ফ্যাসিস্ত সরকারের আমলে যা কিছু আশা করা যায় তাই ঘটছে। সমাজকর্মী, কবি, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবীদের গ্রেফতারের ঘটনায় এভাবেই প্রতিবাদ জানালেন কবি শঙ্খ ঘোষ। বাংলার বিদ্বজ্জনদের মুখরক্ষা হল যেন। তাঁর সতর্কীকরণ, আরও 'দুর্বিপাকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।'
মঙ্গলবার ভারভারা রাও, সুধা ভরদ্বাজ, গৌতম নওলাখা, ভার্নন গঞ্জালভেস, অরুণ ফেরেরার মতো পাঁচ বিশিষ্টজনকে গ্রেফতারের পাশাপাশি রাঁচিতে অশীতিপর পাদরি ফাদার স্ট্যান স্বামী, সমাজবিজ্ঞানী আনন্দ তেলতুম্বে, আইনজীবী সুশান আব্রাহামের বাড়িতেও চলে ব্যাপক তল্লাশি। এর পর সারা দেশে জুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। ট্যুইট করে ঔপ্যনাসিক অরুন্ধতী রায় এই ঘটনাকে জরুরি অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। একই ভাবে ট্যুইট করে ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তো বলেই বসেছেন, এমন পরিস্থিতিতে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী আইনজীবীর পোশাক পরে সুধা ভরদ্বাজের পক্ষে দাঁড়াতেন। একই সঙ্গে যোগ করেছেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে মোদী সরকার গান্ধীকে ততদিনে তাঁকেও আটক বা গ্রেফতার করে ফেলেনি।
আরও পড়ুন, এলগার পরিষদ কাণ্ডে ধৃতদের ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট
মঙ্গলবার থেকেই দেশ জুড়ে এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ডকস.গুগুল.কম-এ শুরু হয় সই সংগ্রহ। অধ্যাপক, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, বিশিষ্ট নাগরিকদের একের পর এক সই যোগ হতে থাকে সেখানে। বুধবার সুপ্রিম কোর্টে রোমিলা থাপার, প্রভাত পট্টনায়ক, সতীশ দেশপাণ্ডেরা এই গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানালেন। বিকেল ৩.৪৫ মিনিটে মামলার শুনানির সময় ঘোষিত হল। সেই সময় মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআর-এর ডাকে কলকাতায় প্রতিবাদী মিছিলে রাগ-ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র-যুব ও সমাজকর্মী, আইনজীবী, সাংবাদিকরা। তখনও বিদ্বজ্জন বলে আমাদের সামনে যাঁদের ছবি ভেসে ওঠে, বাংলার সেই ব্যক্তিদের হিরণ্ময় নীরবতা একই সঙ্গে শরীর-মনে শিরশিরে অনুভূতি ছড়িয়ে দেয়। এ কথা যখন বলছি, তখনও সান্ধ্য টিভি শো-এ এই প্রায় জরুরি অবস্থা সম পরিস্থিতিতে কোনও বিতর্ক সভার আয়োজন করা হয়নি।
দেশের কোনও কোনও বিশিষ্ট মানুষ এই সময়কে একরকম অঘোষিত জরুরি অবস্থায় সঙ্গে তুলনা করছেন। দেখাই যাচ্ছে, যাঁরাই সরকারের নানা নীতির প্রতিবাদে, নাগরিক ও মানবিক অধিকারের দাবিতে মুখর তাঁদের বিরুদ্ধেই কখনও লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুলিশ, কখনও ঝাঁপিয়ে পড়ছে হিন্দুত্ববাহিনীর নানা শাখা। সাংবাদিকদের উপর নানা ভাবেই এই আক্রমণ শুরু হয়। মিডিয়া ওয়াচ ডগ 'রিপোর্টার স্যানস ফ্রন্টিয়ারস' -এর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্স অনুযায়ী, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার নিরিখে ২০১৬ সালে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ১৩৩ তম। ২০১৭ সালে তিন ধাপ নেমে স্থান হয় ১৩৬। ২০১৮ সালে আরও দু'ধাপ নামার পর এখন ১৩৮। ভারতের নীচে নামার মস্ত বড় কারণ কাশ্মীর। আরএসএফ রিপোর্টে কাশ্মীরকে 'খবরের কৃষ্ণগহ্বর' বলে বর্ণনা করেছে। একেই বিদেশি সাংবাদিকদের ভারতে আসার ক্ষেত্রে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। কাশ্মীরে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। সম্প্রতি এক ফরাসি সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়। প্রতিনিয়ত সরকারি বাহিনীর রোষ ও হেনস্থার মুখে পড়তে হয় সাংবাদিকদের, বিশেষ ভাবে চিত্র সাংবাদিকদের। কেন্দ্রীয় সরকারের 'মৌন সম্মতি' আছে বলেই সেনা ও আধা সামরিক বাহিনী সাংবাদিকদের হেনস্থা করতে পারে বলে মনে করে আরএসএফ। এ ছাড়া ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো'র পরিসংখ্যান থেকে জানতে পারছি, ১৯৯২-২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৪ বছরে এ দেশে ৭৭ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে খুন হন ন'জন। ২০১৭ সালেই খুন হয়েছেন ত্রিপুরার সুদীপ দত্ত ভৌমিক ও শান্তনু ভৌমিক, উত্তর প্রদেশের নবীন গুপ্তা ও কর্নাটকের গৌরী লঙ্কেশ। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের সন্দীপ শর্মা এবং বিহারের নবীন নিশ্চল ও বিজয় সিংহ। তিন জনকেই রহস্যজনক ভাবে গাড়ি চাপা দিয়ে মারা হয়েছে। এর পরেই জুন মাসে খুন হন শুজাত বুখারি।
আরও পড়ুন, গৌরী লঙ্কেশসহ চার বুদ্ধিজীবীর হত্যা: গোলোকধাঁধার মধ্যে কী রয়েছে?
পাশাপাশি, সাম্প্রতিক অতীতে এই একই কায়দায় এবং একই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অধ্যাপক সোমা সেন, সমাজকর্মী রোনা উইলসন, আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিঙের মতো পাঁচজন বিশিষ্ট সমাজসেবীকে। প্রথমে বলা হয়েছিল ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ভীমা কোরেগাঁওয়ে হিংসাত্মক ঘটনার জন্য এঁরা দায়ী। দ্বিতীয় অভিযোগ আনা হল এঁরা সকলে মাওবাদীদের সঙ্গে যুক্ত। অভিযোগ তেমন জোরদার হয়নি মনে করায় এর পর অভিযোগ আনা হল, প্রধানমন্ত্রীকে খুন করার চক্রান্তের সঙ্গে এঁরা যুক্ত। একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখা যাক।
২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভীমা-কোরেগাঁও শৌর্য দিন প্রেরণা অভিযান এলগার পরিষদ পালন করেছিল। সঙ্ঘী সংগঠনগুলি পেশোয়ার বিরোধী দলিতদের এই জমায়েত ও শৌর্যদিন পালন ভালো চোখে দেখেনি। পরদিন ১ জানুয়ারি ২০১৮, মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন স্থানে উচ্চবর্ণ ও দলিতদের মধ্যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে। ৮ জানুয়ারি ধৃত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পুনে বিশ্রাম বাউগ থানায় জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। মার্চ মাসে এর সঙ্গে যোগ করা হয় ষড়যন্ত্রের মামলাও। এবার ইউএপিএ ধারা যোগ করা হল। মানবাধিকার সংগঠনগুলি মনে করে, ১ জানুয়ারির ভীমা-কোরেগাঁওয়ে হিংসাত্মক ঘটনার জন্য দায়ী সঙ্ঘ পরিবার এবং তাদের নেতা শম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোতে। তাদের গ্রেফতারের জন্য এই ব্যক্তিরা ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংগঠন, প্রেরণা অভিযান সোচ্চার হয়েছিল। অভিযোগ, বর্ণহিন্দু এই হিন্দুত্ববাদী নেতাদের বিরুদ্ধে আঙুল তোলার অপরাধেই ওই পাঁচ অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিকদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন দুটির অভিযোগ, মহরাষ্ট্রের ফড়ণবিশ সরকার, হিংসার জন্য প্রকৃতপক্ষে দায়ী ব্যক্তিদের আড়াল করছে। পাশাপাশি, এলগার পরিষদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গল্প ফেঁদেছে এবং প্রেরণা অভিযানের পিছনে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক মদত রয়েছে বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের আরও অভিযোগ, শম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোতের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ জমা পড়েছে, এমনকি এফআইআর করা হয়েছে। ভীমা-কোরেগাঁও ছাড়াও এই দুজনের বিরুদ্ধে একাধিকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধানো এবং পুনেতে বিশিষ্ট দলিত ব্যক্তিদের মূর্তির অবমাননার অভিযোগও রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট এই দুই ব্যক্তির আগাম জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে। তবু, সরকার তাদের গ্রেফতার করেনি। শুধু যে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি তাই নয়, বিভিন্ন সময় সাম্ভাজি (মনোহর) ভিদে এবং মিলিন্দ একবোতেকে বিজেপি-র সভামঞ্চে এবং ফড়ণবিশ বা মোদীর মতো শীর্ষস্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে নিয়মিত ওঠাবসা করতে দেখা গেছে। মহারাষ্ট্রে রায়গড়ে ২০১৪ নির্বাচনের সভামঞ্চ থেকে ভিদে সম্পর্কে নরেন্দ্র মোদী বলেন, “আমি ভিদে গুরুজির কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ উনি আমাকে নিমন্ত্রণ করেননি, উনি আমাকে হুকুম দিয়েছেন। আপনারা সবাই ওনার হুকুম শুনতে ও মানতে অভ্যস্ত। আমি অনেক বছর ধরে ভিদে গুরুজিকে চিনি। আমাদের যখন জনসেবা শেখানো হত, তখন ভিদে গুরুজির উদাহরণ দেওয়া হত।”
আরও পড়ুন, এলগার পরিষদ কাণ্ডে গ্রেফতার পাদ্রি, আইনজীবী, অধ্যাপক, কবি
প্রথম পর্বেও মাওবাদী চক্রান্তের তথাকথিত দলিল বিশেষ বিশেষ সংবাদমাধ্যমে সুচতুর ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় পর্বেও একই ছক নেওয়া হয়। সংবাদমাধ্যমের সাহায্যে এক মতামত নির্মাণের পর্ব সমাপ্তির শুরু হয় অভিযান। তফাতটি এই যে, এবার অনেক বেশি সতর্ক ছিলেন দেশের নানাস্তরের বিশিষ্টজন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি। হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে একের পর এক সময়োচিত আবেদন সে কথাই প্রমাণ করে। ইউএপিএ-কে হাতিয়ার করে চালানো হয় অভিযান। যাতে ওয়ারেন্ট ছাড়াই তল্লাশি অভিযান চালানো যায়। ধৃতেরা জামিন না পায় এবং দীর্ঘকাল বিচারের নামে আটক রাখা যায়। এ যাত্রা সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে।
পুনঃ সাংবাদিকরা বিশিষ্টজনদের কাছে পৌঁছেছেন। রাতে দেখা গেল তাঁরা যথাযথ বিদ্বজ্জনের মতো বাক্যপ্রয়োগে বাইট দিচ্ছেন। কবিতা পড়ছেন। অতীতের অভিজ্ঞতা বলে --- মুষ্টিমেয় মুক্তমনা বিশিষ্টজন ছাড়া --- লিখিত প্রতিবাদী বয়ান নিয়ে বাংলার বিদ্বজ্জনদের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হত। তাঁরা সেই বয়ানে 'অটোগ্রাফ' দিয়ে বাধিত করতেন। এগিয়ে এসে প্রতিবাদ জানানোর সংস্কৃতি ক্রমে মুছে গিয়েছে। বর্তমান সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের আওতা থেকে মুক্ত, স্বাধীন চিন্তাশীল বিদ্বজ্জন নেহাতই ডুমুরের ফুল। শাসকের কিংবা ক্ষমতাশালীর বিরুদ্ধে নিজস্ব বিশ্বাস মতো কথা বলার সাহস ও স্পর্ধা আছে এমন বিদ্বজ্জন এ বাংলায় আজ বিরল।