Advertisment

মধ্য এশিয়ায় চিনের সীমান্ত নীতি থেকে শিক্ষা নিতে পারে ভারত

নব্বুইয়ের দশকে রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার তিনটি দেশের সঙ্গে শেষবার সীমান্ত সমস্যা মেটানো নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে চিন, যার পর থেকেই পরিলক্ষিত হয়েছে একটি প্যাটার্ন

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
ব্রিটেনকে হুঁশিয়ারি চিনের।। করোনা নিয়ে ফের সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হবেন ট্রাম্প

চিনের পতাকা।

লাদাখে চিনা অনুপ্রবেশের লক্ষ্য হলো ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি করে চিনের হাতে সমর্পণ করা হয় আকসাই-চিন। চিনের সীমান্ত নীতি সমূহকে নানা কথার মোড়কে সাজান বিশেষজ্ঞরা, কিন্তু যা অগ্রাহ্য করা যায় না তা হলো, প্রতিটি নীতিই অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা সংক্রান্ত উৎকণ্ঠার প্রতিফলন। মূল ব্যাপারটা হলো, সীমান্তে সম্ভাব্য বিপদের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।

Advertisment

নব্বুইয়ের দশকে রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার তিনটি দেশের সঙ্গে শেষবার সীমান্ত সমস্যা মেটানো নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে চিন, যার পর থেকেই পরিলক্ষিত হয়েছে একটি প্যাটার্ন। সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর চিনের স্পর্শকাতর শিনজিয়াং অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে বহিরাগত শক্তির খেলাঘর, এই আশঙ্কায় কাজ়াখস্তান, কিরগিজ়স্তান, এবং তাজিকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা মেটাতে তৎপর হয় পড়ে বেইজিং।

এই দেশগুলির সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত আলোচনায় চিনারা যে পন্থা অবলম্বন করে, তাকে বলা যায় "উৎসাহ প্রদান এবং বলপ্রয়োগের" মিশ্রণ। কাজ়াখস্তানের কাছে যতটা দাবি ছিল, তার এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড পেয়েই সন্তোষ প্রকাশ করে চিন। অথচ কাজ়াখরা স্বীকার করতে বাধ্য হন যে তাঁরা লাভবানই হয়েছেন। জমি হারানো ছাড়াও কাজ়াখস্তান বাধ্য হয় উইঘুর বিচ্ছিন্নতাবাদের নিন্দা করতে, এবং চিন-বিরোধী কার্যকলাপের ওপর লাগাম টানতে।

আরও পড়ুন: চিনের নবতম রূপ, ঘরের বাইরে নজর

একইভাবে ১ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় কিরগিজ়স্তান, বিনিময়ে প্রাপ্ত হয় চিনা সহায়তার অনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি। ওদিকে ২০১০ সালে ১,১০০ বর্গ মাইল জমি ছেড়ে দেয় তাজিকিস্তান। এখানে চিনের দাবি ছিল ২৮ হাজার বর্গ কিমি, কিন্তু তার স্রেফ ৩.৫ শতাংশ জমি পেয়েই দাবি ছেড়ে দেয় তারা। ফের একবার ভূখণ্ড সমর্পণ করে দিয়েও তাঁরাই 'জয়ী', এই ধারণা দেওয়া হয় তাজিকদের।

শেষমেশ যা দাঁড়াল, তাতে চিন কিছুটা জমিও পেয়ে গেল, উইঘুর ইস্যু ধামাচাপা পড়ে গেল, এবং ইউরেশিয়ার বাজারের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন করল শিনজিয়াং, যার ফলে অর্থনৈতিক লাভও হলো চিনের। এর ফলে আবার জন্ম নিল স্বার্থ রক্ষাকারী সাংহাই কোওপারেশন অর্গানাইজ়েশন (Shanghai Cooperation Organisation বা SCO), যেটিকে তুলে ধরা হলো বহুপাক্ষিক সহযোগিতার দৃষ্টান্তমূলক পদ্ধতি হিসেবে, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ইউরেশিয়াতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোনও এশীয় জোটের কার্যক্ষমতা ভোঁতা করে দেওয়া।

তবে চিনের ভূখণ্ড অধিগ্রহণের ক্ষিদে এখানেই থেমে থাকে নি। রাশিয়ার সুদূর পূর্বে কিছু দুর্বল প্রদেশে প্রভাব খাটিয়ে চিনা কৃষকদের কৃষিজমি এবং বনভূমি ভাড়া দিতে রাজি করানো হচ্ছে আজও। চিনের নব নব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে বদলে দেওয়া হচ্ছে সীমানা এবং নদীর গতিপথ।

ওদিকে চিনের নেতৃত্বে SCO-র অন্তর্ভুক্ত হতে মরিয়া ছিল ভারত, সম্ভবত পুরো খেলাটা না বুঝেই। শি জিনপিং এর সঙ্গে ২০১৩ সালে যোগ করেন 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (Belt and Road Initiative)। এখন যে ধারণা মান্যতা পাচ্ছে, তা হলো এই যে চিনের কাছে তড়িঘড়ি আত্মসমর্পণ করাটা ভুল হয়েছিল। তাদের নীতি-প্রসূত কার্যপদ্ধতির ফলে এশিয়া জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তেজনা এবং ক্ষোভ।

আরও পড়ুন: ২০২০ সালে কেন প্রাসঙ্গিক ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা

চিনের অতীত সীমান্ত নীতি থেকে কিছু উদাহরণ, এমনকি সামগ্রিক কৌশল সম্পর্কেই ধারণা, সংগ্রহ করা উচিত। বিশেষ প্রতিনিধি (Special Representative বা SR) স্তরের আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত সমস্যা নিষ্পত্তির স্বার্থে ২০০৫ সালে নতুন একগুচ্ছ নির্দেশিকায় ভারত ও চিন স্বাক্ষর করার পর থেকেই বিশেষ করে তাওয়াংয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ছাড়ের সন্ধানে রয়েছে চিন। ভারত সম্ভবত চাইছে বর্তমান সীমান্তের শ্রেণীবিন্যাসে নামমাত্র অদলবদল করে মামলা মিটিয়ে দিতে। ভারতের পক্ষে তাওয়াং ছেড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে। এরই প্রতিফলন দেখা যায় নির্দেশিকা প্রস্তুত করার ব্যাপারে। তবে দুই দেশই আশা করেছিল, এই পদ্ধতির দ্বারা পাকাপাকি ভাবে নিষ্পত্তি হবে সমস্যার।

২০১৩ সালের মার্চ মাসে ফের একবার নিষ্পত্তির ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করে চিন। মনে রাখা দরকার, সে বছরের এপ্রিল মাসে দেপসাংয়ে পিপলস লিবারেশন আর্মির ১৯ কিমি-র অনুপ্রবেশের উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে "তৎপর" হয়ে সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি করতে "দ্বিগুণ" প্রচেষ্টা করতে চাপ দেওয়া। দেপসাং-পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে বোঝা যায়, উভয় তরফের আধিকারিকরাই কিছু শিক্ষা নিয়েছিলেন। দেপসাংকে "বিচ্ছিন্ন" ঘটনা আখ্যা দেন তাঁরা, তবে দেখার বিষয় হলো, কীভাবে সেটিকে বৃহত্তর ইস্যু বানিয়ে সম্পর্কের অবনতি না ঘটিয়ে সমস্যার সমাধান করা হয়। উল্লেখযোগ্য ভাবে, সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয় চিনের দৃষ্টিকোণ থেকে।

নির্দেশিকা গঠিত হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত বিশেষ প্রতিনিধি স্তরে ২২ রাউন্ড আলোচনা হয়েছে। তা সত্ত্বেও কোনোরকম খসড়া চুক্তিরও দেখা নেই। ইতিমধ্যে ভারত এবং তৎসংলগ্ন নানা অঞ্চলে নিজেদের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে আরও সন্দেহের উদ্রেক করেছে চিন। প্রতিদান স্বরূপ প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর নিজেদের পরিকাঠামো মজবুত করতে থেকেছে ভারত।

লাদাখে চিনের সাম্প্রতিক হানা তাদের ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ অনিশ্চয়তা, এবং লাদাখ-সংলগ্ন শিনজিয়াং ও তিব্বতের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ভারতের ভূমিকার থেকে আলাদা করা যাবে না। ভারত তিব্বতের প্রসঙ্গ তুলবে, এমনটা হয়তো মনে করে না বেইজিং, তবে আমেরিকা-জাপান-ভারতের ত্র্যহস্পর্শ যে তাদের ঘিরে ফেলতে পারে, সেই সন্দেহ অবশ্যই করে। সুতরাং এই আগ্রাসী মনোভাব প্রদর্শনের উদ্দেশ্য হতে পারে বকলমে ভারত এবং চিনের কেন্দ্রীয় স্বার্থে আঘাতকারী অন্যান্য শক্তিকে প্রতিহত করা। অবশ্য ইরান, উত্তর কোরিয়া, এবং পাকিস্তানকে ব্যবহার করে উল্লিখিত ত্র্যহস্পর্শের মোকাবিলা করার উপায় রয়েছে চিনের হাতে।

লাদাখ হামলার মাধ্যমে সম্ভবত তিনটি প্রধান বার্তা দিতে চাইছে চিন। এক, তাদের শর্ত মেনে সীমান্ত সমস্যার নিষ্পত্তি; দুই, দালাই লামা-পরবর্তী সময়ে তিব্বত সমস্যার সমাধানের বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়; তিন, মার্কিন নেতৃত্বাধীন 'কোয়াড' (Quadrilateral Security Dialogue, যা আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতের একটি বেসরকারি চতুর্মুখী জোট) ফোরামকে উৎসাহ দেওয়া উচিত নয়।

আরও পড়ুন: কত সেনা চলেছে সমরে, আমজনতার জানার দরকার কী?

যেখানে তাদের হারানোর কিছু নেই, সেই লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতার দিকেই সম্ভবত ঝুঁকছে চিন। তারা হয়তো এও মনে করছে যে ভবিতব্যকে স্বীকার করে নিয়েছে ভারত। হতাশাজনক ভাবে, আকসাই চিনের ক্ষেত্রে ভারতের দাবির সঙ্গে অরুণাচল প্রদেশে চিনের দাবির কাটাকুটি হয়ে যাবে, এমন কোনও সম্ভাবনাও বোধহয় নেই, ভারতে অনেকের কাছেই যা মনে হয়েছিল যুক্তিসঙ্গত।

যা মনে হচ্ছে, চিনের এবারের কৌশল হলো প্রথম ধাপে ভারতকে আকসাই চিনের ৩৮ হাজার বর্গ কিমি-র দাবি ছাড়তে প্ররোচিত করা, যার ফলে সামগ্রিক সীমান্ত সমস্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে লাদাখ। যদি তাই হয়, তবে তার নিহিতার্থ এই যে ভারত কেবল আকসাই চিন ছেড়ে দেবে তাই নয়, ৫,০৪৭ বর্গ কিমি আয়তনের স্কিয়াসগাম উপত্যকা এবং মানসরোবর লেক সংলগ্ন মেনসার এনক্লেভ (পাঁচটি গ্রাম)-এর ওপর দাবিও ছেড়ে দেবে। তাওয়াং নিয়ে যে আলোচনা করা যাবে না, তাদের এই "সামান্য দাবি" চিনা শিক্ষাবিদদের মাধ্যমে আগেই প্রচার করেছে চিন। এই একই কৌশল প্রয়োগ করা হয় মধ্য এশিয়ার দেশগুলিতেও।

আকসাই চিন বিষয়ে যদি চিনের কৌশলের ফাঁদে পড়ে যায় ভারত, তবে বেইজিং সকলের নজর ঘুরিয়ে দেবে অরুণাচলের দিকে, এবং জোর গলায় ভারতের কাছে ৯০ হাজার বর্গ কিমি-র দাবি জানাবে। আকসাই চিন সমর্পণ করে দিলে জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখের অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন আসবে। এবং ফের একবার এর নিহিতার্থ হলো, পাক-অধিকৃত কাশ্মীর এবং গিলগিট-বাল্টিস্থান প্রসঙ্গও ভুলে যেতে হবে ভারতকে। যদি না উভয় পক্ষই উচ্চস্তরের দর কষাকষিতে আগ্রহী হয়, তবে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে ভারতকে।

(লেখক কিরগিজ়স্তানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত তথা স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স বিশেষজ্ঞ)

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Ladakh india china standoff galwan valley
Advertisment