কোন তথ্যের কী মানে! এই যে তাড়াহুড়ো করে সিঙ্গুর আন্দোলন এবং সে আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা বাংলার শিশুপাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হল, তার ফল কী হল? গত লোকসভা ভোটে সিঙ্গুর বিধানসভা ক্ষেত্রে বিজেপির কাছে পরাজিত হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তা হলে কি বলতে হবে সিঙ্গুর বার্তা দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভুল করেছিলেন? আসলে সে ভাবে ভাবাটাও ভুল হবে। ইতিহাসকে যে ভাবে দেখার চেষ্টা হচ্ছে সেই ভাবনাটাই ভুল।

সাধারণত পুরভোট, পঞ্চায়েত ভোট হয় স্থানীয় সমস্যার উপর দাঁড়িয়ে। এবারে তার কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে। নরেন্দ্র মোদীর নাগরিকত্ব আইন এই ভোটে অবশ্যই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। এটা অবশ্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়তি সুবিধা। কাগজ নিয়ে সমস্যা ঘরে ঘরে। বিজেপির পক্ষে এটা একটা অসুবিধার দিক। নথি নিয়ে ভয় ঘরে ঘরে। তবু বিজেপি দিল্লি ভোটের ‘গোলি মারো’ মেজাজেই এখানেও ভোট করার চেষ্টা করবে। তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে।

এমনিতেই এই রাজ্যের বিজেপি নেতারা অনুব্রতকে ম্লান করে দিয়ে নিয়মিত যে ভাষায় কথা বলছেন তাতে বিজেপি সমর্থকদের একটা শিক্ষিত অংশ অত্যন্ত বিরক্ত। কথা বলতে গেলে সেই বিরক্তি তাঁরা গোপনও রাখেন না। ভাষা সম্পর্কে অবশ্য সতর্ক হওয়া উচিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও। মালদহে গিয়ে তিনি বলেছেন মালদহ সংখ্যালঘুদের জেলা, মৌসম নুর নিজে সংখ্যালঘু, তাহলে কেন তিনি হেরে গেলেন! দুধ দেওয়া গোরুর লাথি খাওয়ার কথার পর ফের তাঁর মুখে এই ধরনের মন্তব্য। এ তো হিন্দুত্ববাদীদেরই সমান্তরাল ভাষা!

লোকসভা ভোটের বিচারে দেখা যাচ্ছে তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বিজেপি ভালো ফল করেছিল। রাজ্যের ২৭টি গ্রামীণ লোকসভা আসনের মধ্যে ১৩টিতে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। এবারের ভোটে প্রমাণ হবে শহরে বিজেপির প্রভাব বাড়ল না কমল। ২০২১-এ বিধানসভা ভোট। সন্দেহ নেই দিল্লি হারের জ্বালা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা ঝাঁপাবেন প্রথমে বিহারে এবং তার পর এই বাংলায় নিজেদের ক্ষমতার প্রমাণ দিতে।

লোকসভা ভোটে প্রমাণিত  কংগ্রস-বামেদের ভোট প্রায় সবটাই বিজেপির বাক্সে চলে গিয়েছে। ফলে পুর ভোট এবং তার পরের বিধানসভা ভোট, দুটো যুদ্ধই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে লড়তে হবে একাই। দুই লড়াইয়েই তাঁর প্রধান অস্ত্র সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সিএএ বিরোধিতা। তবে বিধানসভায় কী হতে পারে তার একটা আভাস পাওয়া যাবে এই ১২৫টি কর্পোরেশন, পুরসভা এবং নোটিফায়েড অথরিটির ভোটে। সেদিক থেকে এই নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

(শুভাশিস মৈত্র বরিষ্ঠ সাংবাদিক, মতামত ব্যক্তিগত)

এই কলামের সব লেখা, এইখানে

tmc Bengal Line
Advertisment