Advertisment

কৈলাশবাবু, গল্পটা চিঁড়ের নয়, গল্পটা তকমার

যে কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বা জাতিকে 'ওরা' বানিয়ে দেওয়া যায়। যাদের বিপরীতে রয়েছি 'আমরা'। এভাবেই নাৎজি জার্মানিতে ইহুদীরা, বা তাঁদের সমর্থনে কথা বলা জার্মানরাও, হয়ে যান 'ওরা'।

author-image
IE Bangla Web Desk
New Update
kailash vajayvargiya

কৈলাশ বিজয়বর্গীয়

পোলাও নয়, কালিয়া নয়, বিরিয়ানি নয়, অতি নগণ্য চিঁড়ে। এই নিয়েই শুক্রবার সকাল থেকে তোলপাড় সোশ্যাল মিডিয়া। সৌজন্যে বিজেপি নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, যাঁর প্রাথমিক পরিচয়, তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক, আদতে মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা। কিন্তু তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে, যা বাংলার মানুষ জানেন। বিজেপির তরফে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকও বটে। সুতরাং আশা করা যায়, বাংলা এবং বাঙালি সম্পর্কে তাঁর ধারণা, বা সাধারণ জ্ঞান, সাধারণের চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই হবে।

Advertisment

এই ধারণা কিনা এক ধাক্কায় নস্যাৎ করে দিলেন কৈলাশবাবু! মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে তাঁর বাড়িতে কর্মরত কিছু শ্রমিককে দেখে তাঁর সন্দেহ হলো, তাঁরা বাংলাদেশি। কেন? না, তাঁরা বাংলার কোন জেলার বাসিন্দা, তাঁদের ঠিকাদার বলতে পারেন নি, এবং তাঁরা রাতের খাওয়ার সময় "স্রেফ চিঁড়ে" খাচ্ছিলেন, রুটি নয়। বাঙালির অতি আদরের চিঁড়ে, যা আমরা পেট খারাপ হলে দই মেখে বা জলে ভিজিয়ে লেবু-চিনি দিয়ে খাই, পোলাও বানিয়ে খাই, মোয়া তৈরি করে ফেলি, খোলায় (অথবা সামান্য তেলে) ভেজে বাদাম দিয়ে খাই, এমনকি পিঠে-পুলিতেও দিয়ে দিই সুবিধে পেলেই।

কৈলাশবাবু অবশ্য 'চিঁড়ে' কথাটা ব্যবহার করেন নি, উনি বলেছেন 'পোহা'। এতে আবার বেজায় চটে গেছেন অসংখ্য আম ভারতীয়, বিশেষ করে মারাঠিরা, কারণ জন্মগতভাবে মারাঠি 'পোহা' ভারতের বহু প্রান্তে জলখাবার হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। টুইটারে দেখলাম একজন লিখেছেন, "মজুররা পোহা খাবেন না তো কী খাবেন? বাটার চিকেন?"

আরও মজার কথা হলো, অসংখ্য বাংলাভাষী, যাঁদের মধ্যে অবশ্যই বাংলাদেশিরাও পড়েন, 'পোহা' শব্দটার অর্থই জানবেন না। এবং কৈলাশবাবু এই ভিত্তিতে বাঙালি এবং বাংলাদেশির বিভাজন করতে গেলে গাঁ উজাড় করে ফেলবেন। অতএব সেই চেষ্টা না করাই ভালো। তবে ওই শ্রমিকরা "স্রেফ চিঁড়ে" খাচ্ছিলেন বলে দাবি কৈলাশবাবুর, তার মানে কি শুকনো চিঁড়ে চিবোচ্ছিলেন তাঁরা? তাই তাঁরা বাংলাদেশি? যদিও বাংলাদেশিরা এরকম করেন বলে জানা নেই আমার।

কৈলাশবাবু অথবা তাঁর পুত্র আকাশবাবুর অন্যান্য কিছু আচার-অভ্যাস নিয়েও লেখার লোভ সামলানো কঠিন, তবে তা করতে গেলে অপ্রাসঙ্গিকতার দায়ে দুষ্ট হবে এই লেখা।

এ তো গেল হাসি-মস্করার কথা। যা অবশ্যই এই লেখার উদ্দেশ্য, তবে আংশিকভাবে। একটু তলিয়ে ভাবলে বুঝবেন, ক্ষমতা থাকলে কত সহজে এই ধরনের বিভ্রান্তিকর, আপাত হাস্যকর, মন্তব্য করে কারোর গায়ে বিশেষ কোনও তকমা সেঁটে দেওয়া যায়। কৈলাশবাবুর সাধারণ জ্ঞানের বহর নিয়ে আমরা হাসি-তামাশা করছি, কারণ চিঁড়ে বা পোহা কী, তা আমরা জানি। কিন্তু ধরুন এমন কোনও ঘটনা ঘটল, যা আমাদের সাধারণ জ্ঞানের বাইরে, তখন কী হবে? কৈলাশবাবু নিজেই বলেছেন, ওই সন্দেহভাজন শ্রমিকরা আর তাঁর বাড়িতে কাজ করছেন না। চিঁড়ে খাওয়ার অপরাধে তাঁদের যে রোজগারের ক্ষতি হলো, এটা ভাবলে কি একটু কম হাসি পাচ্ছে না?

বেঙ্গালুরুতে সম্প্রতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে ৩০০টির বেশি ঝুপড়ি, কারণ সেখানে নাকি 'বাংলাদেশিরা' বাস করতেন। স্রেফ অবৈধ বাসিন্দা বললে এক্ষেত্রে অন্যায় হতো না, যেহেতু দেশের ৯৯ ভাগ ঝুপড়িই গড়ে ওঠে অবৈধভাবে। কিন্তু না, 'বাংলাদেশি' তকমাটা জরুরি ছিল। কেন, তা সকলেই জানেন। রাতের অন্ধকারে সাদা পোশাক (উর্দি নয়) পরিহিত কিছু ব্যক্তি নিজেদের পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে শুরু করে ভাংচুর। বাসিন্দারা প্রতিবাদ করেন, নিজেদের কাগজপত্র দেখান, কিন্তু ধোপে টেকে না কোনও কিছুই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, ঘটনা পরবর্তী সময়ে জানাই গেল না, এই বস্তি উচ্ছেদের নির্দেশ কে দিয়েছিলেন। পুলিশ, পুরসভা, প্রশাসন, সকলেই দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে এখনও।

যে কোনও ব্যক্তি বা সম্প্রদায় বা জাতিকে 'ওরা' বানিয়ে দেওয়া যায়। যাদের বিপরীতে রয়েছি 'আমরা'। এভাবেই নাৎজি জার্মানিতে ইহুদীরা, বা তাঁদের সমর্থনে কথা বলা জার্মানরাও, হয়ে যান 'ওরা'। ভারতে এই প্রক্রিয়া যে শুরু হয়ে গিয়েছে, তা তো মোটামুটি সকলেই বুঝতে পারছেন এখন। সেই প্রক্রিয়া পরিণতি পাবে কিনা, তা নির্ভর করবে ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর। হিটলারের জার্মানিতে তাকে প্রতিরোধ করেন নি কেউ, অকল্পনীয় যন্ত্রণাময় মৃত্যু ঘটেছিল আনুমানিক ৬০ লক্ষ ইহুদীর, আর্থ-সামাজিকভাবে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল জার্মানি।

আজ বেঙ্গালুরুর বস্তি, কাল ইন্দোরের শ্রমিক, পরশু? আর কাকে 'বাংলাদেশি' বলে চিহ্নিত করা হতে পারে? এমন একটা সময় কি সত্যিই আসবে, যখন কোনও বাংলাভাষী ভারতবর্ষের বুকে বসে প্রকাশ্যে বাংলায় কথা বলতে ভয় পাবেন? চিঁড়ে খাচ্ছেন বলে কেউ যদি বাংলাদেশি হয়ে যান, বাংলা বললে কেন নয়? কথাটা পড়লে হয়তো আজগুবি মনে হচ্ছে, কিন্তু এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে খুব বেশিদিন লেগেছে কি?

আজ আমরা চিঁড়ের সর্বভারতীয় চরিত্র নিয়ে এত কথা খরচ করছি, হালকা বা গম্ভীর আলোচনা করছি, এমনটাও কি খুব বেশিদিন আগে করব বলে ভেবেছিলাম? বাড়ির ফ্রিজে মাংস পাওয়া গেলে পিটিয়ে মারা যায়, চিঁড়ে খেতে দেখলে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া যায়, এই চিন্তাধারার পরিণতি ঠিক কী, তা নিয়ে ভাবার সময় যদি এখনও না এসে থাকে, তবে হয়তো ধ্বংসই শ্রেয়।

Advertisment