Advertisment

মুখে গণতন্ত্র, মনে বৈষম্য - পৃথিবী সেই তিমিরেই

ভারত-বাংলাদেশে পুলিশি নির্যাতন, গুম, হত্যা, নিত্যদিন। আমরা কি এই নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলনে সমাজ-রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়েছি?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
lip service to democracy

বার্লিনের দেওয়াল ভেঙেছে পশ্চিমের মানুষ, পূর্ব জার্মানরা নয়। পশ্চিম জার্মান সরকার মওকা বুঝে তড়িঘড়ি কবজা করেছে বিপ্লব। ছবি সৌজন্য: উইকিপিডিয়া

২৫ মে ২০২০, পুলিশ হত্যা করল কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডকে। হত্যার দৃশ্য যদি ভিডিও না করা হতো, আমেরিকা সহ বিশ্বের মানুষ কি জানত? লাগাতার বিক্ষোভ, আন্দোলন হতো? বর্ণবিদ্বেষের ভয়ঙ্কর চিত্রচরিত্র নিয়ে কথা উঠত, সোচ্চারে ফেটে পড়ত? ঘটনা একদিনের নয়, যুগযুগান্তর প্রবাহিত। যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই অভ্যস্ত, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, এবং তথাকথিত 'সাম্যের' নামে।

Advertisment

বলা হচ্ছে, জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড দুনিয়ার চোখ খুলে দিয়েছে। তার মানে, এতকাল খোলে নি, প্রত্যেকেই অন্ধ, হঠাৎ চক্ষুষ্মান। অথবা, চোখে ঠুলি ছিল, আচমকা খুলে গেছে, দেখছে উপরে নিচে-সামনে পেছনে-ডাইনে বাঁয়ে স্তূপীকৃত ঘেন্নার জঞ্জাল। সরাবে কে? দায় কার? রাষ্ট্রের, নাকি সমবেত জনতার? বলা হয়, জনগণই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। ঠিক, জনতাই পারে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে। সবটা পারে কি, কর্পোরেটের জাঁতাকলে? অর্থনৈতিক চাবুকে, ডাণ্ডায়?

দেশে দেশে বিপ্লবের ঘটনা, ইতিহাস আমরা জানি, পড়েছি। তিন দশক আগে, যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী বার্লিন দেওয়াল ধ্বসের। পূর্ব জার্মানরা বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে, ওই ডামাডোলের ফায়দা কুড়িয়েছে পশ্চিম জার্মানি। দেওয়াল ভেঙেছে পশ্চিমের মানুষ, পূর্ব জার্মানরা নয়। পশ্চিম জার্মান সরকার মওকা বুঝে তড়িঘড়ি কবজা করেছে বিপ্লব। ফলাও করে প্রচারিত কৃতিত্ব পশ্চিম জার্মান সরকারের।

বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে আমেরিকা-ইউরোপের আন্দোলন, বিপ্লব একটু ঝিমিয়ে গেলেই দেখা যাবে, যে তিমিরে বসেছিল, সেই তিমিরেই আবার সেঁধিয়ে দিচ্ছে সরকার তথা রাষ্ট্রক্ষমতা। আপাতত চুপ বলে আগ্নেয়গিরি নিষ্ক্রিয়। ঘুমিয়ে থাকলেও মূলত সুপ্ত, অপেক্ষমান।

আরও পড়ুন: করোনা কালের কবিতা – দাউদ হায়দার 

বর্ণবৈষম্য-জাতপাত নিয়ে মাতব্বররা জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর, 'অবশ্যই কিছু করণীয়, করতেই হবে, নির্যাতিতের পাশে থাকতেই হবে' বলে মুখে ফেনা তুলছেন। খুব ভালো, বাহবা দিচ্ছি, কিন্তু আসল চেহারা কি দেখছি? দেখেও কিছু বলছি? বলছে কি মাতব্বর, মোড়লরা? না।

দুইবার ইজরায়েল গিয়েছি, হাইফা ও তেল-আভিভে। সাহিত্য সম্মেলনে নিমন্ত্রিত হয়ে। আয়োজকরা সরাসরি বলেছেন, "ফিলিস্তিন-ইজরায়েলের রাজনীতি নিয়ে কিছু বলবেন না।" হাইফায় একটি সেমিনারে বিষয় ছিল 'পোয়েট্রি অ্যান্ড পলিটিক্স'। তার মানে কবিতায় রাজনীতির কথা বলা যাবে, কাব্যকলায় রাজনীতি, সৌন্দর্য, ঝামেলা, বিচার ইত্যাদি, বাদ শুধু ফিলিস্তিনে ইজরায়েলের হত্যাকাণ্ড, জমি দখল, মানুষ উচ্ছেদ, ইতরতা, অমানবিকতা।

বিশ্বের মোড়লরাও ইজরায়েলি বর্বরতা নিয়ে রা কাড়তে নারাজ। কাড়লে সমূহ বিপদ। অথচ বৈষম্য, মানবিকতা বিষয়ে সোচ্চার, ঘিলু খামচাচ্ছে, চুল ছিঁড়ছে। মুখে মুখোশ দিব্যি 'মানবিক', কেউ কিছু বলছে না, বলার সাহস নেই। বললে থাপ্পড় মেরে বদন পাল্টে দেবে।

ইহুদিদের বিরুদ্ধে ইউরোপ-আমেরিকায় কুকথা, সমালোচনা করলে আখের ঝরঝরে। জার্মানির দুই-তিনজন রাজনৈতিক নেতা, দুইজন লেখক বলেছিলেন, ব্যস, কোথায় যাবে, হাড়গোড় চিবিয়ে ওয়াক থু করেছে। ইজরায়েলের সমালোচনা করা মানেই 'ইহুদির দুশ্মন'। ইজরায়েলের সাত খুন মাফ। জার্মানি প্রতি বছর ইজরায়েলকে ১০ বিলিয়নের বেশি ইউরো দিচ্ছে, যদিও গোপনে, লিখিত নয়, কিন্তু সবাই জানে, ওপেন সিক্রেট। ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়, বিশাল অঙ্কের অর্থ কেন? হিটলারের পাপে, ইহুদি নিধনের প্রায়শ্চিত্ত।

আরও পড়ুন: কখনো প্রলয় আনে মুক্তির স্বাদ, স্মরণে ‘ভোলা’

ইজরায়েল যা খুশি করবে, ফিলিস্তিনি মারবে, জায়গাজমি কেড়ে নেবে, কারোর বলার হিম্মত নেই। কোথায় বিশ্ব মোড়লদের মানবিকতা? বাংলাদেশ ছোট দেশ, হাজার হাজার রোহিঙ্গা ঠাঁই নিয়েছে, উদ্বাস্তু। অবর্ণনীয় দুর্দশা, জীবন বিপন্ন। বাংলাদেশ দিশেহারা, বিপর্যস্ত। বৈশ্বিক মোড়ল কুলের মায়াকান্না, দরদ, ল্যাটা চুকে গেল। পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্পষ্ট কথাই বলেছেন, "কুম্ভীরাশ্রু বাদ দিয়ে রোহিঙ্গাদের ঠাঁই দিন।" শুনবে না। শোনার কান নেই, দেখার চোখ নেই। মায়ানমারকে চটানোর পাটা নেই বুকে। না আমেরিকার, না ইউরোপীয় ইউনিয়নের, না চিন-দক্ষিণ কোরিয়া-ভারত-জাপান সহ আসিয়ান (ASEAN, বা এশিয়ার গোষ্ঠীভুক্ত জোট)-এর। মূলে ব্যবসা, বাণিজ্য, রাজনীতি।

ইয়েমেন নিয়ে কী হচ্ছে? কাতারে কাতারে মানুষ মরছে, মরুক। সৌদি আরবের নিষেধাজ্ঞা, সৌদি আকাশ/সীমানা লঙ্ঘন করা যাবে না। মেনে নিয়েছে হম্বিতম্বির মোড়লরা। লজেঞ্চুস না চুষে মুখে আঙুল ঢুকিয়ে আঙুল চুষছে, চুষবে। চোষাই তবে মানসিকতা?

জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের পর বর্ণবৈষম্যের নানা দিক প্রকাশিত, উদ্ঘাটিত। কলাম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছেন, এই ইতিহাস বহুলবর্ণিত, চর্চিত। মূলত তিনিই যে ক্রীতদাস (স্লেভ) রপ্তানিকারক (ইতিহাস কৌশলে চাপা দিয়েছে), ক্রমশ প্রকাশিত। বর্ণবৈষম্য-বিরোধী আন্দোলনে আমেরিকায় তিনটি শহর থেকে কলাম্বাসের মূর্তি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, একটি ভাঙচুর করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে সতেরো শতকের ক্রীতদাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টন-এর মূর্তি ভেঙে সমুদ্রে নিক্ষেপ। লন্ডনে উইনস্টন চার্চিলের মূর্তির গায়ে গ্রাফিতি আঁকার পর থেকে তাকে শক্ত কাঠ দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে, বসানো হয়েছে পুলিশ পাহারা। বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোল্ড-এর মূর্তির মাথা, মুখ, দুই হাত পা, ভেঙে তছনছ। ওঁরা প্রত্যেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস (ব্ল্যাক স্লেভ) আমদানি করে দেশ গড়েছেন, ব্ল্যাক নির্যাতন করেছেন, ব্ল্যাক মেরেছেন। হোয়াইটদের কাছে একদা পূজ্য, মনমানসিকতায় আজও। কিছু বলতে পারছে না আন্দোলনের জোয়ারে। ইতিহাস বাদ দেবে?

কতটা জোয়ার, তা টের পেয়েছেন 'গন উইথ দ্য উইন্ড' ছবির স্বত্বাধিকারী। মার্গারেট মিচেল-এর এই উপন্যাস লেখা হয় ১৯৩৬ সালে, ৩.৮৫ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ছবি তৈরি হয় ১৯৩৯ সালে। দশটি অস্কার পুরস্কারে সম্মানিত। ছবির পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত লিখছি না, দরকার নেই। করোনা কালে আমেরিকার একটি টিভি চ্যানেলে দেখানো শুরু হয় 'গন উইথ দ্য উইন্ড'। সর্বসাকুল্যে ২২০ মিনিটের ছবি, ধারাবাহিক চলবে। ছবিতে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নিয়ে বহু ঘটনা, দৃশ্য। টিবি কর্তৃপক্ষ প্রদর্শনী বন্ধ করেন। জনরোষ? জনরোষের ভয়? ছবিটি ধ্বংস করা হয়েছে? না, আর্কাইভে সংরক্ষিত।

বাংলাদেশ-ভারতের কথায় ফিরি। বর্ণবৈষম্য-ধর্ম-জাতপাত নিয়ে কি বিক্ষোভ, আন্দোলন হয়েছে, জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার পর? হয়নি। কী করে হবে? ভারতে এত জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, কেউ সঙ্ঘবদ্ধ নয়, আলাদা। আন্দোলনে সবাই একত্র, সামিল হবে? না। জাতপাত-ধর্ম নিয়ে ব্যস্ত, মশগুল। আন্দোলন দানা বাঁধতে পারে না, পারবে না। মিছিল হয় নি, হবেও না। বাংলাদেশেও না। বাংলাদেশে কথায় কথায় মানববন্ধন হয়, ধর্মের সমালোচনা করলে তো কথাই নেই, মারদাঙ্গা। বর্ণবৈষম্য, জাতপাত নিয়ে সুশীল সমাজ, তথাকথিত আন্দোলনকারীরাও চুপ, মৌনী, নিস্তেজ।

ধর্ম-জাতপাত কতটা উগ্র ভারতে, একটি উদাহরণ। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় নি। পরিচয় না দিয়ে (নাম জিজ্ঞেস করে নি) দুইবার গিয়েছিলুম। জানতে পারলে? খুব প্রচারিত মিডিয়ায়, কেরালার মুখ্যমন্ত্রীর কন্যা মুসলমান বিয়ে করেছেন। ঘটা করে অনুষ্ঠান। মনে রাখতে হয়, কেরালা কম্যুনিস্ট রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী কম্যুনিস্ট। কন্যা-জামাতা মায়ায় জড়িয়ে বিবাহিত। লোক দেখানো এবং রাজনীতির কারণেই (বিশেষত বিজেপিকে দেখানোর জন্যে), নিজেকে ধর্ম-জাতপাতের ঊর্ধ্বে প্রমাণের চেষ্টা। এই চেষ্টার মধ্যেও লোকদেখানো। ফ্লয়েডের হত্যায় বিশ্ব জুড়ে ধিক্কার, আন্দোলন। বর্ণবৈষম্য-জাতপাত নিয়ে প্রশ্ন। সুযোগ ব্যবহার করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি নিশ্চয় ঘটকালি করে হিন্দু-মুসলমানের বিয়ে দেন নি। ভারতে-বাংলাদেশে হয়? না, হয় না।

বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, আন্দোলন, কিন্তু লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে কোন দেশ কতটা সোচ্চার? নারী এখনও পণ্য। দ্বিতীয় শ্রেণীর। দেশসমাজে অবহেলিত। ভারত-বাংলাদেশে পুলিশি নির্যাতন, গুম, হত্যা, নিত্যদিন। আমরা কি এই নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলনে সমাজ-রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়েছি? ভারতে মুসলিম নামধারী কেউ কি সহজে বাড়ি ভাড়া পান? প্রায় একই অবস্থা বাংলাদেশে। এর পরেও গণতন্ত্র-মানবতার বুলি? বলিহারি!

আমরা কোন তিমিরে? যে তিমিরে ছিলাম, আছি সেই তিমিরেই। আলোর কণা কবে দেখব, অজানা। আগুন প্রজ্বলন, বিপ্লব সর্বাগ্রে। মার্ক্স, লেনিন বেঁচে নেই, আজ বড় বেশি প্রয়োজন। কথায় চিঁড়ে ভেজে না।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment