বিশ্বজুড়ে ডানপন্থীরা জিতছে না। জিতছে আসলে অন্তর্জাল। আমাদের দেশেও বিজেপি নাকি ইলেকট্রনগুলোর নড়াচড়া এমনভাবে সামলে নিতে পেরেছে যে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ সব শুধু সামরিক জাতীয়তাবাদের কথাই বলছে। সুযোগ পেলেই ইমরানের বলে ছক্কা হাঁকাও, আর ট্রাম্প যদি সে ব্যাটার সঙ্গে সাঁট করে তাহলে তাকে নামিয়ে দাও ক্রিকেট মাঠে। তারপর ব্যাট হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধাঁই ধপাধপ বাউন্সার। প্যাড-গ্লাভস-গার্ড পরার সময়টাই দেওয়া হবে না। তবে আমাদের হয়ে যদি সে কথা বলে তাহলে কিন্তু ধোনিকে বোলার হিসেবে ব্যবহার করে সরল লেগস্পিন খেলিয়েই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। সীমান্তে রক্ত ঝরিয়ে যদি দেশপ্রেম দেখাতে না পারি, সেক্ষেত্রে আঙুলে ব্লেড চালিয়ে রক্ত ঝরা দস্তখত। আর ঘটনা ঘটা মাত্রই ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন বৈদ্যুতিন কণা ছড়িয়ে দাও জগত জোড়া জালে। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের দিকনির্দেশ করার জন্যে ডান কিংবা বাঁহাতের তর্জনী, মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ রামকৃষ্ণের মত বেঁকিয়ে আপাতত আর কোন কাজ হবে না। অণু কিংবা পরমাণু, প্রোটন কিংবা ইলেকট্রন, সব কিছুই এখন শুধু একটি দলের কথাই বলবে। তাই বিজেপিকে রোখার একটা পথ বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রকে কবর দিয়ে তামাদি হয়ে যাওয়া ভোটবাক্স আর কাগজের ব্যালট ফিরিয়ে আনা। তার জন্যে অধিকার রক্ষার লড়াই চলছে চলবে। তবে এর মধ্যে আশার কথা হল প্রশান্ত কিশোরকে কিছু দিনের জন্যে বিজেপি এবং তার সহযোগীদের কাছ থেকে ধার নেওয়া গেছে।
আরও পড়ুন, গণপ্রহার: আদৌ ওষুধ আছে এই সামাজিক রোগের?
নিন্দুকেরা বলবেন বিজেপি একটি অতিরিক্ত খেলোয়াড় যেচেই ধার দিয়েছে তৃণমূলকে। তো সেই প্রশান্তবাবুর বুদ্ধিতেই হোক, কিংবা তৃণমূলের পলিটব্যুরোর ভাবনায় — আকাশপাতায় ফটাফট ভরে দেওয়া যাচ্ছে অভিযোগ। রাজ্য শাসনে সাহায্য করতে মতামত দিয়েও সরকারকে কৃতার্থ করতে পারেন আপনি। এমনিতেই সন্ধেয় একমাত্র কাজ মুড়ি তেলেভাজা চিবুনো আর সঙ্গে ভাটপাড়ায় বিপ্লব ছাড়া আলোচনার বিষয় বিশেষ নেই। ইস্টবেঙ্গলের শতবর্ষ কিছুটা অন্যদিকে মন টানলেও শেষমেশ আবার আমডাঙ্গা কিংবা কাঁঠালপাড়ায় খুনোখুনির খবর। একদল বলবে অন্যদল মেরেছে। অন্যদল বলবে এটা আসলে অন্তর্দ্বন্দ্ব। বহুব্যবহারে শব্দগুলো বর্ণপরিচয় আর সহজপাঠে ঢুকে গেছে। যুক্তাক্ষরের আগে পর্যন্ত ভাটপাড়া আর কাটমানি, আর দ্বিতীয় ভাগে উন্নয়ন আর অন্তর্দ্বন্দ্ব।
এবার শব্দ শিখলেই তো চলবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে দূর-দূরান্তে। কাঁঠালের চাপে বেদানা চটকে কাপড়ের থলের তলায় লালচে রস। পেছন থেকে লুকিয়ে ছবি তুলে ছেড়ে দাও অন্তর্জালে। মুঠোফোন তো হাতে আছেই। থলেয় নিষিদ্ধ মাংস পাচার হচ্ছে। লোকটার আবার ছাগল দাড়ি। পরনে সাদা লুঙ্গি আর ফতুয়া। ইলেকট্রনের গতিবেগের থেকে গুজবের স্পিড বেশি। পাশের পাড়ায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই দাদু চ্যাংদোলা। কাঁটাঝোপে ফেলার বন্দোবস্ত হচ্ছে। দু-চার ঘা পিঠে পড়ার পর ভাগ্যিস সাদা হাফহাতা পাঞ্জাবির (ফতুয়া কি?) তলা থেকে পইতে বেড়িয়ে পড়ল তাই রক্ষে। দাপাদাপিতে ততক্ষণে কাঁঠাল ফেটে বিচি গড়াগড়ি খাচ্ছে রাস্তায়। থেঁতলে যাওয়া বেদানা দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে সেটা গোমাংস নয়। চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল কলা-বাতাসা, চালমাখা শশার টুকরো। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া দেশভক্ত শক্তহাতে দাদুকে দাঁড় করিয়ে শুধালো, ধুতিটাকে লুঙ্গির মত করে পরেছেন কেন? হতাশ বৃদ্ধ পুরোহিত জানালেন যে তিনি অনেকক্ষণের পুজো শেষে তাড়াহুড়ো করে ছোট বাইরে গেছিলেন। সেখানেই ধুতির কোঁচা খুলে যায়। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে হবে বলে সহজ সরল ভাবে কাপড় জড়িয়ে হাঁটা লাগিয়েছিলেন। তারপরেই এই বিপদ! যাই হোক পৈতের কল্যাণে এ যাত্রা গণপিটুনির হাত থেকে বাঁচলেন হিন্দু পুরোহিত। তবে এই যে অন্তর্জালে খবর পেয়ে অনেক মানুষ একজোট হলেন, এ তো সত্যি প্রযুক্তির আশীর্বাদ। এভাবেই তো এগিয়ে চলে রাজনীতির ধারা, একমুঠো ফোটনকণা সঙ্গে নিয়ে।
আরও পড়ুন, ভূমিসংস্কার ও বিপরীত বর্ণবিদ্বেষ: একটি আফ্রিকান ট্রাজেডি
অন্তর্জালে বিজেপির জয়জয়কার তো আর একদিনে হয় নি, তার জন্যে অনেক মানুষের দীর্ঘ পরিশ্রম আছে। তাদের ডানপন্থী ভাবধারার সঙ্গে বিদ্বজ্জনদের রাজনৈতিক মতের অমিল হতে পারে। কিন্তু চরম সত্য হল পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। ফলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে বিজেপি যে পথে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে, সেখানেই অনেক দেরিতে হাঁটা শুরু করল তৃণমূল। দিদিকে কানে সব খবর যে খুব সহজে পৌঁছে দেওয়া যায়, সে কথা আগে জানা ছিল না এমনটা নয়। অর্থাৎ রূপায়ণে দেরি হল প্রায় এক যুগ। সেটুকু না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু দশ কোটির মধ্যে যদি একশো ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ দশ লক্ষ মানুষ তাদের অভিযোগ কিংবা মতামত নথিভুক্ত করেন, সেগুলো পড়বে কে? তৃণমূলের কি সেই ধরনের সাংগঠনিক সক্ষমতা আছে এই সমস্ত তথ্য চটজলদি বিশ্লেষণ করে সেই সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়ার? নাকি পুরোটাই আবার সামলাতে হবে প্রশান্ত কিশোরকে? কতদিন নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে চলবে এই প্রচেষ্টা? হঠাৎ করে একদিন চৈতন্য হলে ভাল কথা, কিন্তু সেই ধরনের কাজ হয়ত দীর্ঘ এক দশক ধরে করছে বিজেপি। ফলে অল্প সময়ে পেশাদারের সাহায্য নিয়ে তাদের ধরে ফেলার সুযোগ কম। আর বিজেপির পেছনে আছে বুদ্ধি এবং কৌশলে পারদর্শী আরএসএস। জনসমক্ষে তারা সমস্ত বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সত্যযুগে এই ভারতে হয়েছে বলে প্রচার করলেও, বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি ব্যবহারের সময় নিজেরা খুব ভাল করেই জানেন একমাত্র বিজ্ঞানই সর্বশক্তিমান। সেকারণেই বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহারে তাদের জুড়ি নেই।
এই প্রেক্ষিতে একটু ফিরে তাকানো যাক আজকের সিপিএম-এর দিকে। বামপন্থী দল, বিজ্ঞান যাদের ভিত্তি। অদ্ভুতভাবে চিরটাকাল প্রযুক্তি তাদের ভবিষ্যৎ হয়েই থেকে গেল।
নব্বইয়ের দশকে পশ্চিমবঙ্গে কম্পিউটার আসার কথা ভাবুন। সেই সময় থেকেই তারা প্রযুক্তিকে সামনের দিনের জন্যে বাকি রেখে দিয়েছে। তাই অতীতে কোনদিন আর তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে উঠতে হয় নি। সেই জন্যেই বিজেপি যখন আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর দল হয়ে উঠতে পেরেছে, আম আদমি পার্টিও যখন সেই দলে, কংগ্রেসের এই খারাপ সময়েও যখন অন্তর্জালে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর, তৃণমূল যখন সবশেষে “অন্তর্জালে অভিযোগ” গোছের রহস্যোপন্যাস লিখতে শুরু করেছে, সেই বাজারে শ্রেণির শেষতম ছাত্র হিসেবে হঠাৎ করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হল সিপিএমকে। এতদিনে তাদের মনে পড়েছে যে সমর্থকরা নাম লেখাতে পারে অন্তর্জালের মাধ্যমে।
আরও পড়ুন, জন ও স্বাস্থ্য: স্ত্রীরোগ এবং আমাদের সমাজ
ভাবতে অবাক লাগে যে সিপিএমে এত ভাল ভাল প্রযুক্তিবিদ থাকতেও কেন সেই দল অনেক দিন আগেই এই ধরনের অন্তর্জালভিত্তিক কর্মকাণ্ড শুরু করে নি? বরং তৃণমূলের ওয়েব সিরিজ নিয়ে যখন লোকজন রীতিমত মুখ বেঁকাচ্ছে, সেই সময় সিপিএম এই ধরনের একটি প্রকল্প প্রচার করে নিজেদের কি আরও বেশ কিছুটা খেলো করে ফেলল না? সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিপুল প্রচার হয়েছে মুঠোফোনের আঙুল ধরে। তার সবটা কিন্তু বিজেপির নয়, বরং অনেকটা জায়গা জুড়ে ছিলেন বামপন্থীরাও। মুশকিল হল তাদের প্রচারের ফলটুকুও গেছে বিজেপির ঘরে। বাম-বর্ণিত তৃণমূল-বিজেপি আঁতাতের জটিল তত্ত্ব ভুলে সাধারণ মানুষ বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে মেনে নিয়েছে। তাই বাম সমর্থকদের ইলেকট্রনের খেরোর খাতায় নাম লেখাতে বলার অনুরোধ এতো বড় মুখ করে প্রচারের সময় এটা নয়। রাজ্য সিপিএমের নেতৃত্ব ছাড়াই এই সমস্ত বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ অন্তর্জালে নিজেদের বক্তব্যটুকু নিয়মিত রেখে থাকেন। বরং সিপিএমের খাতায় নাম লেখালে পার্টি নির্দেশিকার চাপে তাদের সক্ষমতা কমে না যায়!
যাই হোক, বাম নেতৃত্ব দেখুন যে তারা ঈশ্বরকণায় ভর করে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক পান কিনা। সেসব নাম নথিভুক্ত করে সিপিএম রাজ্য কমিটি এই সমর্থকদের ঠিক কি কাজ দেন সেটা জানার অপেক্ষায় থাকবেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ঘরপোড়া মানুষজন। সিঁদুরে মেঘ দেখে অন্তর্জালে লোহিতকণিকা কিছু বাড়লে নিশ্চিন্ত হবেন দেশ এবং রাজ্যের অন্যপক্ষের মানুষ, যাদের প্রতিনিধির সংখ্যা এই মুহূর্তে সংসদে এক আঙুলের কড়ের থেকেও কম।
(শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)