Advertisment

হিপোক্রেটিক শপথ বনাম হিপোক্রিসি

গোদা বাংলায় আজকের দিনে সচ্ছলেরা অসচ্ছলের সাহায্য নিতে ভীত। এর অর্থনৈতিক প্রভাব অবশ্যই নিম্নবিত্তের পক্ষে ভয়ানক।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
Corona Rich poor

রাস্তায় জিরিয়ে নিচ্ছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা

এখানে যে হিপো নিয়ে কথা হচ্ছে সেখানে ছোট্ট ল্যাজে অক্ষর যোগ করে জলহস্তীর চিহ্নমাত্র নেই। তবে আজকের দিনে আমাদের সকলকে যে চিকিৎসকেরা নিজেদের জীবন দিয়ে আগলে রেখেছেন তাঁদের শপথের কথা আছে, আর আছে বকধার্মিকতার গল্প। ২০১৮ তে চিকিৎসক অনিতা সিকান্দ বকশি একটি বই লিখেছিলেন যার নাম “হিপোক্রেটিক ওথ অর হিপোক্রিসি”। সেখানে লেখিকা আলোচনা করেছেন চিকিৎসকেরা কিভাবে সমাজের সবথেকে সম্মানীয় স্থান থেকে খাদের নিচে নেমেছেন, এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে। বেসরকারি ক্ষেত্রের চিকিৎসা যে মূলত ব্যবসার অংশ, সে নিয়ে কোন সন্দেহ আজকের দিনে নেই। তবু সব সমস্যা সত্ত্বেও কোভিড পরিস্থিতিতে ডাক্তারবাবুরা স্বমহিমায়। সঙ্গে আছেন নার্স এবং অন্যান্য চিকিৎসাকর্মীরা। দেশ বিদেশে তাঁরা বুক চিতিয়ে লড়াই করছেন কোভিডের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়েও নিজেদের জীবন দিয়ে আমাদের বাঁচাচ্ছেন। এই রোগের হাত থেকে নিস্তার পেলে তাঁদের সকলকে নিয়ে নিশ্চয় কোন কালজয়ী উপন্যাস লেখা হবে। তবে সবাই মানুষ তো, তাই ভালো কাজের শপথের সঙ্গে সঙ্গে কিছু ক্ষেত্রে শাসকের ধমকে সংখ্যা গোনায় এদিক ওদিক তো হবেই। আর মৃত্যুর কারণ তো কোভিড আর না-কোভিডের বাইনারিতে সীমাবদ্ধ নয়। তাই মাতাল হয়ে রাস্তায় গাড়ি চাপা পড়লে যকৃৎ অকৃতকার্য। খুব দরাদরি করলে ব্র্যান্ড দেখে ঈস্টের কিংবা ইষ্টের দোষ দেওয়া যেতে পারে। বক বলে কি ধার্মিক হওয়ায় বারণ আছে?

Advertisment

দুই পক্ষকাল পরে

যে কোন রোগের শুরুর দিকেই চিকিৎসকদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র কম থাকে। তারপর বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সহায়তায় তাঁরা দিনে দিনে অনেক উন্নত মানের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। এ নিয়ে কোন সন্দেহই নেই যে ধনী কিংবা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি চিকিৎসার উন্নততম সুবিধা ভোগ করেন। তবে মোটের ওপর গরীব দেশেও চিকিৎসার সুযোগ গত পঞ্চাশ বছরে অনেকটা বেড়েছে। নতুন নতুন ওষুধ এবং শল্যচিকিৎসার সাফল্য এমন জায়গায় পৌঁছে গেছে যে তার কিছু অংশ নিম্নবিত্তদের কাছে পৌঁছবেই। অর্থাৎ হিসেব এখানেও পুঁজিবাদী। বড়লোকদের নাগালে ভালো চিকিৎসা, আর গরিবের কাছে চুঁইয়ে পড়া সরকারি হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক অবশ্যই অসাধারণ, তাঁদের দক্ষতা বেসরকারির সমমানের বা উন্নত, কিন্তু ভিড়ের কারণে পরিষেবা ততটা ভালো নয়। আমাদের মত দেশে উচ্চবিত্ত মানুষ তাই সাধারণত সরকারি হাসপাতালে যান না। এদিকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি ক্ষেত্রে এখন বিপদ বেশি, এসি-তে কোভিড চনমনে হয়ে উঠছে। এর সঙ্গে যোগ করুন কোভিডের এখনও কোন ওষুধ বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ার বিষয়টি।

বিশ্ব-স্বাস্থ্য, সুস্থ বিশ্ব

এই রোগে তাই পয়সা দিলে নামী হাসপাতালে তুলনায় পরিষ্কার বিছানা মিলতে পারে, কিন্তু অসুখ যে বেশি টাকায় তাড়াতাড়ি সারবে তা নয়। আগেও এমনটাই ছিল, কারণ ধনী হলেই যে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যাবে এমন অনুসিদ্ধান্ত জীবনবিজ্ঞানে লেখা থাকে না। ফলে ধনী এবং বিখ্যাত মানুষরা খুব ভুগছেন বা তুলনায় কম বয়সে চলে গেছেন, এমন উদাহরণ প্রচুর। কোভিডের অতিমারীর ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত প্রকট। বাঁচালে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাই বাঁচাবে। অর্থ বা সম্পদ নয়। অর্থাৎ এই জায়গাটায় ভালো-মন্দ, গরিব-বড়লোক, সৎ-ভণ্ড, শপথ বনাম শপথ-ভঙ্গ, বিজেপি-তৃণমূল, এ সব কাজে দেবে না কিছুই। পুরোটাই ভাইরাসের কার্যকলাপ আর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার এতো জটিল লড়াই যে আপাতত বিজ্ঞান পর্যন্ত তার পুরো নাগাল পাচ্ছে না। ট্রাম্প কি আর শুধু শুধু ডেটল ইনজেকশন দেওয়ার কথা বলেছেন? তাঁর ব্যবসাও তো পুরো গুলিয়ে গেছে।

কোভিড এই জায়গাটায় কিছুটা সাম্যবাদ এনে দিয়েছে। উচ্চবিত্ত তাঁর যে সমস্ত কাজ তাঁর তুলনায় নিম্নবিত্তকে দিয়ে সস্তায় করিয়ে নেন, সেগুলোর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে কাছাকাছি আসা বাধ্যতামূলক। সেই জায়গায় সুবিধে নিতে গেলে বিপদের সম্ভাবনা, আর সুবিধে না নিলে ব্যক্তিগত খুঁটিনাটি শ্রম নিজেকেই দান করতে হবে। আর সাধারণভাবে পুঁজিবাদী সমাজে সুখের যে সংজ্ঞা, তাতে অন্যকে খাটিয়ে না নিলে নিজের সম্পদ যে অন্যের থেকে বেশি সেটা প্রমাণ করার কোন জায়গাই নেই। কাজের মাসি ভীষণ নোংরা বস্তি থেকে এসে হাজা হাতে খাবারের বাসন মাজতেন। সেটা দেখেও দেখতেন না সচ্ছল পরিবারের গৃহকর্ত্রী। তার কারণ সেই নোংরা থেকে খুব বিপজ্জনক কোন সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ কম ছিল। রান্নার দিদি তাড়াহুড়ো করে রাঁধার সময় তরকারি খুব ভালো করে ধুতেন এমন নয়। দু একবার ফোড়নের গন্ধে হেঁচেও ফেলতেন মুখে হাত না দিয়ে। সর্দি নিয়ে এলে আঁচলে কয়েকবার নাকও মুছতেন। সবটাই মালিকের চোখ এড়িয়ে যেত। সবটাই যে অতিসচ্ছলতা এমনটাও নয়, বরং বাইরের কাজে যাওয়ার আগে ঘরের কাজে সময় বাঁচানোর বাস্তব প্রয়োজনীয়তাও ছিল।

পুঁজির বিশ্বাসঘাতকতা এবং ভারতীয় শ্রমিক

তবে মোটের ওপর ভাবলে এখানেও হিপোক্রিসি খুঁজে পাবেন, যেখানে যুক্তিকে হারায় সুবিধাভোগের হাতছানি। গোদা বাংলায় আজকের দিনে সচ্ছলেরা অসচ্ছলের সাহায্য নিতে ভীত। এর অর্থনৈতিক প্রভাব অবশ্যই নিম্নবিত্তের পক্ষে ভয়ানক। তবে সরকারি সাহায্য যদি সকলের কাছে খাবার এবং অন্যান্য ন্যুনতম পরিষেবা পৌঁছে দিতে পারে, সেক্ষেত্রে আপাতত পিছিয়ে থাকা মানুষগুলো বাঁচবেন। আর সেই ব্যবস্থা যদি একবার চালু হয়ে যায়, তখন সামনের দিনগুলোয় সস্তায় কাজ করিয়ে নেওয়ার বিষয়টা আমাদের দেশে অনেক শক্ত হবে। সেই জায়গাটাতেই নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধি কিংবা মন্ত্রীদের শপথের কথা উঠে আসবে বারবার। সেটা চিকিৎসকদের মানুষকে বাঁচানোর বা মানুষের সেবা করার হিপোক্রেটিক শপথের সঙ্গে অক্ষরে অক্ষরে এক না হলেও ভাবটা একই রকম, অন্যের সেবার। সেখানেই বকধার্মিকতা শব্দটির চরম সার্থকতা, হিপোর মাপের।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

coronavirus COVID-19
Advertisment