দ্রুত। দ্রুত। দ্রুত। সময় পেরোচ্ছে। রাস্তা পেরোচ্ছে। পালটে যাচ্ছে রাস্তা। পালটে যাচ্ছে ভাবনা। আমরাও ছুটছি। ছুটছি। ক্লান্তি আমাদের গ্রাস করছে না। 'হ্যাবিট' নামক এক হায়ারাার্কি চেপে বসে যাচ্ছে আমাদের মগজে। চেপে বসছে আপডেটেড থাকা এবং অন্যকে আপডেট দিতে থাকার ভূত। আর এই ভূত, জন্ম দিচ্ছে ভয়- "হারিয়ে যাবো না তো?" "এই বিষয়ে লিখলাম, অন্য বিষয়ে না লিখলে আমাকে দাগিয়ে দেওয়া হবে না তো?" "দলছুট হয়ে পড়ব না তো?" "কেউ ভেবে বসবে না তো যে আমি সমাজসচেতন নই?" "আমাকে যদি কেউ যথেষ্ট আধুনিক না ভাবে"! ভয় থেকে জন্ম নেওয়া এইসব সংলাপ আমাদের চরিত্র নির্মাণ করে দিচ্ছে। সেই চরিত্রের ধাত্রীভূমি নেই, রয়েছে ফেসবুক। এক বায়বীয় বিশ্ব, যার মধ্যে নিরন্তর জন্ম নিচ্ছে বিরোধের ডিসকোর্স। কীভাবে? আসুন, লগ ইন করা যাক আমাদের ভাবনায়।
আরও পড়ুন, মেয়ের কবরটা ওরা পুড়িয়ে দেবে কি না, সংশয়ে কাঠুয়া কন্যার মা
আমরা এমন একটা সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে আমরা খবরকাগজ, নিউজ চ্যানেল অথবা অনলাইন পোর্টাল থেকে যত বেশি খবর জানতে পাই, তারচেয়ে অনেক বেশি খবর আমাদের কাছে আসে ফেসবুক মারফৎ। আমরা হাসি। আনন্দ পাই। ক্ষেপে উঠি। তারপর, পোস্ট করি। আমাদের কথা, আমাদের ভাবনা লিখে ফেলি টাইমলাইনে। এই টাইমলাইন কি মহাকালের ডিজিটাল সংস্করণ? তাই পালাবদল হয়। সময় চলে যায়, স্বয়ং সময়ের গর্ভে। আমরা এগোতে থাকি পরবর্তী খবরের দিকে। মাঝেমাঝে রিমাইন্ডার এলেও ফিরে তাকানোর মতো সময় আমাদের হাতে থাকে না। তাই তৎক্ষণাৎ বলে ফেলতে হবে যা বলার, যে লেখার। একেকটা দিন আসে, ফেসবুক খুললেই অসহায় লাগে। মনে হয় ইদিপাসের মৃতনগরীতে ভুল করে লগ ইন করে ফেলেছি। ঘৃণা, প্রতিহিংসা, অপরাধ, আর আরও বেশি করে বিজ্ঞাপন চেয়ে চেয়ে দেখছি। গোটা বিশ্ব এতদিন বিভিন্ন প্রোপাগান্ডা দেখেছে। বিভিন্ন রাজারা ইতিহাস লেখাতেন নিজেদের প্রচার করে। বিভিন্ন ধর্ম নিজেদের কথা সোচ্চারে প্রচার করছে, করেও। সবই ছিল প্রোপাগান্ডা। পরবর্তীকালে আমরা দেখেছি দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দুরকম প্রোপাগান্ডা। একটি ছিল ক্যাপিটালিস্ট ন্যাটো-ব্লক, আরেকটি ছিল কমিউনিস্ট-ব্লক। আমরা এসব দেখে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম।
আরও পড়ুন, কাঠুয়া ধর্ষণ ও হত্যা- শিশুটি তো জানতাই না কাকে হিন্দু বলে, মুসলমানই বা কে! খেদ সন্তপ্ত বাবার
এখন আমরা দেখছি আর শিখছি আরেকটি প্রোপাগান্ডা। সেটা হল সেলফ প্রোপাগান্ডা। ক্যাপিটালিস্ট ওয়েস্ট আমাদের কাছে খুলে দিয়েছে এক নতুন দিগন্ত, ফেসবুক। যেখানে সবাই লেখক, সবাই চিন্তক। "আমাকেও কিছু একটা লিখতে ফেলতে হবে।" কথাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের সবার মাথায়। অথচ আপনি একে অস্বীকারও করতে পারবেন না। এই যে এই লেখাটা এটাও নিশ্চই কোনোভাবে ছড়িয়ে যাবে ফেসবুকে। ছড়িক পড়ুক, সেটাও কি চাইছি না? চাওয়া অস্বাভাবিকও নয়, কারণ কথা বলার স্বাধীন মঞ্চ সবার কাম্য। তাই কমবেশি সবাই ফেসবুকের সমর্থক। এই সমর্থন করতে করতে আপনার চোখে পড়ে যায় একজন বন্ধুর 'ফিলিং অসাম' পোস্ট। তিনি লিখেছেন পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরাঁতে তার সপরিবার লাঞ্চ করার অপূর্ব অনুভূতির কথা। আপনি পোস্টটি দেখে ভাবতে বসলেন, সত্যিই তো, কতদিন যাওয়া হয়নি সেই অমুক রেস্তোরাঁয়। এবার যেতেই হবে। এটা ভাবতে ভাবতেই আপনার মনে পড়ে গেল, আরে! আপনার এই বন্ধুটিই তো দু'ঘণ্টাখানেক আগে পোস্ট লিখেছিল "কাঠুয়ার শিশু আমার মেয়ে। আমার নিজের মেয়ে। জীবনের সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকার মানেটাই হারিয়ে ফেলছি। ওকে যারা ধর্ষণ করেছে তাঁদের শাস্তি না হলে আমারও বেঁচে থাকার কোনও মানে নেই!" ঠিক এমনটা বা এর কাছাকাছি কিছু লিখেছিল আপনার বন্ধুটি। আর আপনি? বন্ধুর সেই পোস্টের কমেন্ট বক্সে লিখেছিলেন "আমিও ভালো করে ঘুমোতে পারছি না, খেতে পারছি না খবরটা শুনে।" অথচ দেখুন, এগুলো লেখার ঘণ্টা দুই পরেই আপনি আর আপনার বন্ধুটি পার্ক স্ট্রিট্রের রেস্তোরাঁর খাবার খাচ্ছেন অথবা খাওয়ার কথা ভাবছেন অথবা নিজের প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করছেন অথবা অন্য কোনও বেড়াতে যাওয়ার গ্রুপে গিয়ে কমেন্ট করে আসছেন অথবা এসবের বাইরে ক্যান্টিনে বসে আগামী ইনক্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা করছেন। করছেন তো? তাহলে নিগৃহীত শিশুটিকে আপনি নিজের মেয়ে বলে দিলেন কেন? সন্তানের মৃত্যুশোক তো সবচাইতে বেশি। তাই, লাঞ্ছিতা, মৃতা শিশুটিকে মেয়ে বলে তারপর বাকি সব কাজ করতে শুরু করে আপনি কি আদতে ওকেই অপমান করলেন না?
আরও পড়ুন, INDIAN EXPRESS EXCLUSIVE: মৌন মোদিকে নিয়ে সরব মনমোহন
কিংবা ধরা যাক, আপনি একজন কবি। কবিতাই আপনার ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। শিশুটির মৃত্যুর বীভৎসতা নিয়ে আপনি কবিতা লিখেছেন, বেশ করেছেন। কবিতাই তো কবির অস্ত্র। তাই প্রতিবাদ এবং শোকপ্রকাশ তিনি কবিতাতেই করবেন, সেটাও স্বাভাবিক। ফেসবুকে সেই কবিতা দিয়ে দেওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু সেই কবিতার নীচে যদি কেউ কমেন্ট করে "অপূর্ব লেখা!", আর সেই কমেন্টের রিপ্লাইতে আপনি যদি লেখেন "থ্যাংক ইউ" তাহলে সেটা আর শোকপ্রকাশ থাকে না, হয়ে যায় সেলফ প্রোপাগান্ডার বিজ্ঞাপন। বৃহত্তর অর্থে সেটা অশ্লীলতার শামিল। এর মাধ্যমে আপনি কিন্তু আবার সেই শিশুটিকেই অপমান করে ফেললেন। তাই নয় কি?
আরও পড়ুন, কাঠুয়ার ঘটনায় এবার সরব রাষ্ট্রপতি
মেয়েটা এক সংগঠিত অপরাধের শিকার। ঘৃণ্য সেই অপরাধ। অপরাধীর শাস্তি চাওয়া ছাড়া আর কোনও দাবিই থাকতে পারে না এই মুহূর্তে। কিন্তু ফুটফুটে ফুলের মতো মেয়েটার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই সাংঘাতিক অপরাধের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আপনি যদি নিজের শিল্পের স্বীকৃতি চেয়ে বসেন তাহলে সেটা আর প্রতিবাদ থাকে না, শোকও থাকে না। আমরা সবাই কিন্তু কমবেশি এই প্রবণতার শিকার। কারণ, আমাদের আপডেটেড থাকতে হবে, বন্ধুদের আপডেট দিয়ে যেতে হবে, নাহলে কেউ আমাদের সম্বন্ধে অন্য ভুল ইমেজ তৈরি করে ফেলতে পারে! আর এই ইমেজ তৈরি করার খেলায় আপনি দেখতেই পেলেন না, আয়নায় আপনি আর নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। যে পাথরে থেঁতলে ফেলা হয়েছিল কাঠুয়া কন্যার মাথা, সেই পাথর ছিটকে এসে আয়নায় লেগেছে।