Advertisment

সেনাপ্রধানের বক্তব্য, এবং জরুরি অবস্থার কিছু কথা

অবসরগ্রহণের পর রাওয়াত আবার যদি সরকারের সেবা করেন কিংবা বিজেপিতে যোগ দেন, দুটিতেই তাঁর নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের সহায়তা জরুরি।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
army chief bipin rawat

প্রতীকী ছবি। অলঙ্করণ: অভিজিৎ বিশ্বাস

সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত অবসর নেবেন এ বছরের শেষ দিন। এর মধ্যেই কথা হচ্ছে যে আমাদের তিন বাহিনীর, অর্থাৎ সেনা, নৌসেনা এবং বায়ুসেনা, এই তিন বিভাগ মিলিয়ে শীর্ষপদে আসীন হবেন তিনি। শুধু রাজনৈতিক নেতা মানেই তো দেশনেতা নন, আমাদের দেশের সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন মানুষেরাও আমাদের নেতা। ঠিক একই রকমভাবে সমাজের বিভিন্ন স্তরের যে মানুষেরা নিজের নিজের ক্ষেত্রে সুপরিচিত তাঁরাও আমাদের পথ দেখান।

Advertisment

সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব বিতর্ক নিয়ে দেশে অবশ্যই ভিন্ন মত রয়েছে। গুণীজনদের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ মনে করছেন যে বিষয়টি একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। একটি বিশেষ ধর্মের মানুষদের আলাদা করে দেখার যে প্রক্রিয়া, তাকে তাঁরা সংবিধানবিরোধী মনে করছেন। সংবিধানের প্রতিটি নিয়মের প্রচুর ব্যাখ্যা। সেই ব্যাখ্যা নিয়ে গোলমাল আছে বলেই তো দেশে আদালত আছে। সুতরাং ধর্মনিরপেক্ষতা এবং তার নিরিখে নাগরিকত্বের খুঁটিনাটি নিয়ে আলোচনা শেষ হওয়ার নয়।

তবে এটা সত্যি যে বিজেপি নির্বাচনের আগে যে ইস্তাহারের কথা ঘোষণা করেছিল, সেইমতই দক্ষিণপন্থী পথে চলছে। আর দেশের মানুষের একাংশ যে বিজেপির সমর্থক, তা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই। সেনাপ্রধানের মন্তব্য তাঁদের ভালোই লাগছে। আর তিনি সরকারের পক্ষে কথা বলাটাই মঙ্গল। উল্টো কিছু মন্তব্য করলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরে তুলনায় বেশি আঘাত আসত। তবে অনেকে মনে করছেন যে সেনাপ্রধানের রাজনৈতিক বিষয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো, কারণ তাতেই নাকি দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়। উদাহরণস্বরূপ একথা মানতেই হবে যে সেনাপ্রধান যদি দেশে কোনও নির্বাচনের আগে বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করেন, সেক্ষেত্রে সংবিধান স্বীকৃত সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অবশ্যই বিঘ্ন ঘটবে।

আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব বিতর্ক ও রামরাজ্যে গণভোট

তবে সেরকমের বিঘ্ন তো ঘটেই। আমাদের রাজ্যে স্বাধীনতার পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তাতে কোথাও সেনাপ্রধান প্রভাব খাটিয়েছেন বলে জানা নেই। তা সত্ত্বেও জনমত সবসময় সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, এমনটাও নয়। নির্বাচনী বিশৃঙ্খলার নিদর্শন এই রাজ্যে যথেষ্ট। অর্থাৎ সেনাপ্রধানের একটি মন্তব্যে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে উই ধরে গেল, তা পুরোটা সত্যি নয়। তাঁরও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। তিনি নাগরিকত্ব নিয়ে বর্তমান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। তাঁর মনে হচ্ছে বিরোধী নেতানেত্রীরা এই আন্দোলন সঠিক পথে পরিচালনা করছেন না। সবটাই তাঁর দিক থেকে সঠিক পদক্ষেপ।

অবসরগ্রহণের পর আবার যদি সরকারের সেবা করেন কিংবা বিজেপিতে যোগ দেন, দুটিতেই তাঁর নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের সহায়তা জরুরি। সুতরাং সেই পথ ভুলে তিনি মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে পথে নামবেন, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। অর্থাৎ বছর শেষে এবং একই সঙ্গে কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে তাঁর সিদ্ধান্ত একেবারেই বাস্তবোচিত। আর তিনি যে হঠাৎ করে মত বদলেছেন এমনটাও নয়।

সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি এর আগেও বিভিন্ন আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। আর একথা তো একেবারেই সত্যি যে দেশে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ হলে সেনাপ্রধানের দিক থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করাই একমাত্র পথ। ঠিক সেই রকমই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতায় হিংসাত্মক কার্যকলাপের তিনি যে বিরোধিতা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক।

আরও পড়ুন: নাগরিকত্ব বিলের মূল্য দিতে পারবে তো ভারতবর্ষ?

তাহলে গোলমালটা ঠিক কোথায়? তা হলো এই আন্দোলনের একটা বড় অংশের সঙ্গে যুক্ত আছেন দেশের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং অধ্যাপকেরা। তাঁরা মিছিল করছেন একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে। দেশের যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, তাতে সংবিধানসম্মত ভাবে এই ধরণের প্রতিবাদ মোটেও দোষের নয়। কিন্তু সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর পুলিশ যদি লাঠি চালায়, কিংবা ভয় দেখানোর জন্যে ঢুকে পড়ে সেখানকার গ্রন্থাগারে, আর তারপর লাঠিপেটা করে নিরীহ ছাত্রদের, সেক্ষেত্রে বিপিনবাবুকে তো অন্য দিকটাও দেখতে হবে। গণতন্ত্রের কারণ-সুধা শুধু একদিকের নল দিয়ে পান করলেই তো চলবে না, সেখানে অন্য মতও আছে, আছে অন্যপক্ষ। ডান আছে, বাম আছে, মধ্য আছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পড়ুয়া, কর্মচারী এবং অধ্যাপকদের মিছিল বেরোনোর সময় সেখানকার প্রশাসন চাপা হুমকি দেবে আর মিছিলে পথ হাঁটা যুক্তিবাদী মানুষেরা সেই ভয়ে শীতের চাদরে মাথা ঢাকবেন, এমন ভাবনা খুব সহজে কাজ করবে না। যাঁরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের পক্ষে, তাঁরাও মিছিল করছেন। বিজেপি কলকাতায় এই নিয়ে মিছিল করেছে, মিছিল করেছেন প্রায় এক হাজার চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকা মানুষ। সেখানে তো কেউ ভয় দেখাতে যায় নি।

অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ যদি আজকে কলকাতার কোন কলেজে "ক্যা ক্যা বাহ বাহ" স্লোগান দিয়ে শান্তিপূর্ণ মিছিল করে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে তাকে "ক্যা ক্যা ছি ছি"-র মতই স্বাগত জানানো ছাড়া গতি নেই। কিন্তু কোনও একটি মিছিলে সমসাময়িক শাসকদলকে অলিভ তেল ঘষা আধিকারিক সমর্থন করবেন, আর অন্যমতের ছাত্রছাত্রীদের রাস্তায় ছড়িয়ে রাখবেন চাপা হুমকির কাঁটা, এমনটা সংবিধানে লেখা নেই।

বিপিনবাবুকে তাই একই শ্রবণযন্ত্র দিয়ে অনুব্রত থেকে দিলীপ, সবার কথা শুনতে হবে। সকলে তো আর সিবিএসই-তে প্রথম হওয়া সীতারাম ইয়েচুরী নন যে মার্জিত ভাষণে প্রতিবাদ করবেন। আন্দোলনের বিভিন্ন রূপ থাকবে, কখনও তা সীমা ছাড়াবে, এবং অবশ্যই তা সীমা ছাড়ালে সরকার ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু সরকার যদি শাসকের ভূমিকায় নির্বোধ পক্ষপাতিত্বের পথ নেয়, গণতন্ত্র লঙ্ঘিত হয় তখনই।

আরও পড়ুন: ঠিক কীভাবে নাগরিকত্ব ‘সংশোধন’ করবে মোদী সরকার?

তাই এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রশাসককেও বুঝতে হবে যে তিনি যে ভাষায় কথা বলবেন, বিরোধীদেরও সুর তার থেকে আলাদা হবে না। আর আজকের প্রশাসক যখন বদলে যাবেন, তিনিই তখন বিরোধী। আসলে চতুর্থ মাত্রায় আইনস্টাইনের সময়ের কথা ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যান শাসককুল। সেটা তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়াই গণতন্ত্রের প্রাথমিক কাজ।

এই প্রসঙ্গ ধরে রেখেই শেষ করা যাক এ বছর চলে যাওয়া বিজেপির কয়েকজন নেতানেত্রীকে স্মরণ করে।

"আমি সুযোগ পেয়েছিলাম ২৬ জুন, ১৯৭৫ সকালে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম মিছিল বার করার। সেই বাইশ বছর বয়সে বুঝে উঠতে পারি নি, কত গভীর ইতিহাসের সাক্ষী হতে চলেছি আমি। এইদিনের ঘটনা আমার জীবনের গতিপথ সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিকেলের মধ্যেই আমাকে মিসা আইনে গ্রেপ্তার করে পাঠানো হল তিহার জেলে।"

~ অরুণ জেটলি (২৮ ডিসেম্বর, ১৯৫২-২৪ অগাস্ট, ২০১৯)

সাতষট্টি ছুঁতে পারেন নি, অকালে চলে গেলেন বিজেপির এই সর্বভারতীয় নেতা। বছর শেষে হিসেব মেলাতে গিয়ে যেমন তাঁর কথা মনে আসবে, তেমনই একইসঙ্গে আসবে মনোহর পারিক্কার (১৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৫ - ১৭ মার্চ, ২০১৯) কিংবা সুষমা স্বরাজের (১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ - ৬ অগাস্ট, ২০১৯) নাম।

অরুণ জেটলি সরাসরি লড়াই করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর চাপিয়ে দেওয়া জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে। ইতিহাস খুঁজলে পাওয়া যায়, সুষমা স্বরাজও জনগণের সেই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন বিভিন্ন জেলবন্দী নেতাদের আইনি লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করে। মনোহর পারিক্কার তখন আইআইটি বম্বের ছাত্র। সেই সময়ের ইতিহাস জানা না গেলেও পরবর্তীকালে সত্তর দশকে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: এনআরসি + সিএএ = নাগরিকত্ব হলে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে?

আজকে অবশ্যই তাঁদের মতামত পাওয়ার আর সুযোগ নেই। তবে প্রাক্তন বিজেপি নেতা যশোবন্ত সিংহ কিন্তু বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আজকের আচরণ সেই জরুরি অবস্থার সময়ের মতোই। শোনা যায়, সেই সময় আত্মগোপন করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। অমিত শাহ তো তখন যথেষ্ট তরুণ। সুতরাং ইন্দিরা গান্ধির আধা ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরতন্ত্রী রাজনীতি বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান না থাকাই স্বাভাবিক। তবে প্রতি বছরের মাঝে জরুরি অবস্থার বর্ষপূর্তিতে তাঁরা যে বিভিন্ন ট্যুইট করেন, সেগুলো একবার ফিরে দেখতে পারেন বছরশেষে।

এই বিজেপিই তো বিপুলভাবে লোকসভা নির্বাচনে জেতার পরেও সুষ্ঠুমতে বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনা করে এবং বেশিরভাগ জায়গাতেই হারে। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক পরিসরের সমস্ত ক্ষেত্রে যে তারা আক্রমণ করছে, এমনটা নয়। তাই নতুন বছরে বিজেপি শাসকেরা ডানপন্থা ছেড়ে একটু মধ্যপন্থায় মন দেবেন, এমনটা আশা করতে দোষ কিসের? সেক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে তাঁদের পারিষদবর্গও হয়ত নিরপেক্ষ মত প্রকাশের সাহস দেখাবেন। সেই ভাবনা নিয়েই আগাম শুভেচ্ছা রইল নতুন ইংরিজি বছরের।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)

Advertisment