Advertisment

কীভাবে আমার ওপর গোয়েন্দাগিরি করে কিছু "সরকার-সমর্থিত কুশীলব"

আমার ওপর নজর রাখছে কোনও অজ্ঞাত শক্তি, এবং আমার সমস্ত বিশদ তথ্য, ব্যক্তিগত কথোপকথন, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদির ওপর রয়েছে গুপ্তচরের দৃষ্টি, এই উপলব্ধি গভীরভাবে নাড়া দেয় আমাকে।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
pegasus whatsapp hacking

অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে আমরা প্রথম জানতে পারি, ১২১ জন সমাজকর্মী, সাংবাদিক, উকিল এবং লেখকের ওপর ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার পেগাসাসের সাইবার হামলার খবর। এই সময়েই আমি বুঝতে পারি, একই ধরনের সাইবার হামলার শিকার হয়েছি আমিও, ই-মেইলের মাধ্যমে।

Advertisment

আমার কাছে প্রথম ই-মেইল আসে ১৩ মে, ২০১৯, প্রেরক আমার অপরিচিত। মেইলের সঙ্গে একটি অ্যাটাচমেন্ট, যা দেখে মনে হয় সেটি দিল্লির কোনও আদালতের নির্দেশ, যাতে আমার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ (বি) ধারায় অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ করা হয়েছে। যেহেতু এ ধরনের কোনও মামলার খবর আমার কাছে ছিল না, স্বভাবতই উদ্বিগ্নচিত্তে অ্যাটাচমেন্টটি খুলে পড়তে যাই। কিন্তু ফাইলে কিচ্ছু নেই, একদম ফাঁকা।

সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারি, এটি সম্ভবত আমার কম্পিউটার 'হ্যাক' করার প্রচেষ্টা। দিল্লিতে আমার সহযোগী কর্মী এবং উকিলদের কাছে খোঁজ নিই, জানতে চাই মেইলের প্রেরককে কেউ চেনেন কিনা, কিন্তু কেউই চিনতে পারেন না। ঘটনাচক্রে যে ল্যাপটপে ফাইলটি ডাউনলোড করি, সেটি কয়েকমাসের মধ্যে ক্র্যাশ করে, এবং আমার মাথা থেকেও ঘটনাটা বেরিয়ে যায়।

আরও পড়ুন: হোয়াটসঅ্যাপ নজরদারির তদন্ত করুক সংসদীয় কমিটি, দাবি পেগাসাস আক্রান্তদের

পরের দৃশ্যে আসি, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯। ফের একটি ই-মেইল, একইরকমের অ্যাটাচমেন্ট সমেত, তবে এবার বিষয়বস্তু অন্য। এবার জগদলপুরের এক আদালতের সমন, কোনও এক দাঙ্গার মামলায়। তথাকথিত প্রেরক, জগদলপুরের বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর। এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে এটি আরও একবার হ্যাকিংয়ের প্রয়াস, অতএব জগদলপুরে আমার সহযোগীদের কাছে খোঁজখবর করলাম, জানতে পারলাম অনেকেই একই ধরনের মেইল পেয়েছেন। স্পষ্টতই এটি সরকারি নীতির সমালোচনা বা বিরোধিতা করছেন, অথবা সবরকম বিরোধী কণ্ঠ দমিয়ে রাখার বিরুদ্ধে লড়ছেন, এমন কর্মী, উকিল, বা সাংবাদিকের ওপর নজরদারি করার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অঙ্গ।

এর কিছুদিনের মধ্যেই, অর্থাৎ ৫ নভেম্বর, আমার মেইল পরিষেবা প্রদানকারী ইয়াহু (Yahoo) আমাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-মেইল মারফৎ স্পষ্টভাবে জানায়, কিছু "সরকার-সমর্থিত কুশীলব" বা "government-backed actors"-এর নিশানায় রয়েছে আমার ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, যার অর্থ হলো, আমার অ্যাকাউন্টে রক্ষিত তথ্য চলে যেতে পারে তাদের হাতে। এই হামলা "উন্নত পর্যায়ের হামলাকারী" শ্রেণীভুক্ত, যার অর্থ হলো এটি নিত্যনৈমিত্তিক 'ফিশিং' (phishing) হামলা নয়, বরং আমার ই-মেইল এবং কম্পিউটারে প্রবেশ করার উদ্দেশ্যে প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, সুপরিকল্পিত একটি প্রচেষ্টা।

ইতিমধ্যে আমি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং পেগাসাস হামলার তদন্তে নিযুক্ত ক্যানাডিয়ান মিডিয়া প্রযুক্তি সংস্থা সিটিজেনস ল্যাব-এর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাদের উপদেশ মেনে আমার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট পরীক্ষা করে দেখি ২০১৯-এর মে মাসে আমার কাছে অপরিচিত আন্তর্জাতিক নম্বর থেকে দুটি হোয়াটসঅ্যাপ কল আসে, প্রথম ই-মেইলটি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। এর থেকে পরিষ্কার, আমার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্টও হ্যাক করার চেষ্টা হয়। এবং এও পরিষ্কার, অত্যন্ত উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমার হোয়াটসঅ্যাপ এবং ই-মেইল অ্যাকাউন্ট দুইই বিপর্যস্ত করার একটি সমবেত প্রচেষ্টা করা হয়।

আরও পড়ুন: ‘আমার ফোন ট্যাপ করা হচ্ছে’, পেগাসাস হানার মধ্যেই বিস্ফোরক মমতা

ইজরায়েলি সরকারের মদতপুষ্ট স্পাইওয়্যার সংস্থা এনএসও (NSO) গ্রুপের বিরুদ্ধে হোয়াটসঅ্যাপের করা মামলা, এবং তৎপরবর্তী প্রকাশিত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, এই সাইবার হামলায় ব্যবহৃত স্পাইওয়্যার যে কোনও ডিভাইসের সম্পূর্ণ দখল নিয়ে নিতে পারে। তার অর্থ, সেই ডিভাইসের লোকেশন ডেটা, ই-মেইল, পাসওয়ার্ড, কথোপকথন, এমনকি ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন চালু করার ক্ষমতাও হস্তগত হয়ে যাবে।

আমার ওপর নজর রাখছে কোনও অজ্ঞাত শক্তি, এবং আমার সমস্ত বিশদ তথ্য, ব্যক্তিগত কথোপকথন, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদির ওপর রয়েছে গুপ্তচরের দৃষ্টি, এই উপলব্ধি গভীরভাবে নাড়া দেয় আমাকে। শুধু তাই নয়, আমার ল্যাপটপে রয়েছে আমার গ্রুপের গবেষণার ফলে উদ্ভূত স্পর্শকাতর এবং গোপনীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য, যা কোনও অবৈধ ব্যবহারকারীর হাতে পড়তে পারে।

এতে যে গোপনীয়তার মৌলিক অধিকার এবং সুরক্ষা ব্যাহত হয়েছে, তা শুধু আমার নয়, আমার বৃহত্তর পারিবারিক বৃত্ত, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, পেশেন্ট, এবং কর্মসূত্রে পরিচিত অন্যান্যদেরও। এতেই শেষ নয়, কারণ এই ধরনের সুদূরপ্রসারী নজরদারির অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমগ্র সমাজের ওপর, এবং গণতন্ত্রে প্রয়োজনীয় সবরকমের অধিকার এবং ভাবনাচিন্তার খোলাখুলি আদানপ্রদানের পরিপন্থী।

আরও পড়ুন: পেগাসাস হানা: সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রকে ১২১ জন আক্রান্তের কথা বলেছিল হোয়াটসঅ্যাপ

ইজরায়েলের সংস্থা NSO যদিও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছে যে তারা শুধুমাত্র সরকারি সংস্থার কাছেই তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করে, এবং ইয়াহু আমাকে জানিয়েছে যে আমার অ্যাকাউন্টকে নিশানা করেছিল কিছু "সরকার-সমর্থিত কুশীলব", সরকারকে এই বিষয়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে বারংবার প্রশ্ন করা সত্ত্বেও কোনও উত্তর মেলেনি, এমনকি সংসদেও না। এখন জানা যাচ্ছে যে প্রায় ৫০০ জন জিমেইল ব্যবহারকারীকে "সরকার-সমর্থিত কুশীলব" সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছে গুগলও।

তাদের পরিষেবার জন্য যে বিপুল অর্থ দাবি করে এইসব স্পাইওয়্যার সংস্থা, তাতে কোনও দেশের সরকার ছাড়া আর কারোর পক্ষে এই পরিষেবা কেনা অসম্ভব। ভাবতে খুব খারাপ লাগে যে দেশের করদাতাদের টাকায় তাঁদেরই ওপর গোয়েন্দাগিরি চালাচ্ছে সরকার, তাঁদের অজ্ঞাতে, সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে। এই সাইবার হামলায় অভিযুক্ত একজনেরও কোনোরকম অপরাধের ইতিহাস নেই, এবং প্রত্যেকেই সুপরিচিত কর্মী, উকিল, সাংবাদিক, বা শিক্ষাকর্মী, যাঁদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র এই যে তাঁরা সরকারের জনবিরোধী নীতি এবং পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে ভয় পান না।

রাজ্যসভায় এ বিষয়ে এক সাম্প্রতিক বিতর্ক চলাকালীন তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বিরোধী সাংসদদের নির্দিষ্ট প্রশ্নের সরাসরি উত্তর এড়িয়ে গিয়ে স্রেফ বলেন যে কোনোরকম "অনধিকার হস্তক্ষেপ" কখনও ঘটে নি। তবে একইসঙ্গে তিনি যোগ করেন যে, যাঁদের নাম "প্রকাশ্যে এসেছে...তাঁরা নরেন্দ্র মোদীর প্রতি দীর্ঘস্থায়ী বিদ্বেষ পোষণ করেন", এটি "বড় বেশি সমাপতন"।

তাহলে এই হলো সরকারের বক্তব্য। নরেন্দ্র মোদীর প্রকাশ্য বিরোধিতা করলে যে কোনও কারোর ওপর নজরদারি চালানো যেতে পারে, তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হতে পারে, গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হতে পারে, এবং শেষমেশ ভুয়ো অভিযোগে জেলে ভরা হতে পারে, যার সবটাই আমাদের চারিদিকে নির্মীয়মাণ 'নিউ ইন্ডিয়া'য় বিদ্যমান।

(লেখক ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের সঙ্গে যুক্ত, এবং নোনাডাঙা সহ বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনেও জড়িত, মতামত ব্যক্তিগত)
Whatsapp
Advertisment