অভয়া কি কোনো নদীর নাম? হতেই পারে। নদীর নাম যদি শোকনাশিনী হতে পারে, হতে পারে পুনর্ভবা - যে ফিরে ফিরে জন্ম নেয়, তাহলে অভয়া হতে বাধা কোথায়? বিশেষত তরাইয়ের নদীকূল, যাদের নাম বৈচিত্রের কিনারা নেই - কারো নাম যদি রহস্যময় রাঙাপানি, একজনা ফুলেশ্বরী, অন্য একজনা তবে লচকা - একেবারে মানভূমি শব্দ।
‘গুঁদলি কুটি গুঁদলি কুটি ছইলকে উঠে চাল গ’
মাহাতো ঘরের বড়বৌ টো লচকায়ে খায় চাল’...
গুঁদলির দানা যে কতো সুস্বাদু তারই বিবরণ দিয়ে গান। গুঁদলির দানা ঢেঁকিতে কুটতে কুটতে সম্পন্ন মাহাতো ঘরের বড়বৌ ছলা করে কোমর দোলানোর ছলে সে দানা মুঠো করে মুখে ফেলে দিচ্ছে। শিলিগুড়ির তরাই অঞ্চলে চঞ্চলা নদীর এ নাম হয় কী করে! কবে কোন চা বাগানে শ্রমিক হয়ে আসা মেয়ে কী পুরুষ এই নামের জলধারায় নিজের মানভূমের কোন নদীকে স্মরণ করেছিলেন, সেই প্রবাসবেদনার স্মৃতি হয়ত এই নদীই কেবল জানে!
পড়ুন দেবেশ রায়ের কলাম মনে পড়ে কী পড়ে না
সেই তরাই অঞ্চলে বড় নদী যদি দুটি, তিস্তা আর মহানন্দা, ছোট নদী তাহলে অগণন। যেমন তাদের নামের বাহার, তেমনই তাদের জলের প্রাচুর্য। কোথা থেকে আসে এত জল, তার জবাবও মোটামুটি সকলেই জানেন - পাহাড়ের গা বেয়ে বর্ষার যে বিপুল জল গড়িয়ে আসে, প্রধানত তাই এই নদীদের জন্মের উৎস। একশ বছর আগেও বর্ষাকালে পাহাড় বেয়ে ঝড়ের বেগে নেমে আসা জলকে সামাল দেবার জন্য হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে ছিল স্বাভাবিক ঘন অরণ্য। বা হয়ত উলটো করে বলাটাই ঠিক - সেই জলই অজস্র ধারায় সিঞ্চন করে করে ঘন বন তৈরি করেছিল হিমালয়ের সমগ্র সমতল মিলনস্থল জুড়ে। লোকের মুখে মুখে সে বনের নাম ছিল ‘চারকোশি ঝাড়ি’ - চার ক্রোশ চওড়া জঙ্গল।
ঔপনিবেশিক আমলে বণিকের বিবেচনাশূন্য লোভের গ্রাসে তা আগে-পরে লোপ পেতে শুরু করে। সবচেয়ে আগে গিয়েছিল বোধহয় উত্তর বিহারের কোশী নদীর অববাহিকার জঙ্গল। অশেষ ঐশ্বর্যময়ী কোশীর সীমাহীন দুর্দশার সে কথা অন্যদিন। আজ শুধু এইটুকু বলে সামান্য অহঙ্কার করা যেত যে সমস্ত ‘চারকোশি ঝাড়ি’র অবশিষ্টাংশ সারা নিম্ন হিমালয়ে রক্ষা পেয়েছিল কেবল আমাদের রাজ্যের এই অংশটুকুতে - তরাই-ডুয়ার্সে। ‘পেয়েছিল’ এমন অতীতকালের ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলাম কেন? কেন যে, তাই দেখতেই গত সপ্তাহে গিয়েছিলাম তরাই - এক ইচ্ছেনদীর কাছে।
শিলিগুড়ি শহরের আগে পিছে ছোট ছোট এত নদী আর এমন কানজুড়োনো নাম তাদের, শুনলে বোঝা যায় যে মানুষরা প্রথম এসে বসতি গড়েছিলেন, কী খুশি ছিলেন তাঁরা এই সদা উচ্ছ্বসিতা কল্লোলিনীদের দেখে। ওই যে লচকা, তারপর শহরে ঢোকবার মুখে রাঙাপানি। শহরের মধ্যে দিয়ে চলে ফুলেশ্বরী আর জোড়াপানি। একটু বাইরের গা ঘেঁষে সাউ নদী। আর তো আছেই বালাসন, মহানন্দা, একটু এগিয়েই যার নাম হয়ে যাবে ফুলহার।
অথচ, সেই উতল জলের ধারাগুলি স্রোত হারিয়ে রিক্ত সৌন্দর্য হয়ে গেছে গত দুই কী তিন দশকে। জোড়াপানি কিংবা ফুলেশ্বরী যে নদী, একথা আজ আর বিশ্বাস করতে পারেন না সেই প্রজন্ম, যাঁদের বয়স এখন ত্রিশের কোঠায়। তাঁরা শৈশব থেকে দেখেছেন ফুলেশ্বরী শহরের প্রধান নর্দমা, আর জোড়াপানি কোনও কারখানার ফেনিল রাসায়নিক বয়ে নিতে বাধ্য হয়, তাই তার জল নদীত্ব হারিয়ে কালো ফেনার ধারা। আর, সবচেয়ে বড় নদী মহানন্দা? তার সমস্ত খাত জুড়ে বছরের পর বছর এত বসতি বেড়েছে যে তাকে মহানন্দা উপনগরী বললেও অত্যুক্তি হয় না। যে বছর বন্যা আসে, নিরুপায় বাসিন্দাদের দুর্দশা হয়। তারপর ক্ষয়ক্ষতির হিসেব হয়, ত্রাণ হয়, কারো কারো বেশ উন্নয়নও হয় - সে সব ভিন্ন গল্প। কেউ কেউ বলেন এই সমস্ত কার্যধারা চালু রাখার জন্যেই প্রথম থেকে মহানন্দার খাত জুড়ে বসতি করায় কখনও প্রশাসনিক বাধা আসে নি।
সাউ নদীর উৎস শহরের পূবদিকে, রেললাইনের ওপারে। কাছাকাছি গ্রামের নামই সাউডাঙি। নামেই প্রকাশ এখানে ঊর্বর মাটি, সাধারণ গ্রাম কখনই ছিল না, ছিল ডাঙা জমি। সে মাঠ জুড়ে বেশ কয়েক বছর আগে এক মিশন ও মন্দির তৈরি হয়েছে। তাকিয়ে থাকার মত বাগানের শোভা তাদের। কিন্তু আশ্রম ও প্রতিবেশী বাগান উৎসাহী মানুষরা বলেন, এই সাউডাঙি এলাকার সমস্ত মাঠ ছিল বালিতে ভরা। ট্রাক ভরে ভরে নরম মাটি নিয়ে এসে এখানে ঢেলে তবে ক্ষেত, বাগান বসত গড়া হয়েছিল। অর্থাৎ এই দামাল নদীকন্যা এখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে খেলাধুলো করতে অভ্যস্ত ছিলেন। এবং নিজ রাজ্যে মেলা লোকজন অ্যালাউ করেন নি। তাই বালিভরা ছিল সমস্ত ক্রীড়াভূমি।
শহরের কিনার ঘেঁষে বয়ে চলা সাউয়ের আজ আর ধনীর স্বেচ্ছাচারী দুলালীর দাপট নেই। একে তো তার জলের ধন কম পড়েছে, তার ওপর তার স্বাস্থ্যসম্পদও ক্ষীণ হয়েছে। কোনও পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে সরাসরি নামে নি সাউ নদী, তরাইয়ের জলসমৃদ্ধ মাটির কোনো চ্যুতি (fault line) থেকে উঠে এসেছে, যেন পাতালঘর ছেড়ে রাজকন্যা এসেছিল ওপরের মাঠঘাট-আকাশ দেখতে। দেখতে দেখতে সে এত দূর এসেছে যে আর ফিরে যাওয়া হয় নি।
কিন্তু অন্য আরও অনেক সুন্দরী নদীদের মতই তারও কপালে দুর্যোগ ঘটেছে এখন। যেখানে যত খুশিতে বয়ে যাওয়া স্বাধীন নদী ছিল, তাদের সকলকেই হাতে বেড়ি, পায়ে শিকল দিয়ে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের ঘরধোয়া, জল তোলা, তার ক্ষেতে জল দেওয়ার কাজে। এসব কাজ তারা আগেও করত নিজের খুশিতে, কিন্তু এখন তাদের সেইসব কাজ করতে হয় অন্যদের হুকুম মতো। সাউ নদীরও স্বাধীনতা গিয়েছে, তার প্রাণের, মানে জলধারার বেশির ভাগটাই, জন্মঘরের কাছাকাছি থেকেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে চাষের ক্ষেতে জল দেবার ক্যানালে। তাতে যে সেইসব জায়গায় খুব বিপুল ফসল ফলছে এমন নয়, কিন্তু হারিয়ে গেছে নদীর ধারের সাধারণ ঘাসজমি, ছোট সাউডাঙি গ্রামের লোকজনের সঙ্গে তার নিত্যদিনের সম্পর্ক ঘুচে গেছে।
‘বালি দিয়ে মাজে থালা/ঘটিগুলি মাজে/ বধূরা কাপড় কেচে যায় গৃহকাজে’ সেই ভাব-ভালোবাসার কাল গিয়েছে। এখন নদী এক তিরতিরে ধারা। টানেলের মত বাঁধানো নদীর ক্যানালের জল মানুষের মর্জি মতন বাড়া-কমা করে। ক্যানালের নিচে জলের সঙ্গে বয়ে আসা বালি জমা হয়, নদী নিজের স্বচ্ছন্দ গতিতে বয়ে যেতে পারে না বলে সেই বালি-মাটি জমতে থাকে। ক্রমে নদী কিংবা ক্যানালে আর বর্ষার এসে পড়া জল ধরার জায়গা থাকে না। সে জল তখন দুপাড় উপচে জমি ভাসায়। পঞ্চাশ বছর আগে প্রকৃতির নিজের নিয়মে যে বন্যা ছিল চাষির কাছে পলিমাটি আর অজস্র মাছের আশীর্বাদ, আজ তা হয়ে উঠেছে ক্যানালের নিচে জমে ওঠা বন্দীবালির ঊষরতার আগ্রাসন।
পড়ুন সন্মাত্রানন্দের কলাম ধুলামাটির বাউল
তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্লাস্টিক। সাউ নদী যেখানে শহরের প্রান্ত ঘেঁষে বেরিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে, সেখানে একটি স্কুলের মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ ফুট দূরে দেখা গেল এক আশ্চর্য ভীতিজনক দৃশ্য - নদীর সামান্য জলে ভেসে থাকা অসংখ্য পলিথিন প্যাকেট ছাড়াও দুপাশের বালির নিচে পোঁতা স্তরে স্তরে পলিথিন প্যাকেটের রাশ। বড় গাছের কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদ করলে যেমন দেখা যায় কোন বছর ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল তার সংকেতচিহ্ন, ঠিক তেমনভাবেই প্রতি তিন-চার ইঞ্চি বালির নিচে নিচে প্রোথিত রয়েছে পলিথিন প্যাকেটের স্তর। যেন হিসেব লেখা আছে, কোন কোন বছরে বন্যার জল নদীর পাশ ছাপিয়ে উঠেছিল। প্রত্যেকবার তাকে জলের সঙ্গে মাথায় করে বয়ে আনতে হয়েছে ওই পলিথিন প্যাকেটের ভার। নদীর ধারে যতদূর অবধি বালির নিচে বিস্তৃত ওই পলিথিন প্যাকেটের রাশি, বোঝাই যায় সেইসব জায়গা দিয়ে আর মাটির ভেতর প্রবেশ করবে না বৃষ্টিজলের ধারা। অথচ ওই মাটির মধ্যে প্রবেশ করা জলই শুকনোকালে নদীকে, গাছপালাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণরস।
কাছাকাছি বিশাল স্কুলটির পরিচালিকা ও তাঁর সহকর্মীরা আন্তরিক চেষ্টা করছেন শুধু স্কুলবাড়ি নয়, সংলগ্ন নদীতীরও প্লাস্টিকমুক্ত রাখতে। এই সহকর্মীদের সকলেই যে স্কুলের সঙ্গেই যুক্ত, এমনও নয়। গাছ লাগিয়ে, অন্য নদীখাতগুলো থেকেও প্লাস্টিক সরিয়ে এঁরা এক ধৈর্যশীল সম্মেলক চেষ্টা করে যাচ্ছেন শহরকে জলে, ছায়ায় ভরে তুলতে। এই পুরোনো ঐতিহ্যময় প্রধানশিক্ষিকা নিজেও স্কুলের বাইরে অনেকটা পর্যন্ত ছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে প্লাস্টিক প্যাকেট তুলে ফেলার কাজে হাত লাগান। তবু নদীজলে আর নদীতীরে মাটিতে বসে যাওয়া প্লাস্টিক প্যাকেট।
তার অন্যতম প্রধান কারণটিও জানা গেল। শহরের বর্জ্য জমা করার নির্দিষ্ট স্থানটি সাউ নদীর উৎসের খুব কাছে। আর, কে না জানে আজকাল শহরের বর্জ্যের শতকরা ষাট ভাগই তো পলিথিন প্যাকেট। বর্ষা বা না-বর্ষায় সে সব প্যাকেট মুক্ত আনন্দে উড়ে বেড়ায়, তাদের একটা বড় অংশের গতি তো নদীর দিকেই, কারণ নদীই হলো কাছাকাছি ভূভাগের নিম্নতম অংশ।
খুব আশা করে থাকব শিলিগুড়ি-নিউ জলপাইগুড়ির শুভচিন্তক বাসিন্দাদের এক বড় অংশ পুরসভাকে রাজি করাতে পারবেন দূষণের স্তূপ নদী-উৎস থেকে কিছু সরিয়ে নিতে। কিন্তু, কবীরের প্রশ্নের কথা মনে পড়ে - কোন দিকে ঈশ্বর নেই বলে দাও, সেদিকে পা করে শোব। কোথায় ফেলা সঙ্গত হবে বিপজ্জনক দূষণের স্তূপ?
অসামান্য লেখিকা, আমেরিকার কালো মেয়ে অ্যালিস ওয়াকার বলেছিলেন, "এভরিথিং ইউ লাভ ক্যান বি সেভড।" যা কিছু তুমি ভালোবাসো, তা রক্ষা পাবে। কথা হল, রক্ষা করার সেই একনিষ্ঠ শক্তি কি আছে আমার ভালোবাসার?
(জয়া মিত্র পরিবেশবিদ, মতামত ব্যক্তিগত)
জয়া মিত্রের এই কলামের সব লেখা এই লিংকে