Advertisment

দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৮)

নাগরিক পঞ্জি, সরকার বা সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট যে-সংগঠন তৈরি করেছেন তাঁরা প্রাথমিক ভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন - ভোটার লিস্টের নামগুলির মধ্যে একটা D শ্রেণী আরোপ করে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
NULL

অলংকরণ- অরিত্র দে

(সাহিত্যিক তথা সমাজবিজ্ঞানী দেবেশ রায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলার জন্য কলম ধরেছেন এই নিয়ে দু মাস। সপ্তাহান্তে আমরা নিয়মিত প্রকাশ করছি দেশকালরাজনীতি নিয়ে তাঁর নিজস্ব মতামত। তাঁর স্বকীয়তা অটুট থাকছে, প্রতিবার।)

Advertisment

সুবে, রাজ্য, প্রদেশ, বিভাগ, জিলা, মহকুমা, এগুলো একটা কেন্দ্রীয় শাসন পরিচালনার জন্য় প্রয়োজনীয় ভাগ। থানা এই ভাগের মধ্যে পড়ে না। থানা দেয়া বা পাহারা দেয়ার কাজ সেনাবিভাগ থেকেই হত। থানাদারের একটা সীমানাও থাকত। এই প্রয়োজনীয় ‘ভাগ’গুলির দেশনিরপেক্ষ কোনো স্থায়ী আকার নেই। কিন্তু ঐতিহাসিক আকার আছে। সেই ঔতিহাসিক আকারের বিন্যাসের কিছু অপরিবর্তনীয়তাও কালক্রমে ঘটে যায়। সেটা মেনে নিতে হয় নাগরিক জীবনযাপনের দরকারে।

আসামে নাগরিকপঞ্জিকরণ পদ্ধতিতে এই প্রশ্নটির কোনো উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। আর, যে-উত্তর পাওয়া যাচ্ছে, তা খুবই সোজা ও সেটা কেউই স্বীকার করছেন না। সেই সহজ সত্যটি হচ্ছে আসামের প্রায় সব রাজনৈতিক পার্টিই চান যে অহোম জনগোষ্ঠী ও ভাষা, নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ হোক। আসামের জনবিন্যাস ও ভাষাব্যবহার কোনোদিনই তা ছিল না। কারণ, প্রদেশ হিশেবে আসাম যে-সব বিবেচনায় প্রথম গঠিত হয়েছিল, বারবার পুনর্গঠিত হচ্ছিল, বারবার তার সীমানার পুনর্বিন্যাস ঘটছিল - তার কোনো একটি স্তরেও অহোম-ভাষীরা ও জনগোষ্ঠী সেই সমগ্র ভূখণ্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা বা জনগোষ্ঠী ছিল না। এখানে আমি কোনো সংখ্যাতত্ত্বে বা সীমান্তঘটিত তথ্যের ভিতর যাচ্ছি না। সেই তত্ত্বগুলি ও তথ্যগুলি সকলের জানা ও যে-কেউ নতুন করে জানতেও পারেন মোবাইলের বোতাম টিপে। সেই তত্ত্ব ও তথ্য অপ্রয়োজনীয় হয়তো সুপ্রিম কোর্টের কাছে, যদিও সুপ্রিম কোর্টেরই নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে এই নাগরিকপঞ্জি তৈরি করা হয়ে থাকে। তবে এই তত্ত্ব ও তথ্যগুলি নিশ্চয়ই সুপ্রিম কোর্টে পরীক্ষিত হবে।

আরও পড়ুন, দেবেশ রায়ের নিরাজনীতি (পর্ব ৭)

নাগরিক পঞ্জি, সরকার বা সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট যে-সংগঠন তৈরি করেছেন তাঁরা প্রাথমিক ভাবে সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন - ভোটার লিস্টের নামগুলির মধ্যে একটা D শ্রেণী আরোপ করে। এই  D বলতে কী বোঝায় তার নানারকম প্রতিশব্দ কাগজে পড়েছি - ‘ডুবিয়াস’, ‘ডাউটফুল’ ইত্যাদি। অর্থ যাই হোক - এর আসল অর্থ আমরা প্রুফ রিডিঙে যে  d ব্যবহার করি - ডিলিট বা বাদ দেয়ার নিদর্শ হিসেবে, সেই ডি। এঁদের নামগুলি নাগরিকপঞ্জিতে ঢুকবে না।

ভোটার লিস্ট তৈরি করেন নির্বাচন কমিশন। সারা বছর ধরে প্রতিদিন এই কাজ চলে। ভোটার হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট আবেদন পত্র নির্দিষ্ট প্রত্যয়নসহ জমা নেয়া গতে থাকে সারা বছরই। শুধু কোনো ভোটের আগেউ নয়। কোন ভোটার আছেন ও কোন ভোটার নির্দিষ্ট কেন্দ্রে নেই - তাঁর ঠিকানা বদলে গেছে এই যাচাই সারা বছর ধরেই চলে। যদি কোনো ভোটার সম্পর্কে অন্য কোনো ভোটারের আপত্তি থাকে তবে সেই আপত্তি নির্দিষ্ট কারণসহ সারা বছরই গৃহীত হয়ে থাকে। ভোটার তালিকার খশড়া অন্তত তিনবার বেরয় - যাতে যাচাই, বাতিল ও নতুন নাম নেওয়ার প্রক্রিয়া সারা বছর ধরে চলতে পারে। চরম ভোটার-তালিকা প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টেরও কোনো ক্ষমতা থাকে না নতুন ভোটার নিতে নির্দেশ দেয়ার।

আমার নিজেরই এ অভিজ্ঞতা হয়েছে।

১৯৭৭-এর সাধারণ নির্বাচনের সময়ে আমি সপরিবার সল্ট লেকের বিই ব্লকে এক বাড়ির একতলায় ভাড়া থাকি। ভোটের দু-দিন আগে আমি জানতে পারি, আমার পরিবারের ছ-জনের একজনেরও নাম ভোটার লিস্টে নেই। বাড়িওয়ালার ঘরজামাই ছিলেন কট্টর কংগ্রেসি। তিনি আমার বন্ধুর মতই ছিলেন। আমার রাজনৈতিক মতও জানতেন। সম্ভবত তিনিই আমাদের পরিবারের সব ভোটারের নাম বাদ দিইয়েছিলেন।

সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারক ছিলেন আমাদের বাড়ির সপরিবার বন্ধু। হাই ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বিশেষ ক্ষমতা আছে যে তাঁরা যে-কোনো জায়গায়, যে-কোনো সময়ে কোর্ট বসাতে পারেন ও আদেশ দিতে পারেন, ফোনেও।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক সেই বন্ধু তখন কলকাতায়, ভোট দিতেই। আমি তাঁকে সমস্ত ঘটনা জানালাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে ফোন করলেন। তিনি নিরুপায়তা জানালে, আমার বন্ধু তখুনি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে ফোন করলেন। রেজিস্ট্রার বললেন - জেনে ফোন করছেন। একটু পরেই জানালেন - তিনি ভারতের ইলেকশন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন, কমিশনার বলেছেন - চরম তালিকা বেরবার পর সে-তালিকায় কোনো হেরফের করা যায় না।

আরও পড়ুন, এন আর সি: নো-ম্যানস-ল্যান্ডের দিকে পা বাড়িয়ে

ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক সংগঠন। সেই সাংবিধানিক সংগঠন কর্তৃক প্রকাশিত ভোটার তালিকায়, লক্ষ লক্ষ ভোটারকে D চিহ্নিত করে ভোটারদের মধ্যে শ্রেণীভাগ করে, পৃথক একটি তালিকা অন্য শিরোনামে, এক্ষেত্রে নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ - নিশ্চিতভাবে ফৌজদারি অপরাধ। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ঘটলেও ফৌজদারি অপরাধ, ফৌজদারি অপরাধই থাকে।

আসামের নাগরিকপঞ্জি সংবিধান লঙ্ঘন করেছে। তার সঙ্গে ভোটারদের D চিহ্নিত করে ফৌজদারি অপরাধ করেছে।

এই দুই অপরাধের ফলে এই পঞ্জির কোনোই আইনি গ্রাহ্যতা নেই।

supreme court nrc Nirajniti Debes Ray
Advertisment