প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কলকাতা গেলেন বেশ কিছুদিন পর। এবার প্রধানমন্ত্রীর সফরকে ঘিরে প্রথম থেকেই আছে বেশ উত্তেজনা। রাজপথে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সম্ভবত একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী যিনি নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে এতখানি আক্রমণাত্মক। নিজে মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন 'ক্যা ক্যা ছি ছি'। ক্যা মানে CAA, পুরোটা বলতে গেলে সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। এই আইনের বিরোধিতায় মমতা নিজে গানও লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, গানটি গেয়েছেন গায়ক তথা মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন।
গোটা দেশে অন্য সমস্ত রাজ্যের মধ্যে বাংলাই হলো এমন এক রাজ্য, যেখানে বিজেপিও এই আইনের বিষয়টি নিয়ে আক্রমণাত্মক। আবার মমতাও গোটা দেশে নাগরিকত্ব আইন-বিরোধী আন্দোলনের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছেন। এই ঘটনা প্রবাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কলকাতায় এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত বৈঠকও হয়েছে। মমতা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি অনুষ্ঠানেও গেছেন মিলেনিয়াম পার্কে। ১৩ জানুয়ারী দিল্লিতে সোনিয়া গান্ধীর ডাকা বিরোধী বৈঠকেও মমতা হাজির হচ্ছেন না। প্রথমে কিন্তু উৎসাহ প্রকাশ করেন তিনি। দিল্লি সফর চূড়ান্তও করে ফেলেন। পরে বাতিল করেন।
রাজ্যে কংগ্রেস ও সিপিএম নেতারা বলতে শুরু করেছেন, মমতা নাকি বিজেপিকে খুশি করার জন্য একাজ করেছেন। প্রচার ও গুজব ছড়ানো হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে, যে বিজেপি এবং মমতার বোঝাপড়া হচ্ছে। নিন্দুকেরা তো এমন কথাও বলছেন যে সিবিআই তদন্তের ভয়ে মমতা এহেন বোঝাপড়া করছেন।
আরও পড়ুন: মোদী-শাহ যাই করুন, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চাইবে না ভারত
আমি নিজে কিন্তু এসব ভাসমান গুজবে আস্থা রাখি না। বিজেপির কান্ডারী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গকে গত ছ'বছর ধরে বিশেষ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। বাংলা শেখার চেষ্টা করছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে ১৮ টি আসনে জেতার পর বিজেপি আরও উৎসাহিত। আশা জেগেছে, বিজেপি চাইলে রাজ্যে ক্ষমতাসীন হতে পারে। কারণ বাঙালি ভদ্রলোকেরা উত্তর প্রদেশের ভোটারের মতো উগ্র হিন্দু নন, তাঁরা গোপন হিন্দু। মানে ভোটের সময় বাইরে ইন্টেলেকটচুয়ালিজম দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত সব বিজেপিকেই ভোট দেবেন।
এমন কথাও অনেকে বলছেন, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার জন্যই মূলত নাগরিকত্ব আইন এনেছে। সে যা হোক, যে দল হিন্দি বলয়ের সীমানা পেরিয়ে সেই কবে থেকে সর্বভারতীয় বা 'প্যান-ইন্ডিয়ান' দল হতে চাইছে, তারা যে মমতার সঙ্গে বোঝাপড়া করবে, সেটা কী জন্য? মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী রাখতে চাইবে কেন? তাতে বিজেপির লাভ কোথায়? বরং বিজেপি যে বন্ধু বন্ধু একটা ভাব দেখাতে চাইছে, তাতে যদি মমতা মজে যান এবং আবেগতাড়িত হন, আর ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে আবার বিজেপি হঠাৎই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে, তাতে কি মমতার লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি নয়? হতে পারে, এটা বিজেপির 'one step forward' আর 'two steps back' রণকৌশল। তা আমি আপনি যখন বিজেপির এই কৌশলে সন্দেহ প্রকাশ করছি, তখন মমতা সন্দেহ করবেন না? তিনি চোখ বুজে মোদী-অমিত শাহকে বিশ্বাস করবেন, এমনটা ভাবারই বা কী কারণ থাকতে পারে?
মোদী এবং মমতার রাজনীতির এই সমীকরণ কিন্তু সবসময়ই এধরনের উত্থান পতনের প্রহেলিকা। মমতাও কিন্তু লোকসভা ভোটে বিজেপি যে এতগুলো আসন পেয়ে যাবে, সেটা কখনও ভাবতে পারেন নি। তবু পশ্চিমবঙ্গে এতগুলো আসন পাওয়ার পর যে বিজেপির ক্ষিদে আরও বাড়বে, সেটা মমতা বিলক্ষণ জানেন। তাই তিনিই বা মোদী অমিত শাহর সঙ্গে রাজনৈতিক আপস করতে যাবেন কেন?
আরও পড়ুন: নাম বদল বিতর্কে মোদী-মমতাকে এক সূত্রে গাঁথলেন সেলিম-সোমেন, প্রশ্ন তুললেন অভিষেকও
কিন্তু এবার কলকাতা সফরে মোদী এবং মমতা দুপক্ষই কিন্তু কৌশল বদলেছেন। প্রথমত, মমতা ২০১৪ সালে ভোটের আগে এবং পরেও যেভাবে মোদীর নাম করে আক্রমণ শানিয়েছেন, কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হওয়ার পথে নিয়ে এসেছিলেন, এখন সেই কৌশল বদলে ফেলেছেন। এখন মমতা বলছেন, তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত যাই হোক না কেন, তিনি ২০১৯ সালে মোদী ফের বিপুল ভোট জিতে আসার পর উন্নয়নের প্রশ্নে বয়কটের রাজনীতি ত্যাগ করে রাজ্যের স্বার্থে বৈঠক করছেন। এমনকি নাগরিকত্ব বিল নিয়ে শুধু প্রধানমন্ত্রী নন, অমিত শাহর সঙ্গেও দেখা করছেন।
রাজনীতিতেও সম্পর্ক নানা ধরনের হতে পারে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের মতোই। একটা সম্পর্ক হলো প্রগাঢ় ভালবাসার। আর একটা সম্পর্ক হলো 'তু তু ম্যায় ম্যায়'। আবার আর একটা তৃতীয় অপশন থাকে, যেখানে সম্পর্কটা কূট না হলেও প্রবল প্রেমেরও নয়। মার্ক্সীয় পরিভাষা নকল করে বলা যায়, 'non-antagonistic normal neutral relation', সেখানে সংঘাত হলেও তা শত্রুতাপূর্ণ নয়। মার্কসবাদে সমাজতন্ত্রের শ্রেণী সংগ্রাম বোঝাতে গিয়ে 'antagonism'-এর পাশাপাশি বলা হয় 'non-antagonistic class struggle'.
তাই মমতা এখন ন্যূনতম শিষ্টাচার রক্ষা করছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের একটা সুষ্ঠু সমন্বয় বা কমিউনিকেশন আছে, তাতে কেন্দ্র-রাজ্য ফেডারেল বোঝাপড়াও থাকছে। একটা লক্ষণরেখা রক্ষা করাও হচ্ছে, আবার ভোটের সময় লড়াইও হচ্ছে। শরদ পাওয়ার থেকে নবীন পট্টনায়েক। আবার কেজরিওয়াল থেকে কমলনাথ, অনেকেই এই সম্পর্ক এখন রক্ষা করেন। অতীতে বহু বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুও এই কৌশল রক্ষা করেছেন কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে রাজীব গান্ধী, এমনকি নরসিংহ রাওয়ের সঙ্গেও।
আরও পড়ুন: কী কথা হল মোদীর সঙ্গে? খুলে বললেন মমতা
অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জ্যোতি বসু প্রথমে বলেছিলেন, অসভ্য বর্বরদের সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আমি দেখা করব না প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। পরে বুদ্ধদেব ভটাচার্য এই কৌশল সম্পূর্ণ বদলে ফেলেন। বুদ্ধবাবু তো উপপ্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গেও গভীর বন্ধুত্ব রক্ষা করেন। আমার এই মডেলটা কিন্তু বেশ ভালো লাগে। নেহরুর সময় তো এমনটাই হতো। ভোটের জন্য যাই হোক, ব্যক্তিজীবনে একই পেশায় এই কলহ, মারদাঙ্গা, হিংসা কেন?
এখন পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে আন্দোলন যাই হোক, কেন্দ্র পিছু হটা তো দূরের কথা, আইন কার্যকরও করে দিচ্ছে। আবার এটাও সত্য যে এখন বাংলাদেশে কোনও অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা দিল্লির সঙ্গে নিঃশব্দে বৈঠক করছেন, কিন্তু তাঁদেরও মোদী জানিয়ে দিয়েছেন, একজন মুসলিমকেও ঢাকায় বলপূর্বক ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। তাই বিরোধীদের প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। চিল কান কেটে নিয়ে চলে গেছে বলে প্রচার হচ্ছে, কিন্তু ভাই, আগে নিজের কানে হাত দিয়ে তো দেখুন, আপনার কানটা আছে না নেই। মিথ্যে বিরোধী প্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন কিনা।
বাংলাদেশের সদ্য প্রাক্তন হাইকমিশনার মোয়াজ্জেম আলি, যিনি দিল্লিতে কর্মরত ছিলেন, তিনিও যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান দিল্লি ছাড়ার সময়, তখনও প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বলেন, দুদেশের সম্পর্ক অটুট থাকবে। মুজিবর রহমানের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তো মোদীর মার্চ মাসে ঢাকাও যাওয়ার কথা। মোদী তাঁকে বলেন, এ হলো বিজেপির দলীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতি।
আরও পড়ুন: মমতার আচরণে ‘বিস্মিত’, বিজয়নের পর তৃণমূলকে একজোট হওয়ার বার্তা ইয়েচুরির
তখন হাইকমিশনার সাহেব হাসতে হাসতেই নাকি প্রশ্ন করেন, এটা যদি বাস্তবায়িত না হয়, শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই হয়, তাহলে এত ঘটা করে এ আইন কার্যকর করার দরকার কী ছিল?
আসলে এ হলো মেরুকরণের রাজনীতি। আপাতত দুপক্ষই ভাবছে, ভোটে তাদের লাভ হবে। বিজেপি মনে করছে, সংখ্যালঘু এবং বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদীরা নাগরিকত্ব বিলের যত বিরোধিতা করবেন, বিজেপির ততই লাভ, আর মমতা মনে করছেন, শুধু সংখ্যালঘু বাঙালি (৩০ ভাগ) এবং উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালিও তাঁর আন্দোলনে শামিল। ১৯৮৪ সালে তিনি প্রথম ভোটে জেতেন, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে যাদবপুরে পরাস্ত করে। তারপর মমতা উদ্বাস্তুদের নিয়ে আন্দোলন করেন।
বাংলায় নাগরিকত্ব পাবেন, এমন হিন্দু নাগরিক এবার কত হবেন? সেই সংখ্যাটা ৫০ থেকে ৬০ লাখ হবে বলছে আরএসএস, মমতা বলছেন অসম্ভব। এসব তর্ক বিতর্কে আপাতত মমতার শাসন নয়, সিন্ডিকেট থেকে সারদা নয়, আপাতত এসবের চেয়েও বড় ইসু হয়ে গেছে 'ক্যা'। এতে লাভ কার, সেটাই প্রশ্ন।