কাছারিবাড়িতে সপারিষদ জমিদার মশাই বসে আছেন। কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। খাজনা আদায়, আয়-ব্যয়ের হিসেব থেকে দুষ্টু লোকের বিচারপর্ব, সবই চলছে। এরই মধ্যে পাঁজি হাতে পুরুত মশাইয়ের প্রবেশ। দুর্গাপুজোর নির্ঘন্ট জানাতে হবে জমিদারবাবুকে। কাছারির নিয়মিত কাজকর্ম মিটে গেলেই পুজো নিয়ে কথা বলবেন কত্তামশাই। নায়েব মশাই মনে মনে তৈরি হন। খরচের ব্যাপারটা কমাতেই হবে এবার। দিনকাল বদলের সঙ্গে খাজনা আদায় কমেছে। আর ওটাই তো জমিদারির আসল। কিন্তু কী করে খরচটা কম করা যাবে, সেটাই ভেবে উঠতে পারেন না তিনি।
পুজোর নির্ঘন্ট থেকে অন্যান্য আলোচনা, পুরুত মশাইয়ের সঙ্গে কথা সেরেই নায়েবের দিকে তাকান জমিদার। নায়েব খাতাপত্র নিয়ে এগিয়ে যান। তারপর শুরু করেন, "এবারে পুজোর খরচ আর না কমালেই নয় বাবু। জমিদারির আয় কমেছে, বেড়েছে খরচ।" বাবু একটু গম্ভীর হলেন, বললেন, "তুমি কী ভেবেছ শুনি?" নায়েব একটু গলা ঝেড়ে নিয়ে, "ওই বলছিলাম কী, কাঙালি ভোজনটা নাহয় বাদ দিন এখন থেকে। কী দরকার ওদের ওই গুষ্টিসুদ্ধু লোকজনকে খাইয়ে?" নায়েব কথা শেষ করার আগেই বাবু হাত তোলেন, "আমি বেঁচে থাকতে এটা হবে না। কী বলছ নায়েব? বছরে একটা দিন ওরা একটু ভালোমন্দ খায়। এর জন্য সারা বছর অপেক্ষা করে ওরা, আমি কি তা জানি না? তুমি বরং অন্য কিছু ভাবো।"
আরও পড়ুন: রাজনীতির গণেশপুজো, গণেশপুজোর রাজনীতি
নায়েব মশাই কী ভেবেছিলেন, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। এটা নিছকই কাল্পনিক এক চিত্র। ইতিহাস বলে, সেকালের বড় মানুষদের হৃদয়টাও বৃহৎ ছিল। পুজোর আনন্দে সকলকেই শরিক করতেন তাঁরা। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে। তবে, সে তো সবকালেই সমান। এটা সেই সময়ের কথা, যখন বাঙালির দুর্গাপুজো রাজরাজড়া বা জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত হতো। এই উপলক্ষ্যে সাধারণ মানুষের যা কিছু আমোদ-আহ্লাদ প্রাপ্তি, তাও ঘটত ওই অনুষঙ্গেই। কিন্তু বারোয়ারি থেকে সর্বজনীন হওয়ার পর পুরোপুরি বদলে গেল ছবিটা। এক্ষেত্রে গ্রামে বা পাড়ায় পুজো শুরু হলো চাঁদা তুলে।
সর্বজনীন, অর্থাৎ সবার তাতে সমান অংশগ্রহণ। সেখানেও হয়তো অর্থবান মানুষজনের কিঞ্চিৎ পৃষ্ঠপোষকতা থাকত। তবে, তাতে সাধারণের আনন্দ-যোগদানে কোনও বাধা ছিল না। পরবর্তীকালে আবাসনগুলিতেও আমরা অনেকটা এরকম ছবিই দেখতে পাই। পুজোর আয়োজনে পাড়ার বা গ্রামের ক্লাব যে তখন ছিল না, তা নয়। তবে তাদের কর্মকান্ড অনেক বিস্তৃত ছিল। তারা পাঠাগার চালাত, ফুটবল ম্যাচ হতো, পাড়ায় কেউ অসুস্থ হলে বা সমস্যায় পড়লে ক্লাব সদস্যরা হাজির থাকতেন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তাদের যোগ আলাদা কিছু ছিল না। স্বাভাবিক। পুজো তখনও 'ইভেন্টে' পরিণত হয় নি। এখানকার ক্লাবগুলি জনসেবা করে না বলছি না। তবে পুজোয় যে খরচ বা বর্ণাঢ্য আয়োজন হয়, তার তুলনায় বাকি কর্মকান্ড নগণ্য বললেই চলে।
পৃষ্ঠপোষকতা থেকে স্পনসরশিপ, সাবেকি ঘরানার পুজো থেকে থিম পুজো, হঠাৎ করেই যেন আমূল বদলে গেল দুর্গাপুজোর চালচিত্র। আন্তরিকতা কমল, বাড়ল দেখনদারি। বাহ্যিক আড়ম্বর তো ছিলই, আবহে নতুন সুর যোগ করল পূজা প্রতিযোগিতা। শুরু হয়ে গেল নয়া পুজো-সংস্কৃতি, যাকে ইভেন্ট বলাই ভালো। এই সংস্কৃতির অনেকটা জুড়ে শুধুই টাকার খেলা। গত প্রায় এক যুগ ধরে কলকাতা তথা সারা রাজ্য এই খেলায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। কেউ জ্ঞানত, কেউ না বুঝে, কেউ বা ভয়ে। কারণ প্রত্যেকটি বড় ক্লাব এখন কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পল্লবিত।
আরও পড়ুন: রানাঘাটের নাইটিঙ্গেল, এক হঠাৎ তারার কাহিনি
যে ক্লাবের সঙ্গে যত বড় নেতার (পড়ুন শাসকদল ) নাম যুক্ত, তাদের রোয়াব তত বেশি। পুজো করে এলাকাবাসীকে ধন্য করে দেয় তারা। ক্লাবের পুজো পুরস্কার পায়, ক্লাবের পুজো দেখতে ভিআইপি আসেন, উদ্বোধনের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সেখানে কত বড় ভিআইপি আসতে পারেন, তার একটা আন্দাজ শহরবাসীর হয়ে গেছে। এই নিয়ে লেবু চটকে লাভ নেই।
মোদ্দা, এতে তো এলাকাবাসীর খুশি হওয়ারই কথা । তাঁরাও তো জাতে উঠছেন। এই বাবদ তাঁদেরও কিছু দায়িত্ব বর্তায়। কী না, চাঁদা দেওয়া নিয়ে নো ঝামেলা। ক্লাবের এবং পাড়ার ভাবমূর্তি রক্ষায় খরচ তো করতেই হবে। এই যে খরচ এবং তার যোগান, হিসেবটা করার জন্য চট করে চলুন একবার ওই পুরোনো দিনে চলে যাই। পুরোটাই ছিল রাজা, জমিদার বা ধনী মানুষের পৃষ্ঠপোষকতা। আজ পুজো সর্বজনীন। চাঁদা আছে, স্পনসর আছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে সরকারি অনুদান। সত্যি কত টাকার প্রয়োজন? কে বা কারা স্থির করে এই প্রয়োজন?
বলা বাহুল্য, এই সরকারি অনুদান প্রসঙ্গেই গত এক-দু'বছরে এক প্রবল বিতর্ক দানা বেঁধেছে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছেন অনেকেই। রাজনীতি আছে কি না, ক্লাবগুলিকে হাতে রাখাই এই বদান্যতার উৎস কি না, সেসব বিতর্কে না গিয়েও কিছু কথা বলা যায়। যেগুলি খুব সাধারণ যুক্তি, বলা যায় সম্পূর্ণ রাজনীতি বহির্ভূত। অনুদান কাকে দেওয়া হয়, যে আর্থিকভাবে অনগ্রসর। প্রয়োজনীয় আর্থিক সঙ্গতির ব্যবস্থা কিছুতেই যে করে উঠতে পারছে না। পুজোর জন্য ক্লাবগুলিকে অনুদান দেওয়া কি এই যুক্তির সঙ্গে কোনওভাবে মেলানো যায়?
আরও পড়ুন: মিড ডে মিল কেলেঙ্কারি: প্রসঙ্গ মানবিকতা
এক্ষেত্রে ক্লাবগুলিকে দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে ইনকাম ট্যাক্স রিটার্ন জমা করতে বলাটা বরং অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত মনে হয়। এরই সঙ্গে চিটফান্ডগুলির সঙ্গে কিছু ক্লাবের নাম জড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাও উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠে। বেহিসাবি আর্থিক লেনদেন কোনও ক্ষেত্রেই মঙ্গলদায়ক হতে পারে না। সেটা ব্যক্তিগত হোক বা সামাজিক। দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে বাঙালি একদা নির্মল আনন্দের জোয়ারে ভাসত। আড়ম্বর ছিল সেদিনও। কিন্তু সেটা মাত্রাছাড়া নয়। আজ একেকটি স্টার ক্লাবের পুজো মণ্ডপে গেলে মনে হয়, এত অপচয় করার সাহস কোথা থেকে পাই আমরা? আমাদের না কোষাগার শূন্য! সেই কোষাগার থেকে আর যাই হোক, ক্লাবের অনুদান প্রাপ্তির বিষয়টা কোনও যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না।
এবছর সেই অনুদান বেড়েছে। সঙ্গে বিদ্যুতের বিলেও ছাড়। আমোদ-ফুর্তির পোয়াবারো। ভালো কথা, রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের প্রমোদের জন্য কিছুটা ভার নিচ্ছে সরকারি কোষাগার। নিন্দুকেরা (পড়ুন বিরোধী দল) কী বলল, তাতে কিছু আসে যায় না। সাধারণ মানুষের কিছু কষ্ট হবে। সে তাঁরা বৃহত্তর স্বার্থে সেসব মানিয়ে নেবেন। কলকাতার এক দামি ক্লাবের ব্র্যান্ডেড পুজোর কথা মনে পড়ছে। গত বছরের কথা। তখনও পুজো শুরু হয় নি। আয়োজন চলছে মাত্র। ক্লাবেরই পিছনে এক পরিচিতের বাড়িতে গেছি। গিয়ে দেখি তারা ঘরের সব জানালা বন্ধ করে বসে। কারণ কী? না ওই আমোদপ্রমোদের চোটে তাদের অসুস্থ হওয়ার যোগাড়।
এমন অনেক পরিবারই আছেন। আছে বহু ঘটনা। পুজোর অতিরিক্ত দেখানেপনা, বেশি দর্শক টানার আয়োজন করতে গিয়ে গত বছর এক পুজো মণ্ডপে মারাত্মক এক দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাণহানিও হয়। শহরের হুজুগে মানুষ অবশ্য সেসব মনে রাখেন না। কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই যায়। কোথা থেকে শুরু এই পাগলামির? কোন প্রশ্রয়ে অর্থকে অনর্থের মূল প্রতিপন্ন করা? কোন রুচি ও সংস্কৃতির টানে সব ভুলে শুধু প্রমোদে ভেসে যাওয়া? অনুদান দেওয়া না দেওয়া সরকারি সিদ্ধান্ত। প্রতি বছর অনুদান বাড়িয়ে বাঙালির চিরন্তন উৎসবকে কোন স্টেটাস দেওয়া হচ্ছে বা হবে, তা নিয়েও নাহয় ওঁরাই ভাববেন। তবে প্রশ্ন উঠবেই। মানুষ আজ না হোক কাল হিসেবও বুঝে নেবেন। সে যে পুজোই হোক। মা দুর্গা বা বাবা নির্বাচন।