Advertisment

দিল্লিতে অধীর কি শুধুই বাংলার 'বাহুবলি'?

অধীর বহরমপুর থেকে পরপর পাঁচবার জিতেছেন। এবারের লোকসভায় কংগ্রেসে পরপর পাঁচবারের আইনসভার সদস্য এমন ব্যক্তিত্ব কজন আছেন, সেটাও গবেষণার বিষয়।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
adhir chaudhuri rahul gandhi

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

ঢাকা থেকে এক পাঠকের চিঠি পেলাম। তিনি লিখেছেন, ভারতের সংসদে বিরোধী কংগ্রেসের সংসদীয় দলনেতা হলেন এক বাঙালি, অধীর রঞ্জন চৌধুরি। পাঠক অধীরবাবু সম্পর্কে জানতে চান। তাঁর প্রশ্ন, অধীরবাবুর আগে কি কোনো বাঙালি নেতা লোকসভায় কংগ্রেস নেতা হয়েছেন?

Advertisment

ঢাকার কৌতূহলী পাঠকের প্রশ্ন শুনে ভালো লাগল, কিন্তু নিজেই মনে করতে পারছি না। মনে করার চেষ্টা করলাম। মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন প্রণব মুখোপাধ্যায় লোকসভার কংগ্রেস নেতা হন। প্রথমত, সেটি ছিল শাসক দলের নেতৃপদ। দ্বিতীয়ত, মাথার উপর কংগ্রেস দলের সভানেত্রী ছিলেন সোনিয়া গাঁন্ধী। সত্যি কথা বলতে কী, কংগ্রেসের প্রয়াত নেতা অতুল্য ঘোষের পর সেভাবে সর্বভারতীয় বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃত্বই আমরা খুব কম দেখেছি। কংগ্রেসে প্রয়াত অশোক সেন ছিলেন, হীরেন মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, জ্যোতির্ময় বসু এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কমিউনিস্ট নেতা, অথচ সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্ব।

১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচনে কংগ্রেস ছাড়া অন্য কোনো বিরোধী দলই ছিল না। কংগ্রেস ছাড়া অন্য যে দলটি ছিল, তার নাম ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। ১৬ টি আসন পেয়েছিল কমিউনিস্টরা। ৮৪৯ টি আসনের মধ্যে মাত্র ১৬ টি আসন, তাই কোনো বিরোধী নেতা ছিলেন না। তবে কার্যত এ কে গোপালনই ছিলেন প্রধান বিরোধী নেতা।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলেও বিজেপির একক দাপুটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর কংগ্রেসের আসন সংখ্যা এমন হলো যে সংবিধান অনুসারে কাউকেই বিরোধী দলনেতার মর্যাদা দেওয়া যায় না। কারণ ভারতীয় সংবিধান অনুসারে বিরোধী দলনেতার স্বীকৃতি তখনই দেওয়া হবে যখন লোকসভার মোট আসন সংখ্যার কমপক্ষে এক দশমাংশ আসন বিরোধী দল পাবে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও তো এমনটাই হলো। এবারও লোকসভায় রাহুল গান্ধী বিরোধী দলনেতা হতে পারলেন না। অবশ্য গতবারের তুলনায় এবার কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছে বটে। তবু লোকসভায় প্রথম সারিতে রাহুলের স্থান হয়নি। সোনিয়া গান্ধী বসছেন, সঙ্গে রয়েছেন কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরি।

কাজেই প্রণববাবুর পর অধীর চৌধুরি। আর কোনও বাঙালিই এই পদে আসীন হন নি। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও প্রণববাবুর পর বাংলার কংগ্রেস থেকে প্রথম কোনও নেতা এহেন রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সম্মান পেলেন। অধীর বহরমপুর থেকে পরপর পাঁচবার জিতেছেন। এবারের লোকসভায় কংগ্রেসে পরপর পাঁচবারের আইনসভার সদস্য এমন ব্যক্তিত্ব কজন আছেন, সেটাও গবেষণার বিষয়। তাছাড়া তুলনামূলক ভাবে অধীর বয়সে নবীন, ৬১ বছর দিল্লির রাজনীতিতে নবীনই।

আরও পড়ুন: মোদী একজন সেলসম্যান, সংসদে ফের সরব অধীর

অধীর শারীরিকভাবেও যথেষ্ট ফিট। তরতাজা মানুষ, বিচক্ষণও বটে। নিন্দুকেরা তো কিছু বলবেই। কুছ তো লোগ কহেঙ্গে। কোনও এক সাংবাদিক বললেন, অধীর খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন। ভোটের সময় তিনি নিজের জোরে জিতেছেন। হাইকমান্ডের দয়ায় নয়। বস্তুত, রাজ্য কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে অধীরকে সরিয়ে সোমেন মিত্রকে বসানোর সময় থেকেই তাঁর ক্ষোভ তীব্র। দিল্লির কোনও এক সাংবাদিক বললেন, "অধীরদাকে এটা না করা হলে অধীরদা বিজেপিতে চলে যেতেন।" পশ্চিমবঙ্গে মমতার বিরুদ্ধে অধীরদাকে ছায়া মুখ্যমন্ত্রী করতে প্রস্তুত বিজেপি। সেই নবীন সাংবাদিককে বললাম, "এই গসিপ মানে গালগপ্পোটি আমি গত দু'বছর ধরে শুনে আসছি। যুক্তি দিয়ে শুধু একটা কথা বলুন, যে জেলা অধীর চৌধুরির সব চেয়ে বড় শক্তি, সেই মুর্শিদাবাদে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে বেশি মুসলমান জনসংখ্যা, তাঁর কেন্দ্র বহরমপুরে অপেক্ষাকৃত কম হলেও। তা সেই জেলা থেকে নির্বাচিত যোগ দেবেন বিজেপিতে?"

আমি নিজে সাংবাদিক হিসেবে এবং ব্যক্তিগতভাবে ও অধীরবাবুকে যে খুব বেশি জানি তা কখনই দাবি করব না। অধীর চৌধুরি কংগ্রেসে যোগ দেন ১৯৯১ সালে। রাজীব গান্ধীর সময়। আর আমি কলকাতা ছেড়ে দিল্লি চলে আসি ১৯৮৭ সালে। অধীর চিরকাল জেলা রাজনীতিই করে এসেছেন। দিল্লি তো দূর অস্ত, রাজ্য রাজনীতিতেও সেভাবে সক্রিয় ছিলেন না। তাঁর সম্পর্কে সংবাদপত্রে লেখা হত, তিনি হলেন বহরমপুরের রবিন হুড।

দিল্লি থেকে তখন দেখতাম, অধীরবাবু ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির, কিন্তু সোমেন মিত্রর সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল চিরকালই খারাপ। অধীরকে রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি করার আগেও হাইকমান্ড যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ছিলেন। মনে আছে, বারবার প্রণববাবুকে কংগ্রেস নেতৃত্ব জিজ্ঞাসা করতেন, অধীর তো জেলার শক্তিশালী নেতা, তাঁকে রাজ্য সভাপতি করা কি উচিত হবে? যা হোক, শেষ পর্যন্ত প্রণববাবুর সমর্থনেই অধীর রাজ্য সভাপতি হন।

আরও পড়ুন: বহরমপুরের রবিনহুড থেকে দিল্লির দলনেতা: অধীর চৌধুরীর বিজয়পথ

অধীরবাবু লোকসভার সদস্য হয়ে আসার পর থেকে আমি তাঁকে দেখেছি কাছ থেকে। প্রথমত, অধীরবাবু সম্পর্কে ধারণা ছিল যে তিনি হলেন কার্যত 'বাহুবলি' সাংসদ। কিন্তু দেখলাম সংসদে তিনি প্রশ্ন করছেন। বক্তৃতা দিচ্ছেন। যাকে বলে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী সাংসদ। নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে অধীর জেতেন ১৯৯১ সালে। জেতেন ১৯৯৬ সালেও। তারপর ১৯৯৯ সালে তিনি স্থানীয় শক্তিশালী আর এস পি নেতাকে হারিয়ে লোকসভায় আসেন। ঐতিহাসিক ভাবে মুর্শিদাবাদে, বিশেষত বহরমপুরে, আর এস পির সাংগঠনিক শক্তি ছিল যথেষ্ট। অধীরের মতো ডাকাবুকো ব্যক্তি সেই ঘাঁটি ভাঙেন। বহরমপুর পুরসভা দখল করা এবং দীর্ঘদিন তা ধরে রাখা, সেও ছিল অধীরের কৃতিত্ব।

এত কথা বললাম এজন্য যে অধীরবাবু যেভাবেই হোক জেলায় নিজের একটা গণভিত্তি অর্জন করেন। আর দিল্লি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয় সেই সব নেতাদের, যাঁদের এলাকায় নিজস্ব প্রতিপত্তি আছে। সেটা হলো এই বঙ্গসন্তানের রাজনীতির পটভূমি।

এরপর দিল্লি এসেও কিন্তু তিনি দিল্লিতে ধীরে ধীৱে নিজস্ব জমি তৈরী করছেন। দিল্লির লাডডু সম্পর্কে প্রচলিত জোক, যে খাবে সেও পস্তাবে, যে খাবে না সেও পস্তাবে। অধীর কিন্তু সে লাডডুটা সামলেছেন। প্রণববাবুর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মনমোহন সিংহের সময় রেলমন্ত্রী হলেন। রেলমন্ত্রী হিসেবেও তিনি যথেষ্ট সক্রিয় রাজ্যমন্ত্রী ছিলেন। এমনিতে দিল্লিতে প্রচলিত ধারণা, রাজ্যমন্ত্রীদের কোনো কাজ থাকে না। অধীর কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যেও জনপ্রিয় হন। দিল্লির মিডিয়াও তাঁর সম্পর্কে বিরূপ নন।

আরও পড়ুন: একা কুম্ভ হয়ে বহরমপুরে গড় রক্ষা করলেন অধীর

ক্রমশ তিনি রাহুল গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। রাহুল আমাকে বলেছিলেন, "রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ভোটের আগে অধীরকে সরাতে চাই না কারণ ও স্ট্রিট ফাইটার। নেতার স্তরে লড়াকু ব্যক্তি পাওয়া কঠিন।" এটা ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে।

তবে আজ এমন একটা সময়ে অধীর চৌধুরি এ দায়িত্ব পেলেন, যখন দেশের অবস্থা খুবই শোচনীয়। অধীরের নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের এখন ঠিক কী পরিস্থিতি, তা তো কারোরই অজানা নয়। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। আবার গোটা দেশে নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে এখনও যে অনুকূল হাওয়া, যেভাবে বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ, সেখানে পদত্যাগী রাহুল গান্ধী যে পরিস্থিতিতে অধীরবাবুকে দায়িত্ব দিলেন তাও অধীরের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এখনও পর্যন্ত যা বাস্তব, তাতে রাহুল গান্ধী আর দায়িত্ব নিতেই রাজী নন। দলেরই কোন সভাপতি নেই।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দায়িত্ব নেবেন কিনা, সেটাও রহস্য। এমতাবস্থায় অধীরবাবুর সামনে চ্যালেঞ্জ একটাই, জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। যেভাবে দিল্লি এসে তিনি একদা করেছিলেন। ধাপে ধাপে মন্ত্রী পর্যন্ত হন। কিন্তু এটা অধীরবাবুর জন্যও চ্যালেঞ্জের দ্বিতীয় ইনিংস। দিল্লিতে বাঙালি নেতা আজ বড় কম, অধীরবাবু সফল হবেন কিনা, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন।

Advertisment