Advertisment

করোনার নিয়ম তো অনেক, মানা হবে কি?

আমাদের দেশে আমরা স্কুটার বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় মাথায় হেলমেট পরার নিয়ম মানতে রাজি নই। এটাই কি মানব প্রবৃত্তি? যাই নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, তা না মানা?

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
coronavirus india lockdown third phase

কোথায় সামাজিক দূরত্ব? নয়া দিল্লির ওয়াজিরপুর এবং আজাদপুরের অন্তর্বর্তী রেল লাইনে ভিড়। ছবি: তাশি তোবগিয়াল, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

প্রথমবার যখন করোনার জন্য লকডাউন হয় তখন জাতির উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভাষণ দিয়ে তা ঘোষণা করেছিলেন। দ্বিতীয়বার যখন এই লকডাউন বাড়ানো হলো ৩ মে পর্যন্ত, তখনও প্রধানমন্ত্রীই সে ঘোষণা করেন। তৃতীয় বার যখন লকডাউনের মেয়াদ ১৭ মে পর্যন্ত বাড়ানো হলো, তখনো ঠিক ছিল যে এই ঘোষণাও প্রধানমন্ত্রীই করবেন। ৩ মে রবিবার, তিনি এই ঘোষণা করতে পারতেন, এমনটাই কথাও ছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত বদলান। ঠিক হলো, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর দপ্তর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সবিস্তার তথ্য মানুষকে জানানো হবে। কারণ প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক অভিমুখ বা মূল দর্শনটি বুঝিয়ে বলতে পারেন, কিন্তু গ্রীন, রেড, এবং অরেঞ্জ, এই তিনটি জোনে গোটা দেশের সমস্ত জেলাকে ভাগ করা, এবং রেল পরিবহণ থেকে শুরু করে মদের দোকানের ছাড়, এবং নানা ধরনের মাইক্রো ম্যানেজমেন্ট বা ছোটখাটো খুঁটিনাটি স্থির করার বিষয় আছে। সেটা আগাম জানিয়ে দেওয়া ভালো, তারপর প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি বোঝাবেন।

Advertisment

আসলে প্রধানমন্ত্রী, অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ, রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলের মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, অর্থ ও রেল মন্ত্রকের অফিসারদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠক চলে শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা। এই বৈঠকে অফিসারদের ব্রিফিং শুনতে শুনতেই প্রধানমন্ত্রীর বুঝতে পারেন, সংক্ষেপে জাতির উদ্দেশ্যে এত তথ্য ঘোষণা করা উচিত হবে না।

আরও পড়ুন: প্রশ্ন একটাই: বন্ধ তালা খুলবে কবে?

আসলে করোনা ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সত্যি সত্যিই এক গভীর সঙ্কটের মুখোমুখি ফেলে দিয়েছে। একদিকে দেশের অর্থনীতি। শেয়ার মার্কেট বিধ্বস্ত। জিডিপি বা আর্থিক বৃদ্ধি অধোগামী। করোনা বিপর্যয় এই আর্থিক বৃদ্ধিকে শতকরা একভাগে পৌঁছে দেবে, এমনটাই জানাচ্ছে সম্ভাব্য বিশ্বজনীন বিশ্লেষণ। চাকরিবাকরি নেই। শিল্পপতিরা হায় হায় করছেন। আর্থিক লোকসানের জন্য আর্থিক প্যাকেজ চাইছেন, আবার অন্যদিকে পিরামিডের একদম নিচুস্তরের বাসিন্দা দিন-আনি-দিন-খাই মুটে মজুরদের অবস্থা শোচনীয়। মোদী আর্থিক অগ্রগতির কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, সেটা তো হতে পারে না!

আবার একথাও তো সত্য যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর আপাতত একমাত্র রাস্তা হলো সামাজিক যোগাযোগ এড়ানো। মুখে মাস্ক পরা, হাতে গ্লাভস পরা, হাত ধোয়া, এসব তো আছেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় কাজ হলো সোশ্যাল আইসোলেশন। সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকার মাধ্যমে ভাইরাসের শৃঙ্খল ভেঙে দেওয়া। এখনো তো এই মহামারীর কোনও প্রতিষেধক কোনও বিজ্ঞানীই আবিষ্কার করতে পারেননি, তাই চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আপাতত এই রোগ পরীক্ষাতে প্রথমে যে র‍্যাপিড টেস্ট হচ্ছে, তা প্রাথমিক প্রতিরোধ। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে টেস্টের মাধ্যমে রোগীর শরীর থেকে 'অ্যান্টিবডি' নিয়ে প্রতিষেধক তৈরির চেষ্টা হবে। কেননা জীববিজ্ঞানের সহজ নিয়ম অনুসারে মানুষের মধ্যে ভাইরাস ঢুকলে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য অ্যান্টিবডিও তৈরি হবে। এই অ্যান্টিবডির মাধ্যমেই ভবিষ্যতের প্রতিষেধক তৈরি হবে।

এখন এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী এক মাঝামাঝি পথ বা 'middle path' নিচ্ছেন। একদিকে লকডাউনের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে, অন্যদিকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড়ও দিতে হবে। দেশের সমস্ত স্থানে, সমস্ত জেলায় পরিস্থিতি একরকম নয়। তাই তিনটি জোনে দেশকে বিভক্ত করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন: গণবণ্টনে অশনি সংকেত, ভরসা ফিরুক দ্রুত

ধরা যাক, বিমান চলাচল এবং রেল চলাচল, এই দুটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। বিমান চলাচলের ব্যবসার লবি খুব শক্তিশালী। তারা চাইছে, এখনই বিমান পরিষেবা চালু হোক। কারণ কোটি কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। বিমানসংস্থার প্রস্তাব, কম সংখ্যক যাত্রী দিয়ে যদি বেশি ভাড়ায় পরিষেবা চালু করা যায়। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এখনই বিমান পরিষেবা চালু হলে করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আর তাই ১৭ মে পর্যন্ত যে লকডাউন, তাতে কোনোভাবেই বিমান পরিষেবা চলবে না। প্রথম কিস্তিতে ২১ দিন, দ্বিতীয় দফায় ১৯ দিন, এবং তৃতীয় কিস্তিতে ১৪ দিনের জন্য লকডাউনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিমানের পাশাপাশি রেল চলাচলের চাপও বাড়ছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের চাপ তো আছেই। এই সমস্যার একটা মানবিক দিক আছে, আর সেজন্য পীযূষ গোয়েলের দাবি মেনে কিছু বিশেষ ট্রেনের মাধ্যমে অসংগঠিত শ্রমিকদের নিজেদের রাজ্যে পাঠানো খুব জরুরী ছিল। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মতো অনেকেই খেতে না পাওয়া মানুষদের জন্য ট্রেনের মাধ্যমে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হচ্ছেন। কাজটা সোজা নয়। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে বলার সময় নিজেই বলেছেন, "আমি বুঝতে পারছি আপনারা একা একা বাড়িতে বন্দি হয়ে থাকাটা মেনে নিতে পারছেন না। অনেকে আমার ওপরও অভিমান করছেন। কিন্তু এটা তো ভাবতেই হবে যে এই লকডাউন না মানা হলে পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে।"

প্রধানমন্ত্রীর লকডাউনকে তাই দেশের সব রাজনৈতিক দলই মেনে নিয়েছে। গড়পড়তা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, এই লকডাউন দরকার। তবে ট্রেন চলাচল, অর্থাৎ বেশ কিছু ট্রেন দিয়ে একটা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে মানুষকে নিয়ে আসার পরিষেবা চালু করতে কিন্তু অনেকগুলি রাজ্যেরই আপত্তি ছিল। কেন্দ্র রাজ্যকে একথাও বলেছিল যে যদি স্থানীয় রাজ্যস্তরে জেলাশাসক বা কালেক্টর একজন ব্যক্তির জন্য ছাড়পত্র দেন এবং রোগের ব্যাপারে গ্যারান্টি দেন, তাহলেও বিশেষ ট্রেনে যে ব্যক্তিকে তোলা হবে, অর্থাৎ ক'জন আসবেন এবং কারা আসবেন, তাও রাজ্য প্রশাসনই ঠিক করবে।

আরও পড়ুন: দুই পক্ষকাল পরে

কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন কিছু মুখ্যমন্ত্রী এ প্রস্তাবে রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য, ট্রেন চলাচল কোনও একমুখী প্রক্রিয়া নয়। একজন যাত্রী রাজ্য থেকে গেলে পাল্টা ট্রেনে অন্য কোনও রাজ্য থেকে দশজন পশ্চিমবঙ্গে ঢুকবেন। তাহলে কীভাবে রাজ্য করোনা আক্রান্তের অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা আটকাবে? একদিকে সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে ট্রেনে করে আন্তঃরাজ্য যাতায়াত, এটা কীভাবে সম্ভব?

করোনা মোকাবিলার পরিস্থিতিতে তিনটি পৃথক জোনে কোথায় কী মানা হবে আর কী মানা হবে না, সেও এক জটিল ব্যাপার। ধরুন মদের ব্যবসা। এ তো শুধু নেশা করা বা না করার নৈতিক বিষয় নয়। গুজরাতের মত রাজ্যে গান্ধীজীর নামে রাজ্যকে সুরা-হীন করে রাখা হয়েছে। করোনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। বিহার বা কেরালার মতো রাজ্যে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা আছে মদ ব্যবসার ক্ষেত্রে। কিন্তু ভারতের মতো ১৩০ কোটি মানুষের দেশে সুরা এক মস্ত বড় ব্যবসা। রাজ্য সরকারগুলিও কোটি কোটি টাকার আবগারি শুল্ক পায় এই পরিষেবা থেকে। মদের দোকান বন্ধ থাকার ফলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে তারা।

এখন বলা হয়েছে গ্রীন জোনে, যেখানে করোনা রোগী নেই, সেখানে মদের দোকান খোলা হবে। কিন্তু একটা রাজ্যে গ্রীন জোন থেকে রেড জোনে যে এই মদ বেআইনি পথে ঢুকবে না, তার গ্যারান্টি কোথায়? তাই রেড জোনেও নানা শর্তে কিছু সুনির্দিষ্ট দোকান থেকে মদ বিক্রির অনুমতি দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা ও নিষেধাজ্ঞা লঘু করার ক্ষেত্রে এহেন নির্দেশাবলী নীচু তলায় সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা কিন্তু একদমই সহজ কাজ নয়।

আমি ভাবছিলাম, আমাদের দেশে আমরা স্কুটার বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় মাথায় হেলমেট পরার নিয়ম মানতে রাজি নই। এটাই কি মানব প্রবৃত্তি? যাই নিষেধাজ্ঞা জারি হবে, তা না মানা? যেখানে লেখা থাকে 'থুতু ফেলবেন না', সেখানে আমরা থুতু ফেলি, তা সে হাসপাতাল হলেও। 'এখানে প্রস্রাব করিবেন না' লেখা থাকলেও আমরা তা মানি না। কথায় বলে, 'habit is second nature'। তাই আমাদের দেশের জেলা স্তরের প্রশাসনের কি এই ক্ষমতা আছে যে এই শ্রী-ভ্রষ্ট করোনা-ক্লিষ্ট দিনে গ্রীন, রেড, অরেঞ্জ জোন ভিত্তিক নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়িত করার?

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলা এখন টেলিগ্রামে, পড়তে থাকুন

Advertisment