Advertisment

কালান্তর বন্ধ: ইতিহাসের অবসান বটে, কিন্তু...

'কালান্তর' বন্ধ হয়ে গেল বলে যাঁরা হাহুতাশ করছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন নিয়মিত এই কাগজটি পড়তেন? সিপিআই-এর সদস্য সমর্থক, তাঁরাও কি সকলেই পড়তেন?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

বন্ধ হয়ে গেল কালান্তর

একটি প্রাচীন দৈনিক, যার বয়েস বাহান্ন বছর, তা যখন বন্ধ হয়ে যায় সেটা শুধুমাত্র একটা সংবাদপত্রের উঠে যাওয়া নয়। এক হিসেবে ইতিহাসের অবসানও বটে। যে কাগজের নামকরণ করেছিলেন বিষ্ণু দে এবং অলংকরণ সত্যজিৎ রায়ের, যে কাগজের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে একদা জুড়ে ছিল ভবানী সেন এবং সোমনাথ লাহিড়ীর নাম, তার বন্ধ হয়ে যাওয়া সমগ্র বামপন্থী মহলের কাছেই বেদনার। কারণ 'কালান্তর' শুধুমাত্র একটি কাগজই নয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে এই কাগজটি দুই পার্টির ভাগ হয়ে যাওয়া, নক্সাল আন্দোলন, জরুরী অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীকে সমর্থন সহ বহু বিতর্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের আগ্রহী ছাত্ররা 'কালান্তর'-কে তন্বিষ্ঠ অনুধাবন করলে বুঝতে পারতেন কীভাবে একটি কমিউনিস্ট পার্টি তীব্র মতাদর্শগত সংগ্রামের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে বেড়ে  উঠতে পারে।

Advertisment

উদাহরণস্বরূপ, 'কালান্তর'-এর সাংবাদিক ছিলেন অবিস্মরণীয় সাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি নিজে কোনওদিন কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হয়ে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে না পারলেও আদর্শগত কারণে পুরনো পার্টিতেই ছিলেন। 'কালান্তর'-এ প্রকাশিত তাঁর রিপোর্তাজগুলি পাঠ করলে তাঁর সেই মানসিক দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আবার সাতাত্তরের নির্বাচনের আগে সিপিআই যখন জরুরি অবস্থায় নিজেদের অবস্থানের সঙ্গে সমন্বয় রেখেই কংগ্রেসকে সমর্থন করল, এবং সিপিআই(এম) দাঁড়াল বিরুদ্ধ ভূমিকায়, তখন এই দীপেন্দ্রনাথকেই প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সির সমর্থনে একটার পর একটা তাত্ত্বিক লেখা নামাতে হয়েছিল। 'কালান্তর'-এর পাতাতেই। কেন সিপিআই ইমার্জেন্সিকে সমর্থন করেছিল? তারও ব্যাখ্যা মিলবে কালান্তরের পাতায়। আবার আশির দশক থেকে যখন নিজেদের ভুল সংশোধন করতে শুরু করল পার্টি, বামফ্রন্টে যোগ দিল, তখনকার তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে মনোজ্ঞ বিশ্লেষণ আছে বিভিন্ন লেখকদের লেখায়। এগুলো সময়ানুসারে পাঠ করে গেলে একটা কমিউনিস্ট পার্টির ঠিক-ভুল ভরা যন্ত্রণাদীর্ণ যাত্রাপথ,  ভ্রাতৃহত্যার রাজনীতির মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রাণপণে নিজের রাস্তা খুঁড়ে চলা এবং অন্য কমিউনিস্ট পার্টিটির সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের মাধ্যমে এক প্রকার বোঝাপড়ায় আসার জোট রাজনীতি, এই গোটা ইতিহাসটাকেই সময়ের আয়নায় ধরা যেতে পারত। একে ইতিহাসের মৃত্যু ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে !

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ১৮)

কিন্তু এই প্রসঙ্গে কয়েকটি অপ্রিয় প্রশ্ন না করে পারছি না। 'কালান্তর' বন্ধ হয়ে গেল বলে যাঁরা হাহুতাশ করছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন নিয়মিত এই কাগজটি পড়তেন? সিপিআই-এর সদস্য সমর্থক, তাঁরাও কি সকলেই পড়তেন? মাঝে মাঝে সংবাদপত্রের পাতায় দেখি, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু আক্ষেপ করছেন যে তাঁদের দলীয় সদস্যরাও সকলেই যে গণশক্তির গ্রাহক, এমনটা নয়। একই অবস্থা 'কালান্তর'-এর ক্ষেত্রে হওয়াও বিচিত্র না। এটা ঠিকই যে সবাই যদি এই কাগজটি পড়তেন তাহলেও কাগজটিকে বাঁচানো কঠিন হতেই পারত, কারণ আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একটি সংবাদপত্রের টিকে থাকা সার্কুলেশনের ওপর যত না নির্ভর করে তার থেকে অনেক বেশি নির্ভর করে বিজ্ঞাপনের ওপর। ২০১১ সাল থেকেই বৈরী রাজ্য সরকার তাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল। ২০১৮ সালে পরবর্তী কোপটা এল কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে। তাদের বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাবার পর কাগজ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। সবই মানলাম। কিন্তু প্রশ্নটা হল, কালের নিয়মে 'কালান্তর' যদি বন্ধ হতই, তৃণমূল ও বিজেপি-র কাছ থেকে এর বেশি কিছু আশা করাও যায় না, তাহলে নিজেদের কথা বাইরে ছড়াবার বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন? তথ্য-বিস্ফোরণের যুগে দাঁড়িয়ে সংবাদপত্রই তো আর একমাত্র নিজেদের কথা পৌঁছে দেবার অস্ত্র নয় !। সেটা সত্তরের দশকে ছিল। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলি, যেমন হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, বিভিন্ন ওয়েবসাইট, সেগুলো যেরকম মারাত্মকভাবে মানুষের দৈনন্দিন হাতের মুঠোয় চলে আসছে, সেখানে শুধুমাত্র সংবাদপত্রের ওপর কতটুকু ভরসা করা চলে? লক্ষ্যণীয়, বিজেপি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলি কিন্তু সামাজিক মাধ্যমগুলিকে প্রচারের চমৎকার উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে। দিনরাত মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে তাদের আইটি সেল নাকি ভোটের ভাগ্য পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেবার ক্ষমতায় চলে গেছে বলে জনশ্রুতি। দক্ষিণপন্থীদের কাছ থেকে প্রচার ও সংগঠনের কৌশল  শেখা হবে না কেন? তারা যদি মিথ্যা তথ্য পরিবেশনের জন্য এত সুচারুভাবে সামাজিক মাধ্যমকে কাজে লাগায়, তাহলে একটি কমিউনিস্ট পার্টি সত্য প্রচারে এত পিছিয়ে থাকবে কেন?

একটু লক্ষ্য রাখলে বোঝা যাবে যে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি কিন্তু একটু দেরিতে হলেও খেলাটা ধরে ফেলেছে। কংগ্রেস তাদের নিজস্ব প্রচারের দল বানিয়েছে যারা সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছোবার চেষ্টা করছে। সিপিআই(এম) নিজেদের মত করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই আঙিনায় সিপিআই-কে প্রায় দেখাই যায় না। সামাজিক মাধ্যমগুলিতে তাদের উপস্থিতি সাধারণ মানুষদের কাছে প্রায় নেই। এটার কারণ কি সমসাময়িকতাকে মেনে নিতে কোথাও একটা অনীহা? লক্ষ্যণীয়, ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে যেসব মানুষেরা 'কালান্তর' বন্ধ হয়ে যাওয়াতে আক্ষেপ করছেন তাঁদের মধ্যে চল্লিশের নিচে বয়েস এমন খুঁজে পাওয়া কঠিন। সকলেই হয় বৃদ্ধ অথবা মাঝবয়েসী। একটি কমিউনিস্ট পার্টিতে তরুণেরা আসছেন না, খোলা মনে বদলানো সময় ও পরিস্থিতিকে ব্যবহার করতে পারছেন না, এই ভাবনাটি অস্বস্তিকর। সম্ভবত ভুলও। বিশ্বাস করতে ভালবাসি যে কমিউনিস্ট পার্টিতে তরুণ রক্তের সঞ্চালনা আগেরমতই ঘটছে। এটাই দেখার যে সেই যুবকবৃন্দ তথ্য-বিস্ফোরণের প্রযুক্তিকে কত এফেক্টিভলি ব্যবহার করতে পারেন।

আরও পড়ুন, অশোক মিত্রের স্মৃতিচারণ শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের কলমে

একটা তুলনা দিচ্ছি। ত্রিপুরায় সিপিআই(এম)-এর কাগজ 'দৈনিক দেশের কথা' যখন বন্ধ করে দিল বিজেপি সরকার, একটা বিশাল প্রতিবাদ এসেছিল কিন্তু সোশাল মিডিয়া থেকেই। হাজার হাজার লেখাপত্র তখন চোখে এসেছিল। হোয়াটসঅ্যাপ ছেয়ে গিয়েছিল ধিক্কার, প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভের আহ্বানে। এবং যে সময়কাল জুড়ে কাগজটি বন্ধ ছিল, সেই সময়কালে ত্রিপুরা সিপিআই(এম)-এর বক্তব্য আমরা নিয়মিত সোশাল মিডিয়া থেকে শুনতে পেতাম। এগুলোই জনমত তৈরিতে সাহায্য করে। 'দেশের কথা' বন্ধ হয়ে গেছে, সেই পরিস্থিতিতে একটি রাজনৈতিক দল ঠিক সেটাই করেছে যেটা তার করণীয় ছিল। সোজাসুজি মানুষের দরবারে পৌঁছিয়ে গিয়েছে। অপ্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে নিজের কথা পৌঁছিয়ে দিয়েছে সবার মধ্যে। ঠিক এটাই দেখা যাচ্ছে না 'কালান্তর'-এর ক্ষেত্রে। সেখানে শুধুই হাহাকার আর ইতিহাসের স্মৃতিচারণ। 'কালান্তর' নিজের সময়কালে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে সত্য, কিন্তু যখন 'কালান্তর' ছিল না তখনও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, এবং এখন 'কালান্তর' নেই, কিন্তু তখনও কমিউনিস্ট পার্টি আছে এবং থাকবে। তাই শুধুমাত্র সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে থেকে নিজেদের কথাকে অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়াটাই সময়ের দাবী।

লেখার শুরুতে বলা হয়েছিল, 'কালান্তর'-এর বন্ধ হয়ে যাওয়া ইতিহাসের অবসান।  কিন্তু ইতিহাস, ইতিহাসই। সে গতকালের নায়ক। একটা  কমিউনিস্ট পার্টি গতকালকের নায়ক হয়ে বেঁচে থাকবে, না কি প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আজকের যন্ত্রণাদীর্ণ সময়ের রাশ নিজের হাতে তুলে নেবে, সেটাই ঠিক করে দেবে ভারতবর্ষে বামপন্থীদের আগামিকাল কোন চেহারা নিয়ে আসবে।

মতামত নিজস্ব

CPIM CPI
Advertisment