আর পাঁচ জন সমাজ সচেতন মানুষের মতোই ফেসবুকের নীল-সাদায় আঁচড় কাটি, খেলতে খেলতে লিখি, লিখতে লিখতেই কমেন্টে কমেন্টে চলতে থাকে মতবিনিময়-মতবিরোধের ছুটকারা। এসব তর্ক বিতর্ক, বাকবিতণ্ডার তরজা গান একেবারেই ওপেন ফোরামের কমেন্টবক্সের অলংকার। তবে তার ধাক্কা কখনো কখনো ইনবক্স অবধি গড়ায় বৈকি! ব্লকড-আনফ্রেন্ডের লাগাতার খেলা চলে, টুকটাক হুমকি-হামকা পাই বটে, তবে সেগুলো গায়ে না মাখলেও চলে।
বস্তুত, তেল-নুন-লাকড়িসার নিরামিষ্যি জীবনে ফেসবুক-যাপন এক খোলা জানালার হাতছানি---- অন্তত গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত এমনটাই ভেবেছি। গোল বাঁধলো প্রীতম মৈত্রের একটি ন্যুড ফটোগ্রাফি নিয়ে।
পান পাতায় মুখ ঢাকা শোলার মুকুট পরা এক নগ্ন মেয়ে। অপাঙ্গে তাকানো মেয়েটির দু ভ্রূর মাঝখানে একটি সিঁদুর টিপ। তার নগ্নতা আদৌ দৃশ্যমানই নয়। অপর্যাপ্ত কেশরাশি ঢেকেছে তার স্তনগরিমা। ডান হাতে নিতান্ত অপটু ভাবে একটি গাছকৌটোয় কন্যা তার যোনীদেশ ঢেকেছেন। হয়তো, বার্নার্ড শ'র "ম্যারেজ ইজ আ লিগ্যাল প্রসটিটিউশন" জাতীয় বার্তা আলোকচিত্রটিতে থাকতে পারে, কিন্তু ছবিটির আনস্মার্ট উপস্থাপনা-দৈন্যের কারণে এ ছবি আদৌ আমার নজর কাড়েনি। স্ক্রল করতে করতেই নিউজ ফীডে ছবিটি দেখেছি।
এবং ভুলে গিয়েছি।কিন্তু, ভুলে থাকা গেল না! ভুলে যাওয়া অপরিণত ন্যুড ফটোটি ফিরে এল অন্যভাবে।
আরও পড়ুন, নগ্ন ফোটোগ্রাফি নিয়ে তোলপাড় ফেসবুক, প্রাণনাশের হুমকি
ছবিটি ফেসবুকে পোস্ট হবার পর-ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। আলোকচিত্রী প্রীতম মিত্র ট্রোলড্ হতে শুরু করেন। নিন্দিত নন্দিত ধিকৃত আলোচিত হতে হতেই জনৈক রাজ সরকার রিঙ্কু প্রীতম মিত্রের মাথার দাম ধরে বসেন ও প্রকাশ্যে পাব্লিক ওপেন ফোরামে তাকে বেপরোয়া মৃত্য-হুমকি দেয়। বলা হয়, এই নগ্ন ছবি হিন্দু ধর্মকে আঘাত করেছে।
খুল্লামখুল্লা প্রাণনাশের হুমকিটি ফেসবুকে দেখামাত্রই আমি রাজ সরকার রিঙ্কুর পোস্টটির তীব্র বিরোধিতা করি। "কে এই ধর্মের ইজারাদার যে ওপেন ফোরামে একজনের মাথার দাম ধার্য করে" শিরোনাম দিয়ে ওই বিশেষ পোস্ট শেয়ার করি। ফলত, ওপেন ফোরামেই আমাকেও আক্রমন করা শুরু হয়।
নিজের অবস্থান দ্ব্যর্থহীনভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য আমি এবার "একবিংশ শতক ও অশ্লীলতার দায়" শীর্ষক নিবন্ধ লিখি। স্পষ্ট জানিয়ে দিই, ওই ছবিটির নান্দনিক মূল্য নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই,। কিন্তু এই উদ্ধত স্পর্ধিত প্রাণনাশ হুমকির বিরুদ্ধে আলোকচিত্রীর পাশেই আমার নির্দ্বিধ অবস্থান।সুধীসমাজকে শিল্পীর পক্ষে দাঁড়াবার জন্যে আমি অনুরোধ করি।
নিজের টাইমলাইনে এই নিবন্ধ-স্ট্যাটাসটি আপডেটের একঘন্টার মধ্যেই মেসেঞ্জার-বাহিত কুৎসিত কদর্য ধর্ম-শ্লোগান সম্বলিত মেসেজে আমার ইনবক্স বোঝাই হয়। ওপেন পোস্টে লঘুচালে বিষয়টি সম্পর্কে সবাইকে অবগত করানোর পরে গুপ্তহানা বাড়ে বৈ কমেনা। তিতিবিরক্ত আমি এবার বাধ্য হয়েই একটি মেসেজের স্ক্রিনশট নিই, আমার টাইমলাইনে পোস্ট করি। অন্য পোস্টের মতো এটিও পাব্লিক করা থাকে।
অতি অশ্লীল সেই স্ক্রিনশট পোস্টের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। অধিকাংশই ছিলেন ক্ষিপ্ত, যা খুবই স্বাভাবিক।
কিন্তু কতিপয় 'অবন্ধু' ওই কদর্য মেসেজের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানান। তারা দাবী করেন, এটি নাকি ফেক মেসেজ আর নেগেটিভ পাবলিসিটির জন্যেই আমি একটি স্বকল্পিত মিথ্যে মেসেজের স্ক্রিনশট দিয়েছি।
বন্ধু অবন্ধুদের চাপান উতোর যখন তুঙ্গে, আমার পঞ্চদশী কন্যার ধৈর্য বাঁধ ভাঙ্গে। অবন্ধুদের বিপক্ষীয় কমেন্টের প্রত্যুত্তর হিসেবে সে কিছু বিশেষ "বিরোধী" প্রোফাইলের কপিলিঙ্ক ও মেসেজের স্ক্রিনশট পোষ্ট করে।
এর মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে মেয়ের ইনবক্সে সুদীর্ঘ কুৎসিততম মেসেজ-বার্তাটি আসে। আশ্চর্যজনকভাবে, এটি একটি গ্রুপচ্যাট। প্রেরক ঝিঙ্কু মাহাতো। অশ্লীল মেসেজটি পাঠিয়েই গ্রুপটি ডি-অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে। ফলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে আর কোনোভাবেই ঝিঙ্কুকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
ঝিংকু মাহাতো প্রেরিত ওই মেসেজটিতে বাছা বাছা অশ্লীল ভাষায় আমার পনেরো বছরের মেয়েকে ধর্ষণ ও মৃত্যু হুমকি দেওয়া হয়। পরোয়ানার তীব্রতা মারাত্মক, যেন কানের গোড়ায় হিস হিস! কয়েক মুহুর্ত স্তম্ভনের পর অসহ্য দাহ পাক খেতে থাকে শরীরে। জেদ বাড়ে, পরোয়ানার স্ক্রিনশট নিই, এবং মেয়ের নাম উহ্য রেখে আমার টাইমলাইনে সেটি পোস্ট করি।
প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সেদিন রাতে, অর্থাৎ ২৭ অগাস্ট কল্যাণী থানায় সমস্ত জানাই। আপাতবাহ্য সহানুভূতির সঙ্গেে কর্তৃপক্ষ গোটা ঘটনাটি দেখেন। কিন্তু বারবার সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্বেও তাঁরা এফআইআর নিতে অপারগ হন। অগত্যা অসম্ভব অনিচ্ছায় একটি জেনারেল ডায়েরি করি। চেয়ারাসীন বড় কর্তা তার মোবাইল থেকেই ভবানী ভবন সিআইডির জনৈক শ্রী সুদীপ্ত দে-কে ধরে দেন। সুদীপ্ত দের সঙ্গে কল্যাণী থানা থেকেই আমার বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়। তিনি ৩০ অগাস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর বারোটার পর আমায় ভবানী ভবন সাইবার ক্রাইম সেলে যেতে বলেন।পরবর্তী ৪ দিনে আমার দুটি মোবাইল নম্বরে মোট ছ বার মৃত্যু ও ধর্ষণ হুমকি আসে। পুলিশে যাওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছি বলে হুমকিদাতারা অজস্র কটুক্তি করে ।আমি জারজ, আমার মেয়ে জারজ, মোল্লাদের কতবার এন্টারটেইন করি, কজন খানসেনা আমার মা ঠাকুমাকে পুষত ----- জাতীয় কথার পাশাপাশি চলতে থাকে জিডি প্রত্যাহারের দাবি। যেভাবে তারা কথা বলে বা যেভাবে ফেসবুকের কল্প চৌহদ্দি পেরিয়ে তারা আমার মোবাইল নাম্বার, বাড়ি ঠিকানার কাছাকাছি অবস্থান বলতে থাকে, তাতে কোনো হুমকিকেই আর ঠিক শূন্য কলসির ঢকঢকানি মনে হয় না।
আমি অত্যন্ত ভীত হয়ে ভবানী ভবনের সুদীপ্ত বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করি। জানতে চাই, শুধু জিডি আমায় কতটা সুরক্ষা দেবে, আমার এখনই এফআইআর করা ও তার কপি ভবানী ভবনে নিয়ে যাওয়া উচিত কিনা। তিনি অতীব সহৃদয় গলায় আমায় আশ্বস্ত করেন, জিডিতেই কাজ চলবে, এমন টা জানান। যে দুটি ডিভাইসে এই মেসেজগুলি এসেছে সেই যন্ত্র দুটি অতি অবশ্যই নিয়ে যেতে বলেন।
সুনির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে ভবানী ভবন পৌঁছই। নিরাপত্তার ঘেরাটোপ পার করে ঝা চকচকে অট্টালিকার সিঁড়ি ভাঙ্গি। কল্যাণী-আলিপুরের যথেষ্ট দূরত্ব জনিত ঘাম ধুলো ক্লান্তি ধুয়ে যেতে থাকে। কারন আমার হাতে রয়েছে সুরক্ষা কবচ জিডি, কানে সুদীপ্তবাবুর বিবেচক আশ্বাস বাণীর কুন্ডল। আমি বিশ্বাস করতে থাকি----- সমাধান আর একতলা দূরত্বে!
"সাইবার ক্রাইম সেল" লেখা নির্দিষ্ট কক্ষের দরজা ঠেলে ঢুকে কেমন একটু ভড়কে যাই। প্রচুর কম্পিউটার ল্যাপটপ থৈ থৈ ঘরে ইউনিফর্মড যুবক-যুবতীরা আড্ডা সমাসীন। ভেলভেট মোলায়ম চেয়ার গুলি কম্পু ডেক্স এর উল্টো বাগে। "ভুল করে ভুুল ঘরে ঢুকে পড়েছি" গোছের ঘাবড়ানো মুখে জনে জনে আসার কারণ দাখিল করি। সকলেই আলগোছে শোনেন, কিংবা শোনেন না। এবং, কিমাশ্চর্যম! সুদীপ্ত দে বলে কোন মানুষের উপস্থিতি দূরে থাক, তার অস্তিত্ব প্রমাণই করতে পারিনা! মরিয়া হয়ে বারবার সুদীপ্ত বাবুকে ফোন করি। কিন্তু "ইয়ে নাম্বার উপলব্ধ/মজুদ নেহি হ্যায়" শুনতে শুনতে আমি ওয়ান্ডারল্যান্ডের অ্যালিস বনে যাই! তবে কি না, কোণঠাসা বেড়াল ফাঁস করবেই। সুতরাং এবার আমি দৃঢ়ভাবে জানাই, "সুদীপ্ত দের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকুক বা না থাকুক, আমার এলাকাটি সাইবার ক্রাইমের ভবানী ভবন জুরিসডিকশনের আওতাভুক্ত। আমার মেয়েকে লাইফথ্রেট করা হয়েছে। আমি ডিভাইস দুটি নিয়ে এসেছি আপনারা দেখুন।" অগত্যা ওরা যন্ত্র দুটি অনিচ্ছায় নাড়েন চাড়েন। সময় যায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরটিকে অমানবিক ধূলিমলিন লাগে। কোন একজন বড়কর্তা এসে আমার দিকে না তাকিয়ে সমবেত যুবগোষ্ঠীকে জানিয়ে যান, "জিডি-র ভিত্তিতে কোন অভিযোগ একেবারেই গ্রাহ্য হবে না। "হা ক্লান্ত মগজে ব্যর্থ আমি অতঃপর ভীড় ট্রেনে চাপি। জনকোলাহল, হকার ডাক সব সবকিছু ফেসবুকীয় অলীক লাগে!
নিজের শহরে ফিরে এসে আবার থানা, আবার এফ আই আর-এর ব্যর্থতা, আবার হুমকির ভুলভুলাইয়ায় পথ হারাতে হারাতে হঠাৎ জনৈক প্রায় অচেনা ফেসবুক বন্ধুর অযাচিত পরামর্শে এবার আমি ভবানী ভবনে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে মেইল করি, যেটি 'কপি টু" করা থাকে ডি জি ক্রাইম অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, এডিজি সাইবার ক্রাইম অব ওয়েস্ট বেঙ্গল, আই জি সাইবারক্রাইম অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, কল্যাণী পুলিশ স্টেশন, হিউমান রাইটস কমিশন, সেক্সুয়াল ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন সহ আরও কয়েকটি পদ ও প্রতিষ্ঠানকে। এবং মেইলের হুবহু প্রত্যায়িত নকলটি যাবতীয় অশ্লীল মেসেজ ও মৃত্যু হুমকির প্রিন্টেড হার্ডকপি সহ ভবানী ভবনে স্পিড পোস্ট করি।
যতদূর জানি, আইন অনুযায়ী আমার এই যাবতীয় কার্যাবলী এফআইআর হিসাবেই দাখিল হয়েছে। সম্ভবত এর ভিত্তিতেই পুলিশ প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে। আমার কাছে কল্যাণী থানা থেকে দুজন অফিসার আসেন, পুঙ্খানুপুঙ্খ সমস্ত ঘটনা শোনেন। সাত আগস্ট ভবানী ভবন থেকে আমাকে ফোন করা হয় এবং সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া হয়।
পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে, সব অফিসারকেই এখন আমার অলীকবাবু মনে হচ্ছে। আমি সুনিশ্চিত ভাবেই জানি, প্রোফাইল ডিঅ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেলেও সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে চাইলে যে কোন অপরাধীকে খুঁজে বের করতে পারেন, বিধিমতো শাস্তি দিতে পারেন। কিন্তু আমরা, সাধারণ মানুষরা প্রশাসনের সেই সদিচ্ছা জাগাতে পারি কি? নাকি, এ কেবল বুনোহাঁস এর পিছনে দৌড়?
জানিনা, সফলতা কত কত কত অযুত নিযুত যোজন দূরে। তবে ফেসবুকের খোলা জানালা বন্ধ করব না আমি। ছাপোষা গিন্নির জীবনে ধর্ম নেই, নৈতিকতা আছে। আমৃত্যু ধর্ষণ হুমকি, যে কোনো মৃত্যু পরোয়ানার বিপরীতেই থাকবো। রুটি রুজির ধান্দায় দিনগত পাপক্ষয় তাগিদে আস্তিক্য-নাস্তিক্য বোধটি এনামেলের মতো খসে গেছে কবেই! রয়েছে শুধু যাপন চিত্র। কোন চরমপত্র মৃত্যু-হুমকি এই ''অকিঞ্চিৎকরের'" সেই পরম যাপনচিত্রটিকে বদলে দিতে পারবে না।